জ্যাভলিনের স্বর্ণকন্যা নমিতা স্টিক হাতেও দুর্বার

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৬:০৩ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০১৮

মাখন কর্মকারের নিজের কোনো জমি নেই। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কচুবারিয়া গ্রামের এ কৃষক কাজ করেন অন্যের জমিতে। তার স্ত্রী চায়না কর্মকার গৃহিনী। বয়স ৭৫, এখন আর আগের মতো খাটতে পারেন না ৫ সন্তানের জনক মাখন। টুকটাক কৃষিকাজের আয়ে টানাটানির সংসার। সেই আয়ের সঙ্গে কিছু যোগ করেন তার সেজো মেয়ে নমিতা। এ দুই জনের আয় মিলেই কোনোমতে চলে মাখন-চায়না দম্পতির সংসার। অনেকটা 'নুন আনতে পান্তা ফুরানো'র মতো।

মাখন-চায়না দম্পতির তৃতীয় সন্তান নমিতা কর্মকার। বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। নমিতাদের সংসারে এখন তার ছোট ভাই-বোন এবং বাবা-মা। পরিবারের অন্য কেউ খেলাধুলায় সম্পৃক্ত না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই নমিতার একটা ঝোঁক ছিল খেলায়। শুরু করেছিলেন ফুটবল দিয়ে। অ্যাথলেটিক হয়ে এখন হকিতে। হকি স্টিক হাতেই তিনি হয়ে গেছেন ইতিহাসের অংশ। দেশের নারী হকি যে ইতিহাস গড়েছে ভারতের মেয়েদের বিরুদ্ধে ৩ ম্যাচ সিরিজ ২-১ এ জিতে, সেই দলের সদস্য নমিতা। দুই ম্যাচে ঢাকা একাদশের করা ৫ গোলের দুটিই এসেছে নমিতার স্টিক থেকে।

লোহাগড়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবেন নমিতা। এই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক দিলীপ চক্রবর্তীর হাত ধরেই খেলাধুলায় আসা তার। ২০১২ সালে মেয়েদের স্কুল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়েই তার স্টিক ধরা। ওই সময় ফুটবলও খেলেছেন ইন্টার স্কুল টুর্নামেন্টে। কিন্তু ফুটবলে বেশিদূর এগুনো হয়নি। নমিতার মনোসংযোগটা তখন থেকেই বেশি ছিল অ্যাথলেটিকসে।

২০১৪ সাল থেকে জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে খেলে আসছেন নমিতা। এক সময় শটপুটে অংশ নিলেও তার প্রিয় ইভেন্ট জ্যাভলিন থ্রো। এখন শুধু জ্যাভলিনই খেলেন। ২০১৭ সালে এ ইভেন্টে রৌপ্য জয়ের পর এ বছর রেকর্ড করে পেয়েছেন স্বর্ণ। এক বছরের ব্যবধানে তিনি দূরত্ব ৩৩.০০ থেকে বাড়িয়ে করেছেন ৩৬.৩৬ মিটার। রেকর্ড গড়ার মাধ্যমেই তিনি হয়ে উঠেন অ্যাথলেটিকসের পরিচিত মুখ।

দেশের নারী ক্রীড়াঙ্গন এবার নতুন করে চিনলো নমিতা কর্মকারকে। মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে কলকাতা ওয়ারিয়র্স অ্যাথলেটিক ক্লাবের বিরুদ্ধে ঢাকা একাদশের সিরিজ জয়ে রেখেছেন অবদান। কেবল অ্যাথলেটিকেই নয়, হকি স্টিক হাতেও তিনি দুর্বার, তা প্রমাণ করেছেন নড়াইলের কিশোরী। গোল করেছেন, করিয়েছেন। ঢাকা একাদশের সেরা পারফরমারও এ ফরোয়ার্ড।

বছর দুই হলো তিনি যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে (বিজেএমসি)। বেতন সপ্তাহে ১৯০০ টাকা। এই স্বল্প আয় থেকেই তিনি যোগান দিয়ে আসছেন সংসারের খরচের একটা অংশ। এখন নমিতার সামনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকরির হাতছানি। নড়াইল থেকে নমিতা বলছিলেন, ‘নৌবাহিনীতে আমার চাকরিটা হয়ে যাবে আশা করছি।’

jagonews

এখন মেয়েদের ফুটবলের রমরমা সময়। তাহলে ফুটবলে থাকলেন না কেন? ‘আসলে আমি ফুটবলই খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফুটবলে প্র্যাকটিসের তেমন সুযোগ পাইনি। আবার স্যাররাও বলেছিলেন ‘ফুটবলে জায়গা পাবা না’। তাই আমি অ্যাথলেটিকস আর হকিতেই মননিবেশ করি’-বলেন নমিতা কর্মকার।

এক মেয়ে একাধিক খেলায়-সে অবস্থা এখন আর নেই বাংলাদেশে। এখন মেয়েদের খেলা বেশ অগ্রসর হওয়ায় নির্দিষ্ট খেলাকেই বেছে নিতে হয়। একাধিক খেলায় অংশ নেয়ার সুযোগ কমে গেছে। তাহলে হকি না অ্যাথলেটিক ধরে রাখবেন নমিতা? ‘আমি হকি নিয়েই এখন বেশি স্বপ্ন দেখি। কারণ, মেয়েদের হকিতে এক দিন না একদিন জাতীয় দল হবেই। আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই। যদিও কোনটা খেলবো তা অনেকটা নির্ভর করবে আমার সংস্থার উপর। নৌবাহিনীতে যোগ দিলে ওই প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তেই আমাকে ডিসিপ্লিন বেছে নিতে হবে। তবে হকি আমার বেশি ভালো লাগে’-নিজের স্বপ্নের কথা বলছিলেন নমিতা।

আরআই/এমএমআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।