সমন্বয়হীনতার কারণে ব্যাহত হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কাজ


প্রকাশিত: ০১:২৭ পিএম, ১৫ জুলাই ২০১৫
২০০৭ সালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বরকল উপজেলা সদরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত <br> মাইক্রো সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প এখন পরিত্যক্ত স্থাপনা। এটি কোনো কাজেই আসেনি।

বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্ভরযোগ্য একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার।

সূত্র মতে, ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর এ পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে পার্বত্য এই তিন জেলায়। এ সকল কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে। সর্বাধিক উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন উন্নয়মূলক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এলাকার জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুফল ভোগ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বিভিন্ন মহল।

এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে তিন পার্বত্য জেলায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করছে। আলাদাভাবে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। কিন্তু কাজে কোনো সমন্বয় নেই।

বিভিন্ন এলাকায় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কোনো মতামত বা পরামর্শ নেয়া হয় না। এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। তারা বলেন, সমন্বয়হীনতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এ সকল উন্নয়নের সুবিধা থেকে স্থানীয় জনগণ বঞ্চিত হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের চলমান উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে তিন জেলায় এ পর্যন্ত বহু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট এবং শিক্ষা, ধর্মীয়, চিকিৎসা, কৃষি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে ঠিক। কিন্তু যার যে ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকল্পগুলো হাতে নেয়ায় অধিকাংশ কাজে কোনো সফলতা আসেনি। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ভেস্তে গেছে বহু প্রকল্প। যেগুলো জনস্বার্থে কোনো কাজেই আসেনি।

এছাড়া সিংহভাগ বরাদ্দের অর্থ লুটপাট ও লোপাট হয়ে গেছে। হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি। অনেক ক্ষেত্রে একই কাজের বাস্তবায়ন দেখিয়েছে একাধিক সংস্থা। ওভারলেপিং হয়েছে বহু কাজ। এক সংস্থার কাজে আরেক সংস্থার ওভারলেপিং প্রকল্পে কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে আত্মসাতের ঘটনাও ঘটছে নজিরবিহীনভাবে।

জানা গেছে, পার্বত্য তিন জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করলেও সেসব কাজে সরকার বেশিরভাগ অর্থ বরাদ্দ দেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। আর সিংহভাগ উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয় দলীয় বিবেচনায় এবং ক্ষমতাসীনদের দলীয় লোকদের স্বার্থে।

এদিকে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোনো উন্নয়ন কাজে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয় সাধন ও তদারকির ক্ষমতা থাকলেও আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যে অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তুর লারমার দাবি সম্বলিত বক্তব্যেও স্পষ্ট ওঠে আসছে।

এ ব্যাপারে এক লিখিত বক্তব্যে সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ২২(ক)(গ) ধারা মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সব উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয় সাধন করাসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বিষয়াদি সার্বিক তত্ত্বাবধানের বিধান রয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করার বিধান থাকলেও উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বরাবরই ওই বিধান অবজ্ঞা করে চলেছে।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তরুণ কান্তি ঘোষ বলেন, এটি সংবিধিবদ্ধ একটি সংস্থা যা নিজস্ব আইন দিয়ে পরিচালিত। পার্বত্য এলাকায় এর সবগুলো উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়িত হয় বোর্ডের আইন অনুযায়ী। প্রকল্পগুলোর প্রস্তাব আসে স্থানীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী জনপ্রতিনিধির সুপারিশ এবং ব্যক্তি বিশেষের আবেদনের ভিত্তিতে। সেগুলো বোর্ডের কনসালটেন্ট কমিটি যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করে থাকে। পরে গৃহীত প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেয় বোর্ড কমিটি।

রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমা বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকান্ডের মূল দায়িত্বে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করে তিন পার্বত্য জেলায়। কিন্তু তারা তাদের উন্নয়ন কাজে আমাদের সঙ্গে কোনো রকম সমন্বয় করে না। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের কোনো রকম মতামত বা পরামর্শ নেয়া হয় না।

উন্নয়ন বোর্ড এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আমাদের এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও আমরা সেসব প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুই জানি না। প্রকল্প নেয়া হয় ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী। সিংহভাগ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হয়ে থাকে দলীয় বিবেচনায়। ফলে পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়ন কাজে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। ঘটছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি।

সুশীল প্রসাদ চাকমা/এসএস/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।