বড়াইগ্রাম ট্রাজেডি : হতাহতের পরিবারে এখনো চলছে হাহাকার
আজ ২০ অক্টোবর। বড়াইগ্রাম ট্রাজেডি দিবস। গত বছরের এই দিনে নাটোরের বড়াইগ্রামের রেজুর মোড়ে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে ঘটে যাওয়া দেশের সবচেয়ে ভয়াবহতম মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় ৩৮ প্রাণের অকাল মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকী আজ। আজ নাটোরের মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের দিন। কালের স্রোতে একটি বছর হারিয়ে গেলেও থামেনি স্বজনহারা মানুষের কান্না। বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুরের বাতাসে আজো কান পাতলে শোনা যায় সে কান্নার শব্দ।
নিহতদের বিধবা স্ত্রী, এতিম সন্তান, বাবা-মা এখনো স্বজনের শোকে অশ্রু বিসর্জন দেন, কেউ বা শোক চাপতে না পেরে বিলাপ করে কাঁদেন প্রিয়জনের জন্য। দুর্ঘটনায় নিহতদের ফ্রেমে বাঁধা ছবিই এখন স্বজনদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর গত এক বছরে ৫৫ কিলোমিটার এই মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আরো ১১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সরেজমিনে বড়াইগ্রামের ইকড়ি গ্রামে গেলে এই গ্রামের নিহত মশিউর রহমান মণির সহধর্মিণী রিমা একমাত্র সন্তান রিয়াদকে কোলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘মণির আশা ছিল ছেলের। কিন্তু আল্টাসনোগ্রাফির রিপোর্টে বারবার মেয়ে হবে বলে জানিয়েছিলেন ডাক্তারেরা। অবশেষে আল্লাহ ছেলে সন্তানই দিলেন, কিন্তু ছেলের বাবাই তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এখন সে সন্তানের মাঝেই প্রিয় স্বামীর অস্তিত্বকে খুঁজি।
একই বাবার সাত ছেলের মধ্যে একমাত্র বেঁচে যাওয়া গুরুদাসপুরের শিধুলী গ্রামের আহত আব্দুর রহমান কান্না চাপতে চাপতে বলেন, একসঙ্গে সাত ভাই বাসে করে বাড়ি ফিরছিলাম। মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমার ছয় ভাইকে কেড়ে নিয়ে আহত অবস্থায় আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের বিধবা স্ত্রী আর এতিম সন্তানদের কান্না আমার বুকের পাঁজর যেন ভেঙে ফেলতে চায়। সাত ভাইয়ের একমাত্র বোন আনোয়ারা নিহত ভাইদের রেখে যাওয়া কাপড়-চোপড় বুকে জড়িয়ে আজো গুমড়ে গুমড়ে কাঁদেন। এভাবেই নিহত ৩৮ জনের স্বজনেরা তাদের স্মৃতিতে খুঁজে বেড়ান হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের।
সেদিনের বিভীষিকার কথা স্মরণ করে আজো আঁতকে উঠেন সবাই। অবিরাম কান্নায় ভেঙে পড়েন কেউ কেউ। চলনবিলের এই জনপদের বিভীষিকাময়, বিষাদময় শোকাবহ একটি নির্মম অধ্যায়-বড়াইগ্রাম ট্রাজেডি। যেখানে সান্ত্বনা দিতে ছুটে গেছেন সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ। এসেছেন দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকরা। সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি, আল জাজিরা, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও তেহরানসহ পৃথিবীর সব বড় বড় গণমাধ্যম। কয়েক দিন দেশের প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়ে দাঁড়ায় এই ঘটনা।
বিভীষিকাময় সেই ঘটনা ২০১২ সালে গ্রামে গুরুদাসপুরের শিধুলী গ্রামে দু`গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে শাহজাহান গ্রুপের ডা. ইয়ারুল ও আমির হোসেন খুন হন। তখন মোহাম্মদ এহিয়া বাদী হয়ে শাহজাহান গ্রুপের মোট ৪৬ জনের নামে মামলা করেন। সে মামলায় ২০ অক্টোবর নাটোর কোর্টে হাজিরা দিয়ে অথৈ পরিবহনে বাড়ি ফিরছিলেন তারা। এছাড়া জেলা শহরে বিভিন্ন কাজ শেষে অনেকেই এ বাসে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে দুপুর আড়াইটার দিকে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের বড়াইগ্রামের রেজুর মোড়ে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী কেয়া পরিবহনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে।
বাসের ছাদে থাকা মানুষেরা ছিটকে পড়েন মহাসড়কসহ বাসের চারপাশে। একই সময়ে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী দ্রুতগতির হানিফ পরিবহন নামে যাত্রীবাহী একটি কোচ না থামিয়ে মহাসড়কে ছিটকে পড়া আহতদের উপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেয়ায় নিহতের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। খুব তাড়াতাড়ি স্বেচ্ছাসেবী মানুষেরা এগিয়ে আসেন, ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস টিমসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গোটা মহাসড়ক যেনো লাশের স্তুপ। একে একে উদ্ধার করা হলো অথৈ পরিবহণের চালকসহ ৩৬ জনের লাশ।
এছাড়া দীর্ঘ সময় হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চির বিদায় নিলেন এক স্কুল শিক্ষকসহ আরো দুজন। সব মিলিয়ে অজ্ঞাত একটিসহ ৩৮টি তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে রচিত হলো মর্মান্তিক বড়াইগ্রাম ট্রাজেডি। দুর্ঘটনার ১০ দিন পর কেয়া পরিবহনের চালক ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার আনসার আলীর ছেলে নাজিমউদ্দিনকে (৫০) গ্রেফতার করে পুলিশ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চালক নাজিমউদ্দিনকে আটক করা হয়। কয়েক দিন পরই তিনি জামিন পান। অপর বাস অথৈ পরিবহনের চালক আলম ঘটনাস্থলেই মারা যান।
দুই উপজেলায় কান্নার রোল
দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে দুজন বাদে সবাই জেলার বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে সর্বাধিক ১৪ জন নিহত হয়েছেন শিধুলী গ্রামে। আহতদেরও প্রায় সবাই এই গ্রামেরই। অবশিষ্ট আহতদের বেশির ভাগই এ দুই উপজেলার বাসিন্দা। একসঙ্গে এতো লাশ ও এতো আহতদের নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ যেমন দিশেহারা হয়ে পড়েন, ঠিক তেমনি গোটা এলাকায় শোকের মাতম শুরু হয়ে যায়। চারদিকে শুধু কান্নার রোল ভেসে ওঠে। স্বজন হারানোর আচমকা সংবাদে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা এলাকা।
নিহতদের তিনজনের অনুদানের পুরো টাকা মেলেনি
দুর্ঘটনার তিন দিনের মাথায় সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদ হলরুমে নিহতদের পিতা ও স্ত্রীর হাতে এক লাখ টাকার সরকারি অনুদানের চেক তুলে দেন। এ চেক নিহতের স্ত্রী ও বাবার যৌথ নামে ইস্যু করা হয়। কিন্তু নিহতদের মধ্যে শিধুলী গ্রামের শরিফুল ইসলাম, আজাদ শেখ এবং সোনাবাজু গ্রামের হানিফের পিতা মৃত হওয়ায় তাদের স্ত্রীর নামে ইস্যু হওয়া ৫০ হাজার টাকার চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উঠাতে পারলেও মৃত বাবার নামে ইস্যু হওয়া অবশিষ্ট ৫০ হাজার টাকার চেক দিয়ে টাকা তোলা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে সংশোধিত চেক প্রদানের জন্য মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানালেও এ পর্যন্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।
এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি যারা
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত তেলটুপী গ্রামের সাবিনা আক্তার (৩২) ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত জানেন না তার একমাত্র আদরের ধন সেবা (৫) ও ছোট ভাই মণি (২৫) আর বেঁচে নেই। ছোট ভাই মণিকে নিয়ে নাটোরে মেয়ে সেবাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পথে দুর্ঘটনায় ছোট ভাই ও একমাত্র মেয়েকে চিরতরে হারান তিনি। নিজেও গুরুতর আহত হন। দীর্ঘ এক বছর ঢাকা সিএমএইচসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েও এখনো সুস্থ নন তিনি। মাঝে মাঝেই স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। যখন কিছুটা স্বাভাবিক হন তখন জানতে চান মেয়ে ও ভাইয়ের কথা। কিন্তু সহ্য করতে পারবেন কিনা সে ভয়ে এক বছর ধরেই তার স্বজনেরা মেয়ে ও ভাইয়ের মৃত্যুর কথা গোপন রেখেছেন প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন সাবিনার কাছ থেকে। শিধুলী গ্রামের ইউনুস আলীর (৪৫) মেরুেণ্ডের হাড় ভেঙে যায় দুর্ঘটনায়। ভারতের চেন্নাইসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি বিক্রি করে আট লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েও কোনো কাজ হয়নি। বর্তমানে হুইল চেয়ারই তার একমাত্র ভরসা। একই গ্রামের কৃষক ফারুক আহম্মেদের (৩৭) ডান হাত ভেঙে যায়। শরীরের আরো বিভিন্ন স্থানে আঘাত রয়েছে তার। গত এক বছরেও সুস্থতার মুখ দেখেননি তিনি। গত ১৩ অক্টোবর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আবারো তার অপারেশন করা হয়েছে। ফারুক, ইউনুস, সাবিনার মতো এমন আরো ১০-১২ জন এখনো তাদের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন দুর্ঘটনার তাজা ক্ষত।
দুর্ঘটনায় না ফেরার দেশে যারা
দুর্ঘটনার পর নাটোর জেলা প্রশাসনের প্রকাশিত নিহত ৩৭ জন হলেন গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার পাইকপাড়া গ্রামের হাফিজুর রহমান (৫৫), নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড়ের রেজাউল (৪৫), গাড়িষাপাড়ার আবুল খায়ের (৫৫), উত্তর নাড়ীবাড়ির আলম (২৮), সিধুলী গ্রামের ময়েজ উদ্দিনের ছয় ছেলে যথাক্রমে আতাহার আলী (৬৫), রায়হান (৬৫) রব্বেল আলী (৬০), সোহরাব (৫৭), সহির (৪২), কহির (৩৮) একই গ্রামের আয়নাল (৩৫), ইবাদ আলী (৬৫), লাবু (৩০), শরীফ (৩০), তোফাজ্জ্বল ওরফে কিনু (৩২), আলাল (৫৫), শাহিন আলম ওরফে বাহাদুর (৩০), আজাদ আলী শেখ (৫৫), একই উপজেলার পাটপাড়া গ্রামের জাফর (৫৫), সোনাবাজু গ্রামের হানিফ শেখ (২৯), পুঠিমারি গ্রামের প্রভাষক রেজাউল হক (৪৫), তেলটুপি গ্রামের ফাতেমাতুজ্জোহরা (৮), রানী গ্রামের বাবুল আক্তার বাবলু (৪০), জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার সংগ্রামপুর গ্রামের আব্দুর রহমান (৫৫), তার স্ত্রী আরিফা (৪৫), বাজিতপুর গ্রামের কিসমত আলী (৫৫) ও আয়নাল (৩২), বড় পিঙ্গুইন গ্রামের মুক্তিযোদ্বা আব্দুল কুদ্দুস (৬৬), খোকসা গ্রামের শ্রী কৃষ্ণপদ (৫৬), জোনাইলের রহমত আলী (৫০), ইকরি গ্রামের মশিউর রহমান মনি (২৫) ও তার ভাগ্নী সেবা (৫), তারানগর গ্রামের কলেজ শিক্ষক জামাল উদ্দিন (৩৮) ও তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস (৪), চামটা গ্রামের জান মোহাম্মদ মাষ্টার (৫৫) এবং ফেনীর ফুলগাজী থানার বড়াইয়া গ্রামের বীরেন্দ্র কিশোর তিলকের ছেলে শৈলেন তিলক (৪০)। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বড়াইগ্রামের চকপাড়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক আজাদুল বারী (৩৫)।
দুর্ঘটনাস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি
দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার স্থানটি এখনও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন দেখতে আসেন। কিন্তু এতো বড় একটি ঘটনা ঘটলেও এখানে স্মৃতি হিসেবে কোনো নিদর্শন তৈরি করা হয়নি। এলাকাবাসী দুর্ঘটনাস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
মিলাদ মাহফিল ও মানববন্ধনের আয়োজন বড়াইগ্রামের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে স্থানীয় লোকজন মঙ্গলবার সকালে রেজুর মোড়ে, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও মানববন্ধন পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
রেজাউল করিম রেজা/বিএ