লজ্জায় মরার কিছু নেই, প্রয়োজন আত্মোপলব্ধি
‘নিউজিল্যান্ড কি বাংলাদেশের চেয়ে দূর্বল বা সমান শক্তির দল? ক্রিকেট বিশ্বে ব্ল্যাক ক্যাপ্স বা কিউইদের অবস্থান কি টাইগারদের সমান্তরালে?’ পন্ডিত, বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই। শহরের গলির আর অজো পাড়া-গাঁয়ের অবুঝ কিশোরও বলে উঠবে- নাহ, তা কি করে হয়!
গ্লেন টার্নার, রিচার্ড হ্যাডলি, মার্টিন ক্রো, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আর কেন উইলিয়ামসনের দেশ নিউজিল্যান্ড কত সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী দল! বিপরীতে আকরাম, বুলবুল, নান্নু , সুজন, রফিক, সাকিব, মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহর বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখনও উঠতি শক্তি। ওপরে ওঠার সিঁড়ি হাতড়ে বেড়াচ্ছে।
ব্ল্যাক ক্যাপ্স আর টাইাগারদের অবস্থানও এক নয়। কিউইরা ক্রিকেটের পরাশক্তি। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি- তিন ফরম্যাটেই যাদের গায়ে বড় দলের তকমা আঁটা। অবস্থানগত দিক থেকেও টাইগারদের চেয়ে অনেক এগিয়ে তারা। ওপরে।
যদি তাই হয়, তাহলে ২০১০-২০১১ আর ২০১৩-২০১৪ মৌসুমে নিউজিল্যান্ড যখন পরপর দু’বার বাংলাদেশের মাটিতে টাইগারদের কাছে চরমভাবে পর্যদুস্ত ও ধবলধোলাই হয়েছিল (প্রথমবার পাঁচ ম্যাচের সিরিজ ৪-০ তে, একটি ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত, আর পরেরবার ৩ ম্যাচ সিরিজের সবকটিতে হেরে গিয়েছিল) তখন কি নিউজিল্যান্ডবাসীর ধবল-সাদা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল? কিউইরা কি হাসতে ভুলে গিয়েছিল? তাদের কোন জাতীয়, রাষ্ট্রীয় উৎসব-পার্বন মাটি হয়ে পড়েছিল?
স্মৃতি হাতড়ে এমন ঘটনা মনে করা কঠিন। ইতিহাসও তেমন সাক্ষী দিচ্ছে না। বরং নিউজিল্যান্ডবাসী ধরেই নিয়েছে, বাংলাদেশের অনভ্যস্ত কন্ডিশনে গিয়ে কিউইরা খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তাই তারা ওই হারে খানিক হতাশ হলেও লজ্জায় লাল হয়নি। ওই ‘বাংলাওয়াশকে’ জাতীয় লজ্জা বলেও ভাবেনি।
কি আশ্চর্য্য! নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের পরাশক্তি। একবারের বিশ্বকাপ রানার্সআপ (২০১৫ সালে), ছয়বার (১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৯২, ১৯৯৯, ২০০৭ ও ২০১১) বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেমিফাইনালিস্ট। এখন যেটা আইসিসি চ্যাস্পিয়ন্স ট্রফি, তার দ্বিতীয় আসর মানে আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপ (২০০০ সালে) চ্যাম্পিয়ন ও একবারের রানার্সআপ (২০০৯ সালে)।
এমন সোনালী সাফল্য যাদের সঙ্গী, সেই দেশও বাংলাদেশের কাছে পরপর দু’বার হোয়াইটওয়াশ হবার পরও লজ্জিত হয়নি। সে হারকে চরম ব্যর্থতা এবং অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য করেনি। তাদের উৎসব-পার্বন মাটি হয়ে যায়নি।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আফগানিস্তানের কাছে টি-টোয়েন্টি সিরিজে নাকাল হওয়ার পর বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষ এটাকে চরম ব্যর্থতা হিসেবে ভাবতে শুরু করছেন। শুধু চরম ব্যর্থতা ভাবলে খুব একটা সমস্যা ছিল না। কারো কারো আচরণ, কথা বার্তা- বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কটুক্তি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ দেখে মনে হচ্ছে কি জানি ‘মহাভারত অশুদ্ধ’ হয়ে গেছে। ভাবটা এমন- সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা জাত খুইয়ে ফেলেছেন। ক্রিকেটে বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে। ইমেজ বলতে আর কিছু নেই। বহির্বিশ্বে আর মুখ দেখানোর মত অবস্থাও নাকি নেই।
আমার প্রশ্ন হলো, কেন? বিষয়টাকে ওভাবে দেখার কি আছে? সহজ কথা, বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি কম পারে, টাইগাররা ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটে ভাল খেলে না, তাদের ট্র্যাক রেকর্ড খরাপ। আর আফগানিস্তান বিশ ওভারের ক্রিকেটটা ভালই খেলে। এবার আরও বেশি ভাল খেলে বাংলাদেশকে সব ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছে।
এটা অবশ্যই আফগানদের কৃতিত্ব। অর্জন, বড় সাফল্য। আর টাইগারদের ব্যর্থতা; কিন্তু তাই বলে টাইগাররা অতলে তলিয়ে গেছে কিংবা ক্রিকেটে বাংলাদেশের সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছে- এমন ভাবার কোনই কারণ নেই।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কেউ কেউ তাই ভেবে অস্থির। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনও লিখা হয়েছে, সাকিবের দল নাকি এবার ঈদটাই মাটি করে দিয়েছে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ যখন ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে আইসিসির দুই সহযোগি সদস্য কানাডা আর কেনিয়ার কাছে হেরেছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? ওই হারের চেয়েও কী এবার আফগানদের কাছে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়া বড় ঘটনা?
খালি চোখে আফগানিস্তানকে ছোট দল এবং ১৮ বছরের টেস্ট যুবা বাংলাদেশের তুলনায় ছোট কিশোর মনে হলেও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ইতিহাস-পরিসংখ্যান কিন্তু তা বলছে না। ভুলে গেলে চলবে না, ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে আফগানদের রেকর্ড টাইগারদের চেয়ে সমৃদ্ধ। তারা র্যাংকিংয়েও ওপরে। তাও শুধু বাংলাদেশের ওপরে নয়, শ্রীলঙ্কার চেয়েও এক ধাপ ওপরে।
তাহলে সেই দলের কাছে নাকাল হওয়া জাতীয় লজ্জা কেন হবে? এই ধবলধোলাই হওয়ায় ঈদ কেন মাটি হবে? আর তাতে সম্ভাবনাময় দল বাংলাদেশের ক্রিকেট সূর্য্য ডুবে গেছে, কালো মাঘে ঢাকা পড়ে গেছে- এতদুর চিন্তারও অবকাশ নেই। ১৮ বছর ধরে টেস্ট আর ৩২ বছর ধরে ওয়ানডে খেলে দল হিসেবে আফগানিস্তানের চেয়ে বয়সে ও অভিজ্ঞতায় বড় হলেও কঠিন সত্য, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ দল হিসেবে আফগানদের চেয়ে দূর্বল।
এখন দূর্বল দল সবলের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে। সব ম্যাচ হেরেছে- তাতে সব খোয়ানোর কি আছে? হ্যাঁ, এটা সত্য, সব ম্যাচ হার- একটু দৃষ্টিকটু। তাই মেনে নিতে খানিক কষ্ট হতেই পারে; কিন্তু তাই বলে এই ঘটনা যে এটাই প্রথম, তা কিন্তু নয়। ক্রিকেটে এমন নজির আছে ভুরি ভুরি। বহু বড় বড় দল আগেও ছোট দলের কাছে খাবি খাবার রেকর্ড আছে। অতীতে অনেক বড় শক্তি, তার চেয়ে দূর্বল, কমজোরি ও ছোট দলের কাছে পর্যদুস্ত হয়েছে।
এ লেখার প্রথম অংশে নিউজিল্যান্ডকে বাংলাদেশের হোয়াইটওয়াশ করার উদাহরণ টানা হয়েছে। আর এবার আসা যাক, তিন বছর আগে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বাংলাদেশের কাছে নাকাল হয়ে যাবার প্রসঙ্গ। ইতিহান জানাচ্ছে, ওই বছর বাংলাদেশ ঘরের মাঠে দারুণ সময় কাটিয়েছে। টাইগারদের দুর্দান্ত টিম পারফরমেন্সের সামনে কুলিয়ে উঠতে পারেনি র্যাংকিং আর সব হিসেব-নিকেশে এগিয়ে থাকা এবং সর্বাংশে শ্রেয়তর তিন দল ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা ২-১-এ ওয়ানডে সিরিজ হেরে দেশে ফেরত গেছে। আর পাকিস্তানীরা তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ‘বাংলাওয়াশ’ হয়েছে। একমাত্র টি-টোয়েন্টিতেও পাত্তা পায়নি। ওই তিন দেশে তীর্যক কথা-বার্তা হয়েছে। সমালোচনাও হয়েছে। তাই বলে এমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অশ্লীল ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং ‘জাতীয় লজ্জা ও ঈদ মাটি’ হয়ে যাবার মত কথা শোনা যায়নি।
আসলে এমন আচরণ ও কথাবার্তা সমর্থকদের নেহায়েত বাড়াবাড়ি। ক্রিকেটে এমন হয়। আর একটা জায়গায় ভুল করছেন অনেকেই। তাহলো, বাংলাদেশ ওয়ানডে এমনকি টেস্টের চেয়েও টি-টোয়েন্টিতে দূর্বল, কমজোরি ও সর্বোপরি অকার্যকর দল। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সাফল্যের পূর্ব ও অত্যাবশ্যকীয় যে সব শর্ত, উপাদাণ, ফর্মুলা আর নির্দিষ্ট ছক আছে- বাংলাদেশ দলে তার অভাব প্রবল।
সাদা চোখে টি-টোয়েন্টি শুধুই মারমার কাটকাট বা চার ছক্কার খেলা। অনেকের বদ্ধমূল ধারণা ও স্থির বিশ্বাস, টি-টোয়েন্টি পিঞ্চ আর পাওয়ার হিটিংয়েরও খেলা। হ্যাঁ পিঞ্চ ও পাওয়ার হিটিংয়ের প্রভাব আছে প্রচুর। অ্যাডভান্টেজও আছে। তাই বলে সেটাই শেষ কথা নয়।
এই ১২০ বলের খেলার দৈর্ঘ্য কম হলেও তারও নিজস্ব ছক ও হিসেব নিকেশ আছে। ব্যাটিংয়ের ফর্মূলা এক ও অভিন্ন। টপ অর্ডারদের কাজ হলো শুভ সূচনার পাশাপাশি পাওয়ার প্লে’র ছয় ওভারে হাত খুলে খেলে রানকে পঞ্চাশ পার করে ষাটের ঘরে নিয়ে যাওয়া। তারপর চার ও পাঁচ নম্বর ব্যাটসম্যানদের কাজ থাকে, ৭ থেকে ১৪/১৫ ওভার দেখে ও ঠান্ডা মাথায় কম ঝুঁকি নিয়ে সিঙ্গেল-ডাবলসে খেলে আলগা ডেলিভারি কাজে লাগিয়ে সাত-আট রান করে নিয়ে ১৫ ওভারে ১২০/১৩০-এর আশপাশে থাকা। তারপর ছয়, সাত ও আট নম্বর এবং নীচের দিকে বোলাররা মিলে শেষ ৫ ওভার মানে ৩০ বলে হাত খুলে ঝড়ের গতি ব্যাট চালিয়ে অন্তত ৫০ রান তুলে দেবেন, তাতে স্কোর গিয়ে অন্তত ১৮০‘তে দাঁড়ায়। আগে কিংবা পরে দুই সময়ই এমন ফর্মুলা অনুস্মরণই ধরা হয় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ব্যাটিং সাফল্যের মূল।
একইভাবে বোলারদের করণীয়ও প্রায় ঠিক করা। এখানেও আছে নির্দিষ্ট ছক। শুরুতে ব্রেক থ্রু এনে প্রতিপক্ষ ফ্রন্টলাইন ব্যাটিংকে চাপে ফেলে দেয়া। তারপর মাঝের ৭/৮ ওভার মাপা বোলিং করে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের উত্তাল উইলোবাজি থেকে যতটা সম্ভব বিরত রাখা এবং শেষ দিকে মানে ‘ডেড’ ওভারে ইয়র্কার, ওয়াইড ইর্য়কার আর লো ফুলটচ এবং স্লোয়ার ডেলিভারিসহ নানা বৈচিত্র্যের সমাহার একান্তই জরুরি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এমনিতেই বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এই সব কাজ মোটেই দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে করতে পারেন না। টপ, মিডল ও লেট অর্ডার ব্যাটসম্যানরা এই ফরম্যাট উপযোগি ব্যাটিংয়ে পারদর্শী নন। আর বোলারদের দূর্বলতাও পরিষ্কার। তারাও করণীয় কাজগুলো করতে পারেন না ঠিকমত। সেটা আগে থেকেই। আর এবার দেরাদুনে আফগানিস্তানের সাথে সামগ্রিক পারফরমেন্সের গ্রাফটা একটু বেশিই নিচে ছিল। তাই সব ম্যাচ হার।
এটা ব্যর্থতা। তাই বলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া কিংবা সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং আফগানদের কাছে নাকাল হওয়া ‘শাপে বর’ও হতে পারে। ‘আমরা যে আসলেই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ভাল খেলি না। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যরে ক্রিকেটে আমাদের ঘাটতি, দূর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা প্রচুর’- এ কঠিন সত্য ফুটে উঠেছে। প্রয়োজন যেমন আবিষ্কারের জননী, তাই দেরাদুনের ব্যর্থতা থেকেও হয়ত সে সব দূর্বলতা, সীমাবদ্ধতা আর ঘাটতি পুরণের জোর তাগিদ নিশ্চয়ই জন্মাবে ।
আসল কথা হলো, আফগানদের কাছে নাকাল হওয়ায় তাই লজ্জায় মরে যাবার কিছু নেই। বরং এ সিরিজে আছে এক বড় বার্তা। তাহলো ‘আমরা টি-টোয়েন্টি পারি না। পারলেও ভাল খেলি কালেভদ্রে। এ ফরম্যাটে করণীয় কাজগুলো এখনো ঠিকমত করতেও পারি না। উপলব্ধিটাই বেশি জরুরি।’ তাহলেই দূর্বলতা, ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। লজ্জায় লাল হয়ে বসে থাকলে কিন্তু আর আগানো যাবে না। তাই আত্মোপলব্দিটাই খুব জরুরি।
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি