ফিরে দেখা হাসি-কান্নার ২৬ দিন
ধবধবে সাদা চাদর বিছানো ছোট একটি বেড। লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা বেডটির একপাশে সাদা কাগজের ওপরের অংশে লেখা ডিপার্টমেন্ট অব প্যাডিয়েট্রিক সার্জারি। ঠিক তার নীচেই আবার লেখা নিওনেটাল সার্জারি বেড-১। বেডটির এক কোণায় একটি হিটার সাজানো। মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়ার হাসপাতাল ত্যাগ উপলক্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে আগত মন্ত্রী, সচিব, অধ্যাপক ও গণমাধ্যম কর্মীদের সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছোট্ট এই বেডটি।
কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করতেই প্যাডিয়েট্রিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি জানান, গত ২৬ জুলাই ভোররাতে গুলিবিদ্ধ নবজাতক সুরাইয়াকে যখন মাগুরা থেকে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয় তখন এই বেডটিতেই রাখা হয়। মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ কোনো শিশুর বেঁচে থাকার ইতিহাসের অংশ হিসেবে স্মৃতিময় এ বেডটি তারা রেখে দিয়েছেন।
সেদিন মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে গ্রহণ করেছিলেন থিসিস পার্ট এর চিকিৎসক ডা. ছাদরুদ্দীন আল মাসুদ। সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে ডা. মাসুদ জানান, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শিশুটিকে যখন ওয়ার্ডে আনা হয় তখন তার শরীর ঠান্ডা ছিল, ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজে বাধা থাকলেও সেখান থেকে রক্ত ঝরছিল।
মাতৃগর্ভ থেকে বাইরের পরিবেশে আসার পর শিশুর শরীর খাপ খাওয়াতে হলে তাকে মাতৃগর্ভের মতো তাপমাত্রার ব্যবস্থা করতে হয়। এজন্য প্রথমে তুলা দিয়ে সারা শরীর মুড়িয়ে দেয়া হয়। হিটারের সাহায্যে গরম তাপমাত্রা তৈরির প্রয়োজন হলেও সে সময় অন্য একজন রোগীর কাছ থেকে ধার নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। তার শরীরে স্যালাইন দেয়া হয়।
এ সময় কর্তব্যরত নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে সিনিয়র অধ্যাপকরা এসে চিকিৎসা কাজে যোগ দেন। গত ২৬ দিনের চিকিৎসাকালে সুরাইয়াকে হাসপাতালের সকলেই আপন করে নিয়েছিলেন। হাসপাতালের একাধিক স্টাফ সুরাইয়াকে রক্তদানও করেছেন।
জম্মের পর থেকে হাসপাতালেই কেটেছে সুরাইয়ার ২৯ দিনের ক্ষুদে জীবন। ২৩ জুলাই রাতে মাগুরা সদর হাসপাতালে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সে ভূমিষ্ঠ হয়। গুলিবিদ্ধ থাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ২৬ জুলাই তাকে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পরবর্তীতে ডা. কানিজ হাসিনা শিউলির নেতৃত্বে একটি দল তার বুকের সামনে-পিছনে, বুকে ও গলার ক্ষতে এ অস্ত্রোপচার করেন। তার শরীরে মোট ২১টি সেলাই পড়ে। অস্ত্রোপচার টিমে ছিলেন অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. শফিকুল আলম, ডা. নাজমুস সাকিব ফেরদৌস ও ডা. ছাদরুদ্দীন আল মাসুদ।
ইনফেকশনের আশঙ্কায় তাকে পরে নিওনেটাল স্পেশাল বেবিকেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে সুরাইয়ার জন্ডিস ধরা পড়ে। চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্টাফদের আন্তরিক সেবায় সকল বিপদ কাটিয়ে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবে একজন নবজাতকের ওজন কমপক্ষেস দুই হাজার ৫০০ গ্রাম হলেও জন্মের সময় তার ওজন ছিল মাত্র এক হাজার ৮৫০ গ্রাম। আজ রিলিজের সময় তার ওজন ছিল দুই হাজার ৪৫০ গ্রাম।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি বলেন, জন্মের পর সুরাইয়া প্রায় ১০ মিনিট কাঁদেনি। ওই সময় শ্বাস-প্রশ্বাসও নেয় সে। চিকিৎসকরা কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করেন। জন্মগতভাবে তার হৃদপিণ্ডে ছিদ্র ছিল। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক যেকোনো নবজাতকের চেয়ে তার জন্ম অনেক আগে হয়েছে, ওজনও ছিল অনেক কম। তিনি বলেন, উচ্চমাত্রায় সংক্রমনের ঝুঁকি থাকলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ সুরাইয়া।
শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবদুল হানিফ টাবলু জানান, বিশ্বে ব্রাজিলসহ দুটি দেশে মাতৃগর্ভে শিশুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওই সব ঘটনায় শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে সুরাইয়ার পরিবারসহ সকলের চোখে কান্না থাকলেও আজ তারা আনন্দে খুশিতে হেসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, অধ্যাপক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গণমাধ্যম কর্মীসহ সকলেই তাদের খুশির অংশীদার হয়েছেন।
এমইউ/বিএ