পুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতেই তিনটি অলিম্পিক গেমস মাতিয়েছেন ডলি

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৪:১৮ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২০

পাঁচ নম্বর লেনের সাঁতারু সবাইকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেলেন গন্তব্যে। ফিনিশিং মার্ক ছুঁতেই অ্যাথেন্স অলিম্পিক অ্যাকুয়াটিক সেন্টারের স্ক্রিনে ভেসে উঠল বড় এক মুখ। লেখা ডলি আক্তার, বাংলাদেশ। প্রথম হয়েছেন লাল-সবুজের দেশের এই নারী সাঁতারু। পোশাক বদলের পরই ডলি আক্তারকে ঘিরে ধরলেন কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী। অ্যাকুয়াটিক সেন্টারের গ্যালারি থেকে অনেকের কৌতূহল দৃষ্টি। কী করেছেন বাংলাদেশের এই সাঁতারু?

সাঁতারুর ও দেশের নামের পাশাপাশি ভেসে উঠেছিল টাইমিংও। ৩০.৭২ সেকেন্ডে ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল শেষ করে ডলি আক্তার ৭৩ জন সাঁতারুর মধ্যে হয়েছিলেন ৬১তম। তাহলে তাকে নিয়ে এত হইচই কেন? আসলে অলিম্পিক গেমসে প্রথম হওয়া বলে কথা। ডলি প্রথম হয়েছিলেন ১ নম্বর হিটে। স্বাভাবিকভাবে তার ছবিটি ভেসে উঠেছিল জায়ান্ট স্ক্রিনে নাম, দেশ ও টাইমিংসহ।

২০০৪ অ্যাথেন্স অলিম্পিকে এক কথায় ওটাই ছিল বাংলাদেশের জন্য একটা আনন্দের মুহূর্ত। ৬-৭ জন বাংলাদেশি মিডিয়াকর্মীর মধ্যে আমিও ছিলাম সেখানে। সাঁতার শেষে বাংলাদেশের মিডিয়াকর্মীরাই প্রতিক্রিয়া নিয়েছিলেন ডলির। বাংলাদেশের কোনো প্রতিযোগীর জন্য হিটে প্রথম হওয়াটাও কি কম!

জয়-পরাজয় নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা- বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা অলিম্পিকে অংশ নেন এ মন্ত্র বুকে ধারণ করেই। সেখানে কেউ হিটে প্রথম হয়ে ক্ষণিকের আনন্দ দিলে সেটা তার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকারই কথা।

‘২০০৪ সালের আগস্ট মাসে গ্রিসের ওই সময়টার কথা কখনওই ভুলব না। আপনারা মিডিয়ার ভাইরা, অলিম্পিক ও সাঁতার ফেডারেশনের কর্মকর্তারা সাঁতার শেষে আমাকে সাবাশ সাবাশ বলেছিলেন। যদিও পারফরম্যান্স কিছুই ছিল না। হিটের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলেছিলাম আর টাইমিং ভালো হয়েছিল মাত্র; কিন্তু আমার তিন অলিম্পিকের মধ্যে ওই মুহূর্তটাই বেশি স্মরণীয়’- সোমবার দুপুরে রাজবাড়ী থেকে বলছিলেন বাংলাদেশ আনসারের এই সাঁতারু।

ক্যারিয়ারের শুরুতে ভাল পারফরম্যান্স করার পর কোন ক্রীড়াবিদকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? বেশিরভাগই বলেন- অলিম্পিক। অর্থাৎ অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়া একজন ক্রীড়াবিদের আজন্ম স্বপ্ন।

ডলি আক্তার সেই স্বপ্নপূরণ করেছিলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে অংশ নিয়ে। এরপর ২০০৪ সালে অ্যাথেন্স এবং ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক। তিনটি অলিম্পিকে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য এখন পর্যন্ত ডলি আক্তারেরই। সারাজীবন গল্প করার রসদ যে হয়ে গেছে এই জলকন্যার!

Dolly-2.jpg

অলিম্পিক গেমস ক্রীড়া দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আসর। দুনিয়ার সব সেরা ক্রীড়াবিদদের মিলনমেলা। এ কারণেই বলা হয়, দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। মাত্র ১৪ বছরের এক কিশোরীর জন্য যে গেমসের পুল ছিল সমুদ্রের মতোই। তাই তো সিডনিতে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে অংশগ্রহণকারী হয়েও সাঁতরানো হয়নি তার, হয়েছিলেন ডিসকোয়ালিফায়েড।

কীভাবে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়েছিলেন? সেই তেতো স্মৃতি আজও ভোলেননি ডলি, ‘আমি তখন অনেক ছোট। সাঁতার শুরুর পর দর্শকদের মধ্যে থেকে কয়েকবার বাঁশির আওয়াজ আসছিল। তাতে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। পরে কেঁদেছিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আবার যখন খেলব এ বিষয়টা মনে রাখবো। এরপর আমি আর কখনও ডিসকোয়ালিফায়েড হইনি।’

ডলি আক্তারের ফেসবুক আইডি ‘জল কন্যা’। তিনি আসলেও তাই। ঘরোয়া সাঁতারের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে দুইশ’র বেশি পদক আছে তার। তিনটি অলিম্পিক ছাড়াও অংশ নিয়েছেন চারটি সাফ (এসএ) গেমস, দুটি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, একটি এশিয়ান গেমস, একটি কমনওয়েলথ গেমস ও ইন্দো-বাংলা গেমসের তিনটি আসরেই। সপ্তম বাংলাদেশ গেমসের ৯ ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৯টিতেই স্বর্ণ জিতেছিলেন নতুন জাতীয় রেকর্ডসহ। অষ্টম বাংলাদেশ গেমসে একটি ইভেন্টে খেলে সেরা হয়েছিলেন ডলি।

বাংলাদেশ আনসারের ডলি আক্তারের নতুন পরিচয় ভলিবলের ডলি হিসেবে। এক সময় সাঁতারের পাশাপাশি ভলিবল খেলতেন। তবে সাঁতারই ছিল তার প্রধান নেশা। ২০১৬ সালের পর সাঁতারের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ আর খেলেননি। পুরোদমে মনসংযোগ করেন ভলিবলে। তিনি এখন জাতীয় ভলিবল দলের খেলোয়াড়। গতবছর নেপালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে অংশ নিয়েছেন ভলিবল দলের সদস্য হয়ে। ক্রীড়াবিদ হিসেবে এটি ডলির পঞ্চমবার সাউথ এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ।

ডলি আক্তার রাজবাড়ী সদরের মেয়ে। বাবা মো. রওশন আলী ও মা আমেনা বেগম। দুই ভাইবোন তারা। ছোট ভাই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পরিবারের অন্য কেউ খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও ডলি ছোট সময় থেকেই খেলার নেশার মধ্যে ছিলেন। সাঁতারের প্রতি তার আলাদা টান ছিল।

Dolly-2.jpg

রাজবাড়ী স্টেডিয়ামের পাশের পুকুরে সাঁতরাতে চলে যেতেন বাবাকে না জানিয়ে। দাদিকে সঙ্গে নিতেন। নাতনির সাঁতার দেখে ভালো লাগত আনিসা খাতুনের। ডলির বাবা-মাকে তিনি বলতেন, ‘আমার নাতনির সাঁতার ভালো লাগে, সে সাঁতার কাটবে।’

রাজবাড়ীর ওই ‘স্টেডিয়াম পুকুর’ থেকে সাঁতার কাটা শুরু করা ডলি একসময় হয়ে যান দেশসেরা নারী সাঁতারু। তিন-তিনটি অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়া বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়েন নতুন ইতিহাস। বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেন। নিজ জেলা রাজবাড়ী ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আনসারের সুনাম বয়ে আনেন।

‘একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে আমার এটা বিশাল অর্জন। অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়া মানেই বিশ্বের বড় বড় তারকার সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা বলা। তারকা ক্রীড়াবিদদের এতটা কাছ থেকে দেখার, কথা বলার ভাগ্য কেবল অলিম্পিক খেললেই হয়। আমি ক্যারিয়ারের এ সাফল্যের জন্য আমার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আনসারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার দাদিকেও মনে পড়ে, যার হাত ধরে স্টেডিয়ামের পুকুরে চলে যেতাম সাঁতরাতে। বাবা-মা প্রথম উৎসাহ না দিলেও পরে আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন’- বলছিলেন বাংলাদেশের জলকন্যা ডলি আক্তার।

আরআই/এসএএস/আইএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।