মুই সোনার বাংলা ছাড়ি যাবার ন্যাং বাহে
অশ্রুসিক্ত নয়নে,পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন আর ৬৮ বছরের মায়ার জালে বেধে রাখা বাপ-দাদার জমি ছেড়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ৬৪ জন অধিবাসী। হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর গোতামারী বিলুপ্ত ছিটমহলে ১৩৫ ও ১৩৬ নং থেকে বিলুপ্ত দুটি ছিটের। বৃহস্পতিবার দুপুরে লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দর দিয়ে
বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ছেড়ে যেতে চায় না মন কিন্তু তবু যেতে হলো। কারণ, ছিটমহল স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কারা বাংলাদেশে থাকবে আর কারা ভারতে যাবেন এ দুটি সুযোগই ছিল। সে মোতাবেক বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ১১১টি ছিটমহলের ৯৭৯ জন ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলো। তাদের মধ্যে প্রথম ধাপে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভারতে গেলেন ৬৪ জন নারী-পুরুষ ও শিশু।
এদিকে হাতীবান্ধার উত্তর গোতামারির বিলুপ্ত ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। দেশত্যাগীদের বার বার কান্নায় ওই এলাকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। বিদায় জানাতে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন স্বজনরা। আর কতদিনে দেখা হবে প্রিয়জনদের মুখ। এই বেদনাই সইতে পারছেন না কেউই। ভারতগামী মাধবী রানী কেঁদে কেঁদে বলেন, মোর এই সময় আর ভারত যাবার মন না চায়। স্যাটে মোক ক্যাও চিনবার পাইবে না, মুই ডোকা (কামলা) দিয়া খ্যাওন। মোর কাছোত ক্যাউ কামলা নিবে না। মুই এই সোনার বাংলা ছাড়ি যাবার ন্যাং বাহে বলতে বলতে মূর্ছা যান। সকালে বিদায় নেয়ার সময় গোতামারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুচরিতা রানী বলেন, সে এখানে থাকতে চায়। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে তাকেও ওপারে যেতে হচ্ছে। জানি না আর কোনো দিন এদেশে আসতে পারব কি না।
প্রতিবেশী আজিজুল মিয়া বলেন, এতে তো হামার মনোত বড় কষ্ট লাগছে বাহে। এতাদিন মিলেমিশে ছিনু হামরা। ওমরা গেইলে এলা গ্রামটা ফাঁকা ফাঁকা নাগবে। ওই সড়ক দিয়া গেইলে বুকটা ফাঁকা নাগে।
বৃহস্পতিবার সকালে হাতীবান্ধার দৈইখাওয়া এলাকায় ভারতগামী ওইসব মানুষজনকে মিষ্টি খাইয়ে ও একটি করে রজনীগন্ধার ফুল হাতে তুলে দেন প্রশাসনের লোকজন। এসময় উপস্থিত ছিলেন, হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন বাচ্চু, ইউএনও মাহবুবুর রহমান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান সেলিম, আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ সারওয়ার হায়াত খাঁন প্রমুখ।
অপরদিকে, ওইসব নাগরিকদের বরণ করতে বুড়িমারী স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের চ্যাংরাবান্দা চেকপোস্টকে বর্ণিল সাজে সজ্জিত করতে দেখা গেছে। সেখানে ভারতের কোচবিহারের বিধায়ক রথিন্দ্র নাথ ঘোষ, মেখলিগঞ্জের বিধায়ক পরেশ অধিকারী, জলপাইগুড়ি বিএসএফের ডিআইজি বিএস পাটিয়াল, কমান্ডেন্ট অজয় কুমার ও বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন নাগরিক কমিটির অন্যতম নেতা দীপ্তিমান সেন গুপ্ত তাদেরকে বরণ করবেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের পক্ষে লালমনিরহাট বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর মাসুদ, পাটগ্রাম উপজেলা নিবার্হী কর্মকতা নূর কুতুবুল আলমসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা এসব ভারতীয় নাগরিকদের বিদায় জানাতে উপস্থিত হয়েছেন। বুড়িমারী স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা যেকোনো মুহূর্তে ভারতে প্রবেশ করবেন।
লালমনিরহাট প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলার তিনটি উপজেলায় থাকা ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে সাতটি থেকে ১৯৫ জন মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে হাতীবান্ধার এবং অপর পাঁচটি পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল। ওই ১৯৫ জন ছাড়া বাকিরা এ দেশেই থেকে যাচ্ছেন।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন,পরিবারগুলো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ক্রেতাদের কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। তাদের ভারত যাত্রায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হয়। ট্রাভেল পাসধারী ব্যক্তিরা লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন দিয়ে ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমার চ্যাংরাবান্ধা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন দিয়ে ভারতে যান। এসময় উভয় দেশের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রবিউল হাসান/এমজেড/পিআর