মুক্তিযোদ্ধা বলে চাকরি ঝুলে ছিল খন্দকার তারেকের

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ১২:৩৪ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লিখে কী হবে? কে জানতে চায় এসব?’-তাকে নিয়ে কিছু লিখবো বলতেই অনেকটা অভিমানের সুর খন্দকার তারেকের কণ্ঠে। পুরো নাম খন্দকার তারেক মো. নুরুল্লাহ। মহান স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন ৯ নম্বর সেক্টরে। ক্রীড়াঙ্গনে অতি পরিচিত মুখ, দেশের খ্যাতনামা ক্রীড়া ফটো সাংবাদিক তিনি।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে প্রকাশিত জাতীয় ক্রীড়া পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের আলোকচিত্রীর চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১২ সালে। এখনো ক্রীড়াঙ্গনে আগের মতোই পদচারণা তার। ক্যামেরা হাতে ছোটেন এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যু। ফ্রিল্যান্স ফটো সাংবাদিক হিসেবে লেগে আছেন খেলাধুলার সঙ্গে।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পাশের হ্যান্ডবলে কোর্টে তখন চলছিল বিজয় দিবসের খেলা। ফাইনাল শুরু হতে ঘণ্টাখানেক বাকি। সে ফাঁকেই মুক্তিযুদ্ধ, কর্মজীবনসহ নানা বিষয়ে নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন খন্দকার তারেক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে- তার তৃপ্তি বলতে এতটুকুই। বরং এখন অনেক কিছু তাকে পীড়া দেয়। বিশেষ করে, যখন দেখেন যুদ্ধ না করেও অনেকে এখন ‘মস্তবড় মুক্তিযোদ্ধা’ বনে গিয়েছেন। অতীত তাকে কষ্ট দেয় যখন মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে তার চাকরি ঝুলে থাকার কথা। হাসি পায় যখন স্মৃতিতে আসে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নয়, চাকরি পেতে সহায়তা করেছিল তার ‘মাথার আঘাত।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় ১৯৭৬ সালে তিনি দৈনিক সংবাদে কাজ শুরু করেন খণ্ডকালীন ফিচার রিপোর্টার হিসেবে। ১৯৭৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে অস্থায়ী আলোকচিত্রী হিসেবে যোগ দেন পাক্ষিক ক্রীড়া জগতে। ১৯৮০ সালে চাকরি স্থায়ী করতে গিয়েই খন্দকার তারেকের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার মুক্তিযুদ্ধের সনদ। পরিষদের তৎকালীন প্রশাসন তার চাকরি স্থায়ী করতে চায়নি মুক্তিযোদ্ধা বলে। এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান কতটুকু, সেখান থেকেই বড় ধারণা পেয়েছিলেন খন্দকার তারেক।

‘১৯৮০ সালে পত্রিকায় আলোকচিত্রী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। আমি আবেদন করি। আবেদন পত্রের সঙ্গে শিক্ষাগত সনদ ও অন্য প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্রের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সনদও দিয়েছিলাম। মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে আমার কাগজ-পত্রের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সনদ দেখে তৎকালীন সচিব এম এ রশীদকে একজন বলছিলেন- ওতো মনে হয় আওয়ামী লিগ করে। আমার চাকরি স্থায়ীত্বটা ঝুলে যায় তখনই’-বলছিলেন খন্দকার তারেক।

jagonews24

এর কিছুদিন পরই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মোহামেডান-আবাহনী ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করে তুমুল মারামারি হলো। ওই মারামারির ছবি তুলতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন খন্দকার তারেক। মাথা ফেটে অজ্ঞান হয়েছিলেন কিছু সময়। ওই মাথা ফাটার কারণেই চাকরি স্থায়ী হয়ে যায় তার।

‘কিসে আমার মাথা ফেটেছিল জানি না। মারামারি চলছে। হঠাৎ, মাথায় কি যেন লাগলো। এরপর আর মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি মাথায় ব্যান্ডেজ। ওই সময় ক্রীড়াজগত পরিচালনা হতো একটি সম্পাদকীয় বোর্ড থেকে। বোর্ডের প্রধান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের তৎকালীন প্রধান আতিকুজ্জামান। মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে তিনি ক্রীড়া পরিষদের সচিবকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আমার চাকরি স্থায়ী হয়নি দুই বছরেও। তার ২/১ দিন পরই আমার বাসায় চাকরি স্থায়ীত্বের চিঠি পৌঁছে যায়’-ক্রীড়াজগতে চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা বললেন খন্দকার তারেক।

বরিশাল শহরের কবি জীবনানন্দ দাস রোডে বেড়ে ওঠা খন্দকার তারেকের। বাবা-মায়ের ৫ সন্তানের বড় তিনি। বাবা মোহাম্মদ ওবায়েদ উল্লা ছিলেক সরকারি চাকরিজীবী, মা মুস্তারী ওবায়েদ গৃহিনী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পরই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিতে। ঘরে ফেরেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে চূড়ান্ত বিজয়ের খবর পাওয়ার পর সহযোদ্ধাদের জড়িয়ে প্রথমে কেঁদেছেন। পরে আকাশে গুলি ছুড়ে সবাইকে নিয়ে আনন্দ করেছেন।

খন্দকার তারেক মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ এমজি কবির ভুলুর নেতৃত্বে। পরবর্তীতে কুমিল্লার সোনাইমুড়ি বর্ডার দিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলায়। সেখান থেকে হাসনাবাদের টাকিপুরস্থ ৯ নম্বর সেক্টরে। এক মাস ট্রেনিং করে সাতক্ষীরা সীমান্তের ওপারে শমসেরনগর ক্যাম্প শুরু করেন। সেখান থেকে প্রতিরাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে অপারেশন শেষে আবার ভারতে চলে যেতেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে।

সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়া খন্দকার তারেক কখনোই নিজের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কথাটি প্রকাশ্যে কারো কাছে বলেন না। ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই জানেন না তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়, তার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে খেলার ছবি তোলেন- এভাবেই নিজেকে ক্রীড়াঙ্গনে বেশি পরিচিত করেছেন তিনি। ক্রীড়াজগতে চাকরির পাশপাশি ইংরেজি দৈনিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্টেও কাজ করেছেন খণ্ডকালীন হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের সনদ ও স্নাতক ডিগ্রি থাকার পরও কখনো অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা করেননি।

আরআই/আইএইচএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।