নারী
আমি একদিন একা জেগে উঠেছিলাম। কবে কখন কিভাবে জানিনা। তবে জেগে উঠবার প্রয়োজন বোধ করছিলাম ভেতর থেকে। আমারও পায়ে বাঁধন ছিল-
-বড় হয়েছ। পা বের করে ওভাবে স্কার্ট পরোনা।
-বড় হয়েছ। ওড়না বুকের উপর থেকে পড়ে যায় কেন?
-বড় হয়েছ খোলা চুলে বাইরে যেওনা।
নারীর জন্ম বুঝি প্রথম অপরাধ। নারীর বড় হওয়া দ্বিতীয় অপরাধ। প্রথম বেড়ি হাতে পায়ে। প্রথম যত যত প্রথাগত নিয়ম কানুন শাসন। এত এত নারীত্বের আবরণে আভরণে, অবগুণ্ঠনে বড় হওয়া। আমার কিশোরী মন দোদুল্যমান। অত বাঁধন! অত শাসন! বাইরে বেরুবো পা বের করা যাবে না! অতবড় কাপড় পরে দৌড়ুবো কী করে! তারপর ভালোলাগা। বয়স- সুইট সিক্সটিন। যারে দেখি তারেই লাগে ভালো -
-ছেলেদের সাথে অত কথা কি? ছেলেদের সাথে কথা বলো না।
প্রথম চিঠি এলো প্রেমের।
-ছেলেদের চিঠি!পড়োনা, ছিঁড়ে ফেল।
-কোনো ছেলের সাথে বেড়াতে যেওনা। নদীর ধারে বসোনা। কোনো ছেলের হাত ধরোনা।
এই রকম নানা নিয়মতান্ত্রিক জটাজালেই আমার জীবনের শুরু। শুধু আমার কেন বাংলাদেশের যে কোনো নারীর ‘নারী’ জীবনের এমনই শুরু। নারীর পরিচয় কাটিয়ে মানুষ হয়ে উঠতেই বুঝি গেছে আমার যুগ যুগ। তারপর জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে চিনেছি নিজের ভেতর মানুষের পরিচয়। জেনেছি লুকানো সব বাঁধা আর শেকল ছিঁড়ে সত্যের পথে ধাবমান এক অজেয় অসীম অজানা বিপুল শক্তির আধার এই দেহ এই মন এই জনম।
মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে ভাবি ‘নারী’ একটা ভিন্ন বিষয় হয়ে ধরা দেয় প্রায়শ। নারী নির্যাতিত। নারী বঞ্চিত। নারী অধিকারহীন। নারী নিরাপত্তাহীন। যার যখন যেভাবে প্রয়োজন ব্যবহার করে নারীকে। কখনো ঘরের রাজনীতিতে। কখনো রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে। কখনো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। সৃষ্টিশীল কাজের আন্তর্জাতি স্বীকৃতিতে- নোবেল প্রাইজে, ধর্মের ফতোয়ায়, বোরখা আর হিজাবের অবগুণ্ঠণে। কখনো নারী একটি ভিন্ন বিষয় হয়ে ওঠে কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রেমে, বিরহে কিংবা প্রতারণায়। কিন্তু আমি ভাবি নারীর এক অন্য রূপ নিয়ে। মোহন সে রূপ। অভাবনীয় তার ক্ষমতা। সৃষ্টিতে, ধ্বংসে যুদ্ধে, প্রণয়ে কিংবা প্রলয়ে যা শুধু ঝল্কে ওঠে জোৎস্নার ছুরির মতো। নারী খুব দ্রুত লয়ে একাত্ব হয়ে পড়ে বিশ্বজগতে। ভালোবাসায়। এক পরিবার ছেড়ে চলে আসে অন্য পরিবারে। অচেনা। অজানা তার চারধার। অচেনা কোনো পুরুষের সাথে বিবাহে সমাজ তাকে বেঁধে দেয় অজানা নতুন সংসারে। কিন্তু সমাজ দেশ কিংবা সংসার তারও উর্ধ্বে নারী বেঁধে রাখে পুরুষকে। স্খলিত বীর্যে জন্ম দেয় নতুন জীবন। সমাজকে, জাতিকে এমনকি সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব যার ঘাড়ে। এই নারীকে বেঁধে রাখে সাধ্য কার। নারীর সাধ্য বোধকরি একদিন জেনেছিল পুরুষ। তাই শুরুতেই দেয় তাকে পায়ে মল, হাতে চুড়ি বালা শাখা, গলায় মালা। কিন্তু এভাবেই কি তাকে বাঁধা সম্ভব? এ যে নদী। এ যে সমুদ্র। এ যে অটল পাহাড়। এ যে দাম্ভিক যোদ্ধা। এ যে খাঁটি। বিশুদ্ধ মাটি।
বিধাতা নারীকেই মানব আবাদের সবচেয়ে খাঁটি জমি হিসেবে নির্বাচন করে দিয়েছেন। তাই সবকিছু ভেঙে চুরে চলে সে নিত্য নিরবধি। উত্তুঙ্গ স্রোতে ভাসাতে পারে প্রবল বৈপরীত্য। আবার পরম ভালোবাসায় কাছে টানতে পারে দারুণ আগুন। সাজাতে পারে ঝড়ের মাঝখানে বসে প্রদীপের আলো । কিন্তু তার ভেতর এই অদেখা শক্তিকে জাগাবে কে? একদিন দেবতারা তাদের সমস্ত শক্তির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন অসুর বধে। একই শক্তি। দেবতাদের নিজস্ব যা। তা দিয়ে জন্ম হয়েছিল এক মহাশক্তি, আদ্যাশক্তি নারীর। পৃথিবীর যত অমঙ্গল আর পাপ পঙ্কিলতা দূর করতে স্বয়ং দেবতাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল নারীশক্তির কাছে।পৃথিবী অসুরমুক্ত হতে পেরেছিল। এই নারীই একদিন দেবরাজ ইন্দের রাজসভায় নেচে ফিরিয়ে এনেছিলেন প্রিয় স্বামী লখিন্দরের প্রাণ। আছে কি এই সমাজে এই রাষ্ট্রে এই বিপুল বিস্তৃত অবাধ আন্তর্জাতিকতায় এমন কেউ যা তাকে থামিয়ে রাখতে পেরেছে?
আত্মশক্তি আর সৃষ্টিতে সমৃদ্ধিতে নারী যখন হাত লাগিয়েছে তখনই এসেছে ইপ্সিত মাত্রা। স্বয়ং ঈশ্বর যাকে করেছেন মহিমান্বিত জ্ঞানে শক্তিতে প্রজ্ঞায় তাকে জয় করা যায়। কিন্তু অত সহজে কি সে বধ্য! তাইতো যুগে যুগে জন্মেছেন হাইপেসিয়া, সুরবালা, হেমপ্রভা, ভার্জিনিয়া মেরী মিত্র, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, রোকেয়া, জোয়ান অব আর্ক, মার্থা মেকেনা, মেরী কুরি, ডোরিস লেসিং, নোরা বেকার, অরুন্ধতী রায়, প্রীতিলতা সবাই যেন স্রোতের বিপরীতে জয় করবার এক একজন মহা প্রতিভূ। অমঙ্গল বিনাশের হাতিয়ার। আর নতুন সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের অজেয় কংক্রিট। এক বিরাট বিপুল অবিনশ্বর অন্তর্নিহিত শক্তি।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী, কবি
এইচআর/পিআর