সাকিব কেনো ‘নন্দ ঘোষ’!
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান যেন এখন ‘নন্দ ঘোষ’। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ এখন সাকিব আল হাসানের। ভাবটা এমন, আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে করুণ পরিনতির জন্য সাকিব আল হাসানই দায়ী।
রোববার প্রায় মধ্য রাতে খেলা শেষ হবার খানিকক্ষণ আগে থেকেই শুরু হয়ে সাকিবকে ‘আসামী’র কাঠগড়ায় দাড় করানো পর্ব। অন্তঃপ্রান বাংলাদেশ ভক্ত আর অতিবড় সাকিব সমর্থকের মুখেও একই সংলাপ, ‘কী ক্যাপ্টেন্সি করলেন সাকিব? এটা কোন ক্যাপ্টেন্সি হলো?’
দুই অফস্পিনার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (১ ওভারে ১ রানে ২ উইকেট) আর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত (১ ওভারে ৩ রান) দুই ওভারে মাত্র ৪ রান দেয়ার পরও কেন তাদের শেষ দিকে আর ব্যবহার করলেন না? কেন দুই অফস্পিনারকে বাদ দিয়ে শেষ চার ওভার শুধু পেস বোলারদের দিয়ে বোলিং করানো হলো ?
তিন পেসার আবু জায়েদ রাহি, রুবেল হোসেন আর আবুল হাসান রাজু মিলে ঐ চার ওভারে দিয়েছেন ৬২ রান। ওভার পিছু ১৫ রানের বেশী। এই চার ওভারের অন্তত দুই ওভার সাকিব অনায়াসে মাহমুদউল্লাহ আর মোসাদ্দেককে বোলিং করাতে পারতেন। তাহলে আফগানরা অত স্বচ্ছন্দে আর ইচ্ছেমত শেষ দিকে রান তুলতে পারতেন না।
মোদ্দা কথা, ভাবা হচ্ছে শেষ ৪ ওভারে রানের চাকা অমন দ্রুত না ঘুরলে হয়ত খেলার টিত্র অন্যরকম হতে পারতো। হ্যা তা নিয়ে কথা হতেই পারে। ক্রিকেট খেলাটাই এমন। প্রচুর ‘যদি-তবে’ তে ভরপুর। কি হলে কি হতো? এই না হলে সেই হতো, ইশ যদি ঐ আউটটা না হতো তাহলে পরিনতি এমন ঘটতো না, ঐ ক্যাচ হাত ফসকে না বের হলে ফলই বদলে যেত।
আহ্ কি রান আউটটের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে , ঐ রান আউটটা করতে পারলে নির্ঘাত....... দল জিততো। এসব কথা বার্তা-সংলাপ, আহাজারি, অনুশোচনা, আফসোস, পর্যালোচনা, আলোচনা আর সমালোচনা ক্রিকেটের নিত্য সঙ্গী। গতকালকের ম্যাচ নিয়েও চলছে নানা কথা বার্তা। আলোচনা, পর্যালোচনা, ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ আর তীর্যক কথোপকোথন চলছে। আগেই বলা হলো, যার বেশীর ভাগ সমালোচনার তীর সাকিবের দিকে।
রোববার গভীর রাতে এমনকি সেহরির সময়ও ঘুরে ফিরে ঐ ম্যাচের কথাই হয়েছে। আজ সকাল থেকেও সবার মুখে ঘুরে ফিরে দেরাদুনের প্রথম ম্যাচ প্রসঙ্গ। রোববার রাতে খেলা শেষেও একই প্রশ্ন উঠলো খেলা শেষেও । সাকিবের কাছে জানতে চাওয়া হলো, আপনার হাতে দুজন স্পিনার অপশন ছিলেন; মাহমুদউল্লাহ আর মোসাদ্দেক, যারা মাত্র এক ওভার করে বোলিং করেছেন। তাদেরকে কেন শেষ দিকে বোলিং করানো হলোনা?
সাকিব জবাবে পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘হ্যা এমন মনে হতেই পারে। তবে তাদেরকে আনলে তারা কেউ তো এক ওভারে তিন ছক্কাও খেয়ে যেতে পারতেন। তখনতো আবার আপনারাই বলতেন, এইতো প্রতিষ্ঠিত বোলারদের বোলিংয়ের না এনে অনিয়মিত বা ব্যাকআপ বোলার ব্যবহারেই ঘটলো সর্বনাশ।’
সাকিবের পক্ষ নেয়া নয়। আসুন পরিসংখ্যানের আলোকে দেখি। ধরা যাক সাকিব মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেককে শেষ চার ওভারে এক এক করে দুই ওভার বোলিং করাতেন, তাহলে কি হতো? তারা খুব বাজে বোলিং করলেও হয়ত ১০+১০ = ২০ রান দিতেন। তারচেয়ে ৪/৫ রান কমও দিতে পারতেন।
তাহলে রাহি, রুবেল ও রাজু যে ওভার পিছু ১৫ রানের বেশী দিয়েছেন, তার চেয়ে নির্ঘাত ওভার পিছু ৫ কিংবা ৬/৭ রান করে কম হতো। তার মানে আফগানরা শেষ চার ওভারে আরও ১০ থেকে ১৫/১৬ রান কম পেত। স্ট্যানিকজাই বাহিনীর রান থাকতো ১৫০‘র ঘরে।
বাংলাদেশের লক্ষ্যটা কমে যেত। ১৬৮ ‘র বদলে হয়ত ১৫৫/১৫৬ হতো। তাহলে কি হতো? বাংলাদেশ দল জিতে যেত? যে দল প্র্যাকটিস ম্যাচে রশিদ খান আর মুজিব উর রহমান ছাড়া আফগান একাদশের বিপক্ষে ১৪৫ রানে আটকে গেছে, সেই দল কাল ১২২ রানে অলআউট হয়েছে। তারা ১৫৫/১৫৬ রানের টার্গেট ছুয়ে ফেলতো- তাইবা কি করে ভাবা যায়?
এটুকু শুনে হয়ত ভাবছেন, কেন বাংলাদেশের কি ঐ রান করার ক্ষমতা নেই ? টাইগাররা কি আগে কোনদিন ১৫৫-১৬০ রান করেনি? দেড়শো রানের টাগেট টপকে যায়নি? হ্যা করেছে। টপকেও গেছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে এবার আফগানদের সাথে সিরিজ নিয়ে। গত ৭২ ঘন্টায় প্রস্তুতি ম্যাচ সহ আফগানদের সাথে দুই ম্যাচে একবার দেড়শোর ঘরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই একা সাকিবকে দুষে লাভ নেই।
ভুলে গেলে চলবেনা, সাকিবই টি টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ব মানের পারফরমার। এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটিং ও বোলিংয়ের অর্ধেক শক্তি সাকিব একাই।
আর এটা সত্য যে, আজকাল ডেথ ওভারে স্পিনার ব্যবহারের চল অনেক কম। তার পক্ষে যুক্তি হলো, স্পিনারদের আসলে সামর্থ্য সীমিত। যত বড় টার্নারই হোন না কেন, তাকে স্টেপ আউট করে লং অফ-লং অন আর ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে তুলে ছক্কা হাকানো যায়। আর পেস বোলাররা রিভার্স সুইং করাতে পারেন, ইয়র্কার ছুড়ে বিগ হিট নেয়া থেকে বিরত রাখতেও পারেন।
যেহেতু সাকিব নিজেই ১৬ নম্বর ওভারে তার কোটা পূরণ করে ফেলেছিলেন, তাই দুই অফস্পিনার রিয়াদ ও সৈকতকে আর ব্যবহার করেননি। তার পিছনে ক্রিকেটীয় যুক্তিও ছিল। কারন তখন ক্রিজে ছিলেন দুই ডানহাতি আফগান মিডল অর্ডার সামিউল্লাহ শেনওয়ারী (১৮ বলে তিন ছক্কায় ৩৬) ও শফিকুল্লাহ (৮ বলে তিন ছক্কা ও এক বাউন্ডারিতে ২৪)। তাদের বিপক্ষে অনিয়মিত অফস্পিনার ডেথ ওভারে ব্যবহারে সাকিব কেন, যে কোন অধিনায়কই বড়সড় ঝুঁকিই ভাববেন। সাকিবও তেমন ভেবেছেন। এতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে।
আজকাল টি টোয়েন্টি ফরম্যাটে সব বিচক্ষণ অধিনায়কই স্পিনারদের ব্যবহার না করে পেসারদের হাতে বল তুলে দেন। যার ভুরি ভুরি উদাহরন আছে। কারনও আছে। ডেথ ওভারে প্রতিপক্ষের হার্ড হিটারদের স্বচ্ছন্দ, সাবলীল আর হাত খুলে বিগ হিট নেয়া থেকে বিরত রাখতে বড় বড় ফাষ্টবোলাররা অনেক কার্যকর কৌশল ব্যবহার করেন । কখনো প্রচন্ড গতির বিপরীতে হঠাৎ স্লোয়ার, ইয়র্কার, লো ফুল টস আবার শেষ দিকের ব্যাটসম্যান পেলে বাউন্সার দিয়ে তাকে ভরকে দিয়ে পরের বলে ইয়র্কারও ছোড়েন অনেকেই।
কালকের ম্যাচেই আফগান ফাষ্টবোলার শাপুর জাদরানই ঠিক সেই ফর্মুলা খাটিয়ে আবুল হাসান রাজুকে বোল্ড করেন। আগের বলে খাট লেন্থে বল ফেলে প্রচন্ড গতির বাউন্সারে বিব্রত ও পরাস্ত রাজুর ব্যাটের ওপরের অংশে লেগে আফগান কিপার মোহাম্মদ শাহজাদের মাথার ওপর দিয়ে বল চলে যায় সীমানার ওপারে। ঠিক পরের বলই পারফেক্ট ইয়র্কার। আর তাতেই রাজু বোকা বনে বোল্ড। বোঝাই যায়, সাকিব সেই চিন্তায়ই মাহমুদউল্লহ আর মোসাদ্দেককে ডেথ ওভারে ব্যবহার করেননি।
কিন্তু বাংলাদেশের তিন পেসার রাহি , রুবেল আর রাজু তার কিছুই করতে পারেননি। এই কাজ গুলো করতে পারলে আফগানদের আটকে রাখা যেত। কিন্তু তিন পেসারের কেউই সে আদর্শ অস্ত্রগুলোর সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে পারেননি।
রুবেল ১৭ (১০) ও ১৯ ১৩) নম্বর ওভারে দিয়েছেন ২৩ রান। রাহির ১৮ নম্বর ওভারে আফগানরা তুলে নেয় ২০। আর রাজু শেষ ওভারে তিন উইকেটের পতন ঘটলেও (দুই উইকেট রাজুর, একজন রানআউট) রান উঠেছে ১৯। শেষ ৩ ওভারে ৫২! ভাবা যায়?
আর সেই তিন পেসারের ব্যর্থতার দায় বর্তেছে সাকিবের ওপর। তা কেন? তবে একটা যুক্তি অবশ্য সাকিবও মনে হয় খন্ডন করতে পারবেন না। তা হলো, মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেককে অন্তত আরও এক ওভার করে বোলিং করানো যেত। সেটা করলেও আফগানিস্তানের স্কোর হয়ত দেড়শ’র ঘরে থাকত।
কিন্তু এবার দেরাদুনে ব্যাটিংয়ের যে হতশ্রী অবস্থা, তাতেও কি শেষ রক্ষা হতো? লক্ষ্যটা দেড়শোর ঘরে থাকলেও কি পারতেন তামিম, লিটন, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির ও মোসাদ্দেকরা?
এআরবি/এসএএস/জেআইএম