গর্ভবতী ইঁদুর গবেষণা করে জাবি শিক্ষকের বিস্ময়কর আবিষ্কার
গর্ভবতী ইঁদুরকে সিসা খাইয়ে তার বাচ্চাদের মস্তিষ্কের উপর সম্প্রতি গবেষণা চালিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন। গবেষণার ফলাফল থেকে বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
‘মায়ের দুধের মাধ্যমেও শিশু শরীরে সিসা প্রবেশ করতে পারে’ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন।
আর্সেনিকের মত সিসা কি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মারাত্মক একটা ঝড় বইয়ে নিয়ে আসবে? সিসা প্রাণিদেহে বা আমাদের মা ও শিশুদের কিভাবে ক্ষতি করে?
এমন প্রশ্নের উত্তরে গবেষক জানান, ‘বাংলাদেশের অসংখ্য মা ও শিশুর দেহে সিসার মাত্রা WHO এর নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের খাদ্যদ্রব্যে সিসার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। শিশু ইঁদুরের মস্তিষ্কের উন্নতি সম্পর্কিত অতি জরুরি কিছু প্রোটিন যেমন SNAP-25, PSD-95, BDNF, TrKB, ChAT এর ওপর সিসার ইফেক্ট (প্রতিক্রিয়া) নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সিসা এই প্রোটিনগুলোর পরিমাণ কমিয়ে দেয়’।
এই প্রোটিনগুলোর কাজ কি বা মস্তিষ্কে এগুলোর পরিমাণ কমে গেলে আমাদের কি সমস্যা হতে পারে?
এ সম্পর্কে ড. হোসেন বলেন, ‘মাতৃগর্ভে ভ্রুণ যখন বড় হতে থাকে তখন মস্তিষ্কের কোষ বা নিউরনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। নিউরনের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপন বা সিনাপ্টোজেনেসিও বাড়তে থাকে। দুটি নিউরনের আন্তঃসংযোস্থলকে সিনাপ্স বলা হয়। নিউরন সংযোগ ব্যবস্থায় প্রথম নিউরনকে বলা হয় প্রি-সিনাপ্টিক নিউরন এবং দ্বিতীয় নিউরনটিকে বলা হয় পোস্ট-সিনাপ্টিক নিউরন। প্রি-সিনাপ্টিক নিউরন থেকে নিউরোট্রান্সমিটার নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ সিনাপ্সে নিঃসরণের মাধ্যমে পোস্ট- সিনাপ্টিক নিউরনগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয় যাকে নিউরোট্র্যান্সমিশন বলে। আর নিউরনগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন মানেই আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ শুরু হওয়া যা দ্বারা আমরা আমাদের সমস্ত শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালনা করে থাকি, একইভাবে আমরা আমাদের জাগতিক আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনা ধারনা প্রজ্ঞা, বিদ্যাবুদ্ধি বা অতীত ধরে রাখি (স্মৃতিশক্তি), বর্তমানের সমস্ত কাজ সম্পন্ন করি বা বা ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে থাকি। আমাদের কষ্ট আমাদের ভালবাসা বা ঘৃণাবোধ, অপরের কষ্টে বা প্রয়াতঃ প্রিয়জনদের বেদনায় বেদনাহত হয়ে আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হওয়া ইত্যাদি সমস্তকিছু মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর ক্রিয়াকলাপের জন্যই হয়। এভাবেই আমরা একটা বুদ্ধিদীপ্ত মানব। SNAP-25 থাকে প্রি-সিনাপ্টিক নিউরনে আর PSD-95 থাকে পোস্ট-সিনাপ্টিক নিউরনে। মস্তিষ্কের নিউরনে SNAP-25 প্রোটিনটি ক্যালসিয়ামের সহযোগিতায় নিউরোট্র্যন্সমিটার নিঃসরনের মাধ্যমে নিউরোট্র্যন্সমিশন ঘটায়, আর এই ঘটনাই হলো মস্তিষ্কের সমস্ত ক্রিয়াকর্মের চাবি কাঠি।
PSD-95 প্রোটিনটি শেকলের রশির মত পোস্ট-সিনাপ্টিক নিউরনে অবস্থিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন যেমন TrKB কে বেঁধে রেখে সিনাপ্সের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি করে নিউরোট্র্যন্সমিশন ঘটায়। BDNF নিউরনের জন্য একটা টনিকের মত কাজ করে অধিকতর সিনাপ্টোজেনেসিস ঘটায়। AchT প্রোটিনটি থলের মধ্যে নিউরোট্র্যান্সমিটার স্টোর করতে সহায়তা করে। ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট এর সময় মস্তিষ্কের ভেতর লেড ঢুকে পড়লে ক্যালসিয়ামের (Ca2+) জায়গাটা সে (Pb 2+) দখল করে নেয়। যত বিপত্তি এখানেই।
SNAP-25, PSD-95, BDNF, TrKB, ChAT প্রোটিনগুলোর স্বাভাবিক কাজের বাধাসহ এগুলোর পরিমাণও কমিয়ে দেয়। ফল দাঁড়ায়- ভ্রণাবস্থা থেকে শুরু করে জন্মের পরও প্রাণির মস্তিষ্কে মোট সিনাপ্টোজেনেসিস বা সহজ ভাষায় নিউরোনাল নেটওয়ার্ক-এর পরিমাণ কমে যায়। আপনি জানেন, স্বল্প বা কম নেটওয়ার্ক মানেই কম তথ্যের ভাণ্ডার বা কম তথ্যের আদান প্রদান। আরো সহজ ভাষায়, ব্যাপারটাকে কম RAM যুক্ত কম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যা দ্বারা অধিক কাজ করা সম্ভব নয়। কম্পিউটারে RAM কম হলে এম.এস ওয়ার্ড অ্যাপ্লিকেশন খুললে ফটোশপ অ্যাপ্লিকেশনে কাজ করা যায় না। ফটোশপ অ্যাপ্লিকেশন বন্ধ না করে আবার থ্রিডি ম্যাক্সে কাজ করা যায় না। কম্পিউটারে যত বেশি RAM যুক্ত হবে ততো বেশি কাজ করা যায়। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে- এতে যতবেশি নিউরোনাল নেটওয়ার্কিং (সিনাপ্টোজেনেসিসের মাধ্যমে) হবে এর দ্বারা ততো বেশি কাজ করানো যাবে। মানুষের মস্তিষ্কে লেড ঢুকে পড়লে তার কগনিটিভ পাওয়ার বা জ্ঞানীয় শক্তি যেমন বুদ্ধিপ্ততা বা আই কিউ বা স্মৃতিশক্তি কমে যাবে। যা সুস্থ পরিপূর্ণ মস্তিষ্ক গঠনে ভীষণ অন্তরায় হয়ে স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন স্বাস্থ্যবান মানুষ হয়ে উঠার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে ওঠতে পারে।
ডেভলেপমেন্টের সময় SNAP-25, PSD-95,BDNF, TrKB, ChAT প্রোটিনগুলোর অন্যতম কাজ হলো ব্রেইনের নিউরোনাল নেটওয়ার্কিং সৃষ্টি করা, যার অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে মিমোরি বা স্মৃতি ধরে রাখা`।
সিসা আর কি ধরনের ক্ষতি করতে পারে?
গবেষক জানান, ‘মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় ভ্রুণের মস্তিষ্কের নিউরনের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস/ ফোর্স্ড অ্যাপোপটসিস (জোরপূর্বক সেল সুইসাইড বা আত্মহননে প্ররোচিত করা) ঘটিয়ে মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতে পারে। ফলস্বরুপ,দীর্ঘস্থায়ীভাবে লেড গ্রহণ করলে কম মেধাসম্পন্ন মস্তিষ্কের উদ্ভব হবে। দরিদ্রপিড়ীত একটা দেশের অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের লেডের বিষাক্ত প্রভাবের ভেতর নিমজ্জিত রেখে আমরা একটা জ্ঞানশীল তরুণ সমাজ আশা করতে পারি না’।
মায়ের দুধের মাধ্যমে কি লেড বা সিসা শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে?
এর জবাবে অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমরা মা-ইঁদুরের দুধ সংগ্রহ করে এর লেড মেপে দেখেছি দুধের মাধ্যমেও শিশু শরীরে প্রবেশ করতে পারে। মায়ের স্তনকোষে ইনফ্লেমেশন বা নেক্রোসিস ঘটিয়ে দুধের মধ্যে টিউমার নোক্রোসিস ফ্যাক্টর- আলফা (TNFα) এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। TNFα যুক্ত দুধ পান করলে শিশুর মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস নামক অংশটির ভীষণ ক্ষতি হয়। উল্লেখ্য মস্তিষ্কের এই হিপ্পোক্যাম্পাস-অংশটিই মানুষ বা প্রাণির স্মৃতির সৃষ্টি এবং তা সংরক্ষণের আধার হিসেবে কাজ করে’।
সিসা মায়ের শরীরে কি ক্ষতি করতে পারে? গবেষক বলেন, ‘অবশ্যই পারে। মানব বা প্রাণির শরীরে লেড উপকার করে এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। আমরা দেখেছি লেড-খাওয়া মা ইঁদুরদের বাচ্চার সংখ্যা কম হওয়াসহ প্রেগনেন্সি রেটও কম ছিল। সুতরাং সহজেই অনুমেয় মা’র শরীরে লেড ঢুকলে মায়েদের জরায়ু খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্ক বা জরায়ু ছাড়াও লেড মানুষের ফুসফুস, কিডনি বা চর্মে মারাত্মক রোগসহ ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।
আর্থসামজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে লেড পলিউয়ুশন বাংলাদেশের অন্যতম একটা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু ও মা’র সুস্বাস্থ্য একটা সুন্দর জাতি গঠনে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশের অনেক খাদ্যদ্রব্যে লেডের মাত্রা WHO এর নির্ধাারিত মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং লেডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদীভাবে এদেশের ছেলেমেয়েদের মেধাহীন একটা সমাজের হাতরাতে হতে পারে যা একটা সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন করতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে’।
এমএম/একে/এমএস