উইন্ডোজ ১০ ডিজিটাল যন্ত্রকে বদলাবে
চলতি জুলাই মাসের ২৯ তারিখে বিশ্বখ্যাত সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট তাদের ব্যবসার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা নিয়ে অপারেটিং সিস্টেমের দুনিয়াতে নতুন বিপ্লব করার কথা ভাবছে। সেদিন তারা তাদের সর্বশেষ অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ১০ বাজারজাত করবে। আমরা যারা কম্পিউটার ব্যবহারকারী তাদের জন্য পুরো বিষয়টি বড় রকমের কৌতূহল তৈরি করার মতো একটি ঘটনা।
১৯৮১ সালে মাইক্রোসফট যখন ডস তৈরি করে তখন ওএস-এর জগতে দুনিয়া একটি নতুন পথের সন্ধান পায়। এরপর তারা উইন্ডোজ প্রকাশ করে। কিন্তু সেটি এ্যাপল-এর ম্যাক ওএস এর পাশে দাঁড়াতে পারেনি। তবে ১৯৯৩ সালে মাইক্রোসফট যখন উইন্ডোজ ৩ প্রকাশ করে তখন সারা দুনিয়াতেই একটি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো। আমার নিজের মতে উইন্ডোজ ১০-এর প্রকাশ সেই ৯৩ সালের পর একটি বড় ধরনের মাইলফলক ঘটনা। আমি অবাক হয়েছি এজন্য যে বাংলাদেশের উইন্ডোজ ব্যবহারকারীরা এখনও বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। মিডিয়ায় এর তেমন গুরুত্ব ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কেও তেমন কোনো আলোচনা ছিল না। প্রায় দেড় দশক যাবত উইন্ডোজ ব্যবহার করে, দুনিয়ার বিদ্যমান অন্য সকল অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহারের প্রক্রিয়া ও বিকাশ থেকে আমার এই ধারণাটি জন্মেছে যে, মাইক্রোসফট ৯৩ সালের পর এই প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে ইতিপূর্বে কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম মেইনফ্রেম ও মিনিফ্রেম কম্পিউটারের হাত ঘুরে প্রথমে ডস (প্রো ডস-এমএস-ডস) ও পরে ম্যাক (লিজা-ম্যাক) ওএস এবং উইন্ডোজ ব্যবহৃত হতে থাকে। পিসি বা পার্সোনাল কম্পিউটারের এসব অপারেটিং সিস্টেমের পর ট্যাবলেটে আই-ওএস ও এন্ড্রয়েড রাজত্ব করতে শুরু করে। কালক্রমে স্মার্ট ফোনেও এই দুটি প্রধান অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে বিরাজ করতে থাকে। বর্তমানে ডেস্কটপ পিসিতে শুধুমাত্র উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয় শতকরা ৯০.৯০ ভাগ (সেপ্টেম্বর ২০১৪-এর হিসাব)। অন্যদিকে ম্যাক ও.এস (ও.এস ১০) ব্যবহৃত হয় শতকরা ৬.৩৮ ভাগ। লিনাক্সের ব্যবহার শতকরা ১.৬৪ ভাগ মাত্র। কিন্তু নেট এ্যাপ্লিকেশনের চিত্রটাই আলাদা। সেখানে উইন্ডোজ-এর ব্যবহার ৫৭.১২, লিনাক্সের ব্যবহার ২০.১২ এবং এ্যাপল-এর ও.এস -এর ব্যবহার ১৮.০৪।
ট্যাবলেট পিসিতে এ্যাপলের আধিপত্য একতরফা। তাদের দখলে ৭২.৯০ এবং এন্ড্রয়েড-এর দখলে ২৪.০২ ভাগ। উইন্ডোজ এখানে কার্যত নেই। সার্ভারের ক্ষেত্রে ইউনিক্স জাতীয় অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহার শতকরা ৬৭.৪ এবং উইন্ডোজ এর ব্যবহার ৩২.৬ ভাগ। ২০১৫ সালে এই অবস্থাটি বদলেছে। এর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, মোবাইল ফোনে এন্ড্রয়েড-এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
এমন একটি বিচিত্র অবস্থায় আমাদের দেশের জন্য একটি বড় বিবেচনার বিষয় হচ্ছে যে, আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কি প্রচলিত ধারার বাইরে চলে যাচ্ছে? আরও বিবেচনার বিষয় যে, উইন্ডোজ ১০ আসলে দুনিয়ার জন্য নতুন কোন বাণীটি নিয়ে এসেছে?
আমি মনে করি, উইন্ডোজ ১০ দুনিয়ার ডিজিটাল ডিভাইসের জগতটাকে আবারও সমন্বিত করবে। এখন যেভাবে ডেস্কটপ-ল্যাপটপ এক ধরনের অপারেটিং সিস্টেম (প্রধানত উইন্ডোজ ও ম্যাক ওএস) এবং ট্যাবলেট ও স্মার্টফোন অন্য ধরনের অপারেটিং সিস্টেম ( যেমন আই ওএস ও এন্ড্রয়েড) ব্যবহার করছে সেটির বদলে উইন্ডোজ ১০ স্মার্ট ফোন থেকে ডেস্কটপ পিসি পর্যন্ত সব কিছুতেই ব্যবহৃত হতে পারবে। এটি কি ছোট খাটো ঘটনা? অনেকের কাছেই মনে হবে- এটা আর কি? এন্ড্রয়েড ওআই ওএস যথারীতি ট্যাবলেট-পিসির জগতে রাজত্ব করবে আর উইন্ডোজ পিসির জগতে রাজত্ব করবে। তারা হয়তো মনে করেন যে, কেউ কারও সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না।
কিন্তু বিষয়টি সম্ভবত এমন নয়। ঘটনাটি এমন হতে পারে যে, আগামী এক দশকে দুনিয়ার সকল মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হবে। এর মানে দাঁড়াবে যে কমপক্ষে ৮০০ কোটি বা তার কাছাকাছি ডিজিটাল ডিভাইস দুনিয়াতে সক্রিয় থাকবে। এইসব ডিভাইসের সিংহভাগ থাকবে হাতের তালুতে। আমরা বর্তমানের সংজ্ঞায় এগুলোকে স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেট বলি। এসব যন্ত্র যদি ডেস্কটপ বা ল্যাপটপের সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারে তবে তথ্যপ্রযুক্তির জগৎটা কতোটা বদলে যাবে? দুনিয়ার এখনকার প্রবণতা হচ্ছে ডেস্কটপ পিসির বিক্রি কমে যাওয়া। দিনে দিনে ল্যাপটপ পিসির বিক্রি ডেস্কটপকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ট্যাবলেট পিসি র্যাপটপের বাজারে ভাগ বসিয়েছে। তবে সবেচেয় বড় টুকরাটা এখন স্মার্ট ফোন নিয়েছে। ঘটনাচক্রে এই দুনিয়াতে মাইক্রোসফট একেবারেই অসহায়। উইন্ডোজ ১০ এনে মাইক্রোসফট সেই সম্ভাবনাটিকেই উস্কে দিয়েছে।
আমি যদি তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ইতিহাসটার দিকে তাকাই তবে এটি আমাকে বিবেচনায় নিতে হবে যে বিষয়টি এমন থাকবে না। মাইক্রোসফটও ভেবেছিলো যে তারা ট্যাবলেট ও স্মার্ট ফোনের জন্য আরও দুটি আলাদা অপারেটিং সিস্টেম প্রচলন করবে। দুটি অপারেটিং সিস্টেম তারা বাজারে ছেড়েও ছিল। প্রধানত অপারেটিং সিস্টেমগুলোর দুর্বলতা এবং এন্ড্রয়েড ও আইএস-এর দাপটে তারা বস্তুত কোনো মার্কেট শেয়ারই দখলে নিতে পারেনি। বলা যেতে পারে, এক ধরনের বাধ্য হয়েই তারা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। এই কৌশলটির সুফল তারা পেতে পারে। এর মূল ভিতটা হলো ব্যবহারকারিরা উইন্ডোজ ব্যবহারের সাথে সমিলতা রেখে যদি ট্যাবলেট ও ফোন ব্যবহার করতে পারে তবে মাইক্রোসফট তার নিবেদিতপ্রাণ গ্রাহকদের কাছ থেকে আনুগত্য পেতে পারে। এই কৌশলটির আরও একটি প্রভাব তথ্যপ্রযুক্তির জগতে পড়তে পারে। এ্যাপলকে তাদের দুটি অপারেটিং সিস্টেমকে সমন্বিত করতে হতে পারে। এমনকি এন্ড্রয়েডকেও ডেস্কটপ পিসির উপযোগী করতে হতে পারে। ফলে ডিজিটাল ডিভাইসের আকার ভিন্ন হলেও অপারেটিং সিস্টেম তার অবয়ব এক রাখতে পারে। এছাড়াও সকল ধরনের ডিভাইসেই একই গোত্রীয় এ্যাপ চলতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির জগতটা ডেস্কটপ-ল্যাপটপের ভুবন ছেড়ে হাতের মুঠোতেও স্থায়ীভাবে চলে যেতে পারে। যতোদূর জানা গেছে মাইক্রোসফট তার অ্যাপগুলোকে সকল ডিভাইসে চলার উপযোগী করার কথাও ভাবছে। এটিও একটি যুগান্তকারী ঘটনা হতে পারে।
এবারে একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে যে উইন্ডোজ ১০ কেমন হতে পারে। আমাদের হাতে এখন এর কারিগরি পূর্ব প্রকাশনা রয়েছে। আমরা একে ট্যাবলেট পিসি, ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপে ইন্সটল করেছি। কিছু ড্রাইভারের বিষয় ছাড়া তেমন কোনো বড় সমস্যা এতে আমরা দেখিনি। মোটামুটি ভালভাবেই এটি কাজ করছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, এটি বস্তুত উইন্ডোজ সেভেন ও এইটের সমন্বিত রূপ। খুব সঙ্গতকারণেই এটি প্রথমত মাইক্রোসফটের বিদ্যমান গ্রাহকদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করবে। দ্বিতীয়ত এটি ট্যাবলেট বা স্মার্ট ফোনের গ্রাহকদের টাইলস-টাচস্ক্রিণ প্রবণতাকেও কাজে লাগাবে। উইন্ডোজ ১০ বিষয়ে মাইক্রোসফটের বড় প্রতিশ্রুতি হলো যে এতে নিরাপত্তার বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হবে।
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে যে আপনি উইন্ডোজ ১০ এর আবির্ভাবকে ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে কেন দেখছেন তাহলে ইতপূর্বে বর্ণিত কথাগুলোতো আমি বলবোই, সাথে আরও একটি বিষয়ের কথা বলবো। আমরা লক্ষ্য করেছি যে মাইক্রোসফট তার অপারেটিং সিস্টেম বিকাশের ক্ষেত্রে যে পথে হেঁটেছে তাতে তাদের কোনো একটি অপারেটিং সিস্টেম জনপ্রিয় হলেও পরেরটা একাধিক ব্যবহারকারী পছন্দ করে না। সাম্প্রতিককালে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ৮ প্রকাশ করেছে। এটি ব্যবহারকারিরা নানা কারণে পছন্দ করেনি। এরপর ৯ প্রকাশিত না হয়ে সেটি ১০ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি এটি ব্যবহারকারিরা পছন্দ করবে। ফলে উইন্ডোজ ৮-এর ব্যর্থতা মাইক্রোসফট কাটিয়ে ওঠতে পারবে।
আমি নিজে অপেক্ষা করছি কবে আমি আরও দুটো যন্ত্র নিজে ব্যবহার করবো। আমার বন্ধু-বান্ধবরা সবাই আইপ্যাড-আইফোন বা এন্ড্রয়েড ফোন নিয়ে মাতামাতি করছে। কিন্তু আমি এর কোনোটাই ব্যবহার করতে পারি না। এক ধরনের প্রযুক্তি প্রতিবন্ধিতা আমার মাঝে কাজ করে। আমি এক সময়ে যখন ম্যাক ব্যবহার করতাম তখন কেবলি ম্যাক ব্যবহার করেছি। এরপর যখন উইন্ডোজ ব্যবহার করতে শুরু করেছি তখন সেটাই করে আসছি। নতুন করে আই-ওএস বা এন্ড্রয়েড শেখার ইচ্ছা হচ্ছে না। আমার নিজের ধারণা টাচ স্ক্রিনের জন্য আমার আঙুলগুলো অনেক বড়। আবার আমি দেখেছি আমাদের ১৪ বছর বয়সী পরমা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উইন্ডোজ, আই ওএস এবং এন্ড্রয়েড ব্যবহার করছে। দুনিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি গুলোর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই দুই প্রজন্মকে এক সূত্রে বাঁধা।
এখন পর্যন্ত উইন্ডোজ ১০ হচ্ছে দুই প্রজন্মকে এক সাথে সকল ডিজিটাল যন্ত্রে সমন্বিত করার উদ্যোগ। কামনা করি মাইক্রোসফটের এই উদ্যোগ সফল হোক। একই সাথে এ্যাপল ও গুগলকে মাইক্রোসফটের পথে হাঁটতে শুরু করার জন্য অনুরোধ করছি।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচির প্রণেতা ।
এইচআর/পিআর