রাশিয়ায় প্রথম বিশ্বকাপ, অথচ অন্তরালে লেভ-ব্লখিন!
রাশিয়ায় বিশ্বকাপের পর্দা উঠতে যাচ্ছে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর। বলা হচ্ছে রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনের দেশে বিশ্বকাপ। বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিনের দেশে ফুটবলের মহা আসর। ধরা যাক এবারের স্বাগতিক রাশিয়া না হয়ে আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালি কিংবা ফ্রান্সের কোন দেশ। তাহলে কি বলা হতো?
চার বছর আগে যখন ব্রাজিলে বিশ্বকাপ হলো, তখন বলা হলো ফুটবল সম্রাট ‘কালো মানিক পেলের’ দেশে হচ্ছে মর্ত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসর। আর্জেন্টিনার দেশে বিশ্বকাপ হলে দুনিয়া জোড়া সবার মুখে শোনা যেত, ফুটবলের মহারাজা দিয়েগো ম্যারাডোনার দেশে বিশ্বকাপ।
একইভাবে ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের দেশ জার্মানিতে ফুটবলের বিশ্বআসর, কিংবা পাওলো রোসি, মালদিনি আর রবার্তো ব্যাজিওর দেশে ফুটবলযজ্ঞ, মিশেল প্ল্যাতিনি আর জিনেদিন জিদানের দেশে ফুটবলের মহাআসর বলেই জানতো সবাই।
এবার কিন্তু তা বলছে না কেউ। রাশিয়ায় প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। অথচ তেমন কোন ফুটবলারের নাম উচ্চারিত হচ্ছে না। কি করে হবে? ওপরে যেসব কালজয়ী ফুটবলারের নাম বলা হলো, তারা সবাই নিজ নিজ দেশের ফুটবলের মহানায়ক। তাদের হাত ধরেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালি কিংবা ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
নিজ নিজ দেশের বিশ্বকাপ বিজয়ের রূপকার হয়ে পেলে, ম্যারাডোনা, বেকেনবাওয়ার, রোসি-রবার্তো ব্যাজিও আর জিনেদিন জিদানরা দেশের আইকন হয়ে গেছেন। সন্দেহাতীতভাবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির গণমানুষের প্রিয় মুখ ও সবচেয়ে পছন্দের মানুষও তারাই। যাদের গোটা বিশ্ব এক নামে চেনে।
কিন্তু রাশিয়ায় ফুটবলের কোন বিশ্ব তারকা নেই বলেই তাদের নাম আসছে না। তাই বলা হচ্ছে ‘লেনিনের’ দেশে এবারের বিশ্বকাপ। আসলেই কি রাশিয়ায় তেমন বিশ্ব বরেণ্য ফুটবলার কেউ নেই? ওই দেশে কি সত্যিই কোন বড়মাপের ফুটবলারের জন্ম হয়নি? যাকে ফুটবল অনুরাগি মাত্রই এক নামে চেনেন-জানেন? একদমই হয়নি, কিংবা বিশ্বমানের কোন ফুটবলার নেই- তা বলা যাবে না।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আজকের রাশিয়ায় ক’জন বেশ ভাল মানের ফুটবলারের জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্তত দু’জন বিশ্ব নন্দিত ফুটবলারের জন্মভূমি। যার একজন ‘লেভ ইয়াসিন’। অন্যজন ‘ওলেগ ব্লখিন’।
প্রথম জন গোলরক্ষক। পরের জন স্ট্রাইকার। এর মধ্যে লেভ ইয়াসিন সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকদের অন্যতম বলে বিবেচিত। কারো কারো মতে, লেভ ইয়াসিনই সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক।
ফুটবল ইতিহাসে চারজনকে এখন পর্যন্ত সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক ভাবা হয়। সেই তালিকায় এক নম্বর নামটি লেভ ইয়াসিনের। ১৯২৯ সালের ২২ অক্টোবর জন্ম নেয়া লেভ ইয়াসিন সন্দেহাতীতভাবে ৫০ ও ৬০ দশকের এক নম্বর গোলরক্ষক বলে বিবেচিত।
সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালে টানা চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন লেভ ইয়াসিন। অসামান্য ক্ষিপ্রতা, চপলতা ও দক্ষতার কারণে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ খ্যাত লেভ ইয়াসিন ক্যারিয়ারে এমন এক দূর্লভ রেকর্ডের অধিকারি, যা আর নেই কারো। তিনি ক্যারিয়ারে ১৫০টি পেনাল্টি স্ট্রোক ফিরিয়ে দেয়ার দুর্দান্ত কৃতিত্বের অধিকারি। এ রেকর্ড অটুট এখনো। কবে ভাঙ্গবে কে জানে?
ক্লাব ফুটবলে ডায়নামো মস্কোর সাফল্যের অন্যতম রূপকার লেভ ইয়াসিন। সোভিয়েত ফুটবল লিগে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন আর সোভিয়েত কাপে তিনবার চ্যাম্পিয়ন ডায়নামো মস্কোর গোল আগলে ছিলেন লেভ ইয়াসিন। ১৯৫৬ সালে অলিম্পিক ফুটবলে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বর্ণ বিজয়ী দলের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন লেভ।
১৯৬০ সালে ইউরোপীয় ফুটবলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় পতাকাও ওড়ান এ কালজয়ী গোলকিপিং প্রতিভা। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলাকে লেভ ইয়াসিনের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে ধরা হয়। সেবার সোভিয়েত ইউনিয়েনের সেরা চারে উঠে আসার পেছনে লেভ ইয়াসিন ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়।
তার সাথে উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্যাট জেনিংস আর দুই ইতালিয়ান দিনো জফ এবং জিয়ানলুইজি বুফনকে সব সময়ের সেরা গোলকিপারের তালিকায় সবার ওপরে ধরা হয়। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফাও লেভ ইয়াসিনকে দিয়েছে অন্যরকম সন্মাননা। বিশ্বকাপে প্রতি আসরে যিনি সেরা গোলরক্ষক মনোনীত হন, তাকে যে পুরষ্কারটা দেয়া হয় তার নাম ‘লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড’। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তার নামে কয়েনও (মুদ্রা) চালু করে। আর ব্রাজিলে লেভ ইয়াসিনের মূর্তি নির্মাণ করা আছে।
এছাড়া আরও একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি ওলেগ ব্লখিন। সন্দেহাতীতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রুশ ফুটবল ইতিহাসের এক নম্বর স্ট্রাইকার।
তবে যারা খুব বেশি খুঁটিনাটি খোঁজখবর রাখেন, তারা অবশ্যই ব্লখিনকে রুশ বলে মানতে খানিক দ্বিধায় ভুগবেন। কারণ তার জন্ম ইউক্রেনে। ১৯৫২ সালের ৫ নভেম্বর ইউক্রেনের কিয়েভে জন্ম নেন ব্লখিন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে ইউক্রেন পৃথক দেশ হলেও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেরই অংশ ছিল।
১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙ্গে বেশ কিছু আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তখনই ইউক্রেন ছিটকে পড়ে। তাই অনেকেই ব্লখিনকে রুশ স্ট্রাইকার মানতে রাজি হন না। তারপরও অখন্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন আর রুশ ফুটবল ইতিহাসে সেরা ফুটবলারের তকমাটা এখনো ওলেগ ব্লখিনের গায়ে।
রাশিয়ান নামী ক্লাব ডায়নামো কিয়েভ এবং সোভিয়েত ইউনিয়েনের জার্সি গায়ে সবচেয়ে বেশি গোল করার দূর্লভ কৃতিত্বটি এখনো ব্লখিনের দখলে। ৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম চৌকশ ফরোয়ার্ড হিসেবে পরিগণিত হতেন ব্লখিন।
প্রথাগত অর্থে স্ট্রাইকার বলতে যা ভাবা হয়, ব্লখিন তেমন ছিলেন না। কখনো উইঙ্গার আর কোন কোনো সময় ফরোয়ার্ডের ভূমিকায় দেখা যেত তাকে; কিন্তু সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি তার গোল করার দক্ষতাও ছিল যথেষ্ঠ। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ক্লাব দল ডায়নামো কিয়েভের হয়ে ব্লখিন যত গোল করেছেন, তা এখনো কেউ টপকাতে পারেননি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের জার্সি গায়ে ১১২ ম্যাচে ব্লখিনের গোল ৪২টি। এর মধ্যে ১৯৮২ ও ১৯৮৬‘র বিশ্বকাপে অংশ নেয়া ব্লখিন দুই আসরেই একটি করে গোল করেন। আর ডায়নামো কিয়েভের হয়ে ব্লখিন আরও উজ্জ্বল।
তার খেলোয়াড়ী জীবনে ডায়নামো কিয়েভ দুবার ১৯৭৫ ও ১৯৮৬ সালে উইয়েফা কাপ উইনার্স কাপ বিজয়ী হয়। উভয় সাফল্যে ব্লখিন রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দুবারই ফাইনালে একটি করে গোলও করেন ওই রুশ ফরোয়ার্ড।
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের আগে ব্লখিন ছিলেন শীর্ষ দশ আলোচিত ফুটবলারের একজন। বলার অপেক্ষা রাখে না সেরা পাঁচে ছিলেন আর্জেন্টিনার দিয়েগো ম্যারাডোনা, ব্রাজিলের জিকো-সক্রেটিস, ফ্লান্সের মিশেল প্ল্যাতিনি আর জার্মানির কার্লহেইঞ্জ রুমেনিগে।
তারপরের সারিতেই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওলেগ ব্লখিন, পোল্যান্ডের বনিয়েগ আর বেলজিয়ামের অ্যাঞ্জো শিফো। পাশাপাশি আরও এক রুশ স্ট্রাইকারের নামও উচ্চারিত হওয়া উচিৎ। তিনি ইগর বেলানভ। এ রুশ স্ট্রাইকার ছিলেন ১৯৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের অন্যতম আলোচিত তারকা।
কারণ সেবার বিশ্বকাপ শুরুর মাস খানেক বেলানভের দুর্দান্ত নৈপুণ্যে কাপ উইনার্স কাপ জিতে ডায়নামো কিয়েভ। সে আসরে অসামান্য অবদান রাখায় মূলতঃ ব্যালন ডি’অর খেতাব পান বেলানভ; কিন্তু দল সাফল্য না পাওয়ায় তাদের কেউ আর নায়কের আসনে বসতে পারেননি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ফুটবলের সোনার ছেলে হয়ে ওঠা হয়নি লেভ ইয়াসিন, ব্লখিন আর বেলানভের। আসলে বিশ্বকাপ বড় নিষ্ঠুর। নির্মম। এখানে শিরোপা বিজয়ই শেষ কথা। শেষ হাসি হাসতে না পারলে নায়ক হওয়া যায় না। বরং তারকা খ্যাতি ম্লান হতে থাকে।
তাই লেভ ইয়াসিন, ওলেগ ব্লখিন আর বেলানভও নায়ক হতে পারেননি। বরং দিনকে দিন তাদের নাম ঢাকা পড়ে গেছে; কিন্তু তারপরও ইতিহাসে তাদের জন্য একটা অন্যরকম জায়গা আছে। হয়ত থাকবেও।
এআরবি/এসএএস/আইএইচএস/পিআর