লাখো পুণ্যার্থীর সমাগমে শেষ হলো চীবর দানোৎসব


প্রকাশিত: ১১:৪৯ এএম, ২০ নভেম্বর ২০১৫

শুক্রবার ঘড়ির কাঁটা বেলা ২টা ছুঁই ছুঁই। `বুদ্ধ ধর্ম সংঘ বল, বল বুদ্ধের নামরে...` বিউগলের সুরে সুরে হাজার হাজার ভক্তনুরাগীর এমন কির্তন-গানের ধ্বনি প্রকম্পিত করে তোলে রাঙামাটির পবিত্রময় গোটা রাজবন বিহার এলাকাজুড়ে। ওই সময় প্রদক্ষিণ করা হয় নানাবিধ দানীয় সামগ্রিতে সাজানো কল্পতুরু এবং ২৪ ঘণ্টায় তৈরি চীবর শোভাযাত্রা।

তিল ধারণের জায়গাটুকু যেন ছিল না সামনের মাঠসহ প্রায় ৩২ একর বিস্তৃত রাজবন বিহার এলাকাটির। এই মহতী পুণ্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে সমাগম ঘটে লাখো মানুষের। এভাবে ধর্মীয় নানা আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রধান বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাজবন বিহারে বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুই দিনব্যাপী কঠিন চীবর দানোৎসব শেষ হয়েছে শুক্রবার। অনুষ্ঠান চলাকালে পাঁচ শতাধিক পুলিশের টহলে জোরদার ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।  

Rajbana

বেলা তখন ঠিক ২টা। সমাগত লাখো পুণ্যার্থী দাঁড়িয়ে দুই হাত করজোড়ে `সাধু...সাধু...সাধু` ধ্বনিতে শ্রদ্ধা জানান মঞ্চে আগত ভিক্ষুসংঘকে। সেই সময় লাখো জনতার মুহূর্মুহ ‘সাধু..সাধু..সাধু’ ধ্বনিতে শ্রদ্ধা নিবেদন তৈরি করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের এক পবিত্রময় পরিত্রাণের পরিবেশ। অনুষ্ঠানে অগণিত পূণ্যার্থীর পাশাপাশি যোগ দিয়েছেন দেশ-বিদেশ থেকে সমাগত অসংখ্য দর্শনার্থী।

সদ্ধর্ম দেশনাকালে মহাপরিনির্বাণগত বৌদ্ধ আর্য্যপুরুষ মহাসাধক পরমপূজ্য শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তের হিতোপদেশের উদ্ধৃতি দিয়ে মঞ্চে উপবিষ্ঠ তার উত্তরসূরি ভিক্ষুসংঘ পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে বলেন, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, ক্ষমতার গর্ব, বর্বরতা ও পাশবিকতার বিপরীতে বুদ্ধের প্রেম, সাম্য, মৈত্রী, ক্ষমা, ত্যাগ, অহিংসা, আত্মসংযম ও করুণার বশবর্তী হয়ে বিশ্বমানবের সুখ-শান্তি ও কল্যাণে সর্বদা নিজেকে ব্রত রাখতে পারলে একাল ওকাল পরম সুখ-শান্তি অর্জিত হয়। ধর্মীয় সভায় পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে ধর্মীয় দেশনা দেন রাজবন বিহারের আবাসিক ভিক্ষু প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরসহ অন্য ধর্মীয় গুরুরা।

Rajbana

রাজবন বিহারে বৃহস্পতিবার পঞ্চশীল গ্রহণ দিয়ে শুরু দুই দিনব্যাপী দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। আর শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ফানুস উত্তোলনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। দুপুরে ২৪ ঘণ্টায় তৈরি কঠিন চীবরটি (বৌদ্ধভিক্ষুর পরিধেয় বস্ত্র) বনভান্তের উদ্দেশে দানকার্য সম্পাদন করা হয়। এদিন সকাল থেকে দিনব্যাপী ভিক্ষুসংঘের পিন্ডদান, বুদ্ধপূজা, কল্পতরু শোভাযাত্রা, পঞ্চশীল প্রার্থনা, চীবর উৎসর্গ, সংঘদান, অষ্ট পরিষ্কার দান, ধর্মসভা, ধর্মীয় দেশনাসহ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি পালিত হয়।

শুক্রবার মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাঙামাটির সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, রাজবন বিহারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, রাণী ইয়েন ইয়েন রায়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ধর্মবিষয়ক সহ-সম্পাদক অ্যাড. দীপেন দেওয়ান, জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন, পুলিশ সুপার তারিকুল হাসান, রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভূট্টোসহ স্থানীয় সামাজিক, রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা।

অনুষ্ঠানে পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। বিশেষ প্রার্থনা পাঠ করেন রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি গৌতম দেওয়ান। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক প্রতুল বিকাশ চাকমাসহ অন্য কর্মকর্তারা সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। পরমপূজ্য বনভান্তের উদ্দেশে ২৪ ঘণ্টায় তৈরি চীবরটি ভিক্ষুসংঘের হাতে তুলে দেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।

Rajbana

এদিকে, রাজবন বিহারে আয়োজিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এ কঠিন চীবর দানোৎসব উপলক্ষে শুভেচ্ছা বাণী পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দান উপলক্ষে বাংলাদেশের সব বৌদ্ধসহ দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় তার প্রধান সেবিকা মহাপুণ্যবতী বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সূতা বের করে বেইনে (কোমর তাঁত) চীবর তৈরি করে বুদ্দের নিকট দানকার্য সম্পাদন করেন। বিশাখা প্রবর্তিত হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়মে রাঙামাটি রাজবন বিহারে প্রথম কঠিন চীবর দানোৎসব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। এবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ৪২তম কঠিন চীবর দানোৎসব।

সুশীল প্রসাদ চাকমা/এআরএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।