ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আজ


প্রকাশিত: ০৫:১০ এএম, ৩০ জুন ২০১৫

আজ ৩০ জুন। ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসের ১৬০তম সিদু বা কানু দিবস। ১৮৫৫ সালে উপমহাদেশে ভগনাদিঘি গ্রামে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল আদিবাসীসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা ইংরেজ শাষকদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিল সেটাই সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

দামিন ই-কোহ নামে পরিচিত ভোগলপুর, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ রাজমহলের পাহাড়তলী এলাকায় ১৩৬৩ বর্গমাইল বিস্তৃত বনাঞ্চলের গাছ-পালা কেটে আদিবাসীরা আবাদযোগ্য জমি গড়ে তোলে এবং সেখানে ফসল ফলাতে শুরু করে। এ অবস্থা দেখে বিট্রিশ সরকার তাদের কাছ থেকে খাজনা নিতে শুরু করে। পরবর্তীতে এর মাত্রা আরো অনেক গুণ বেড়ে যায়। এরপরও সাঁওতালদের উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন চলে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দামিন ই-কোহতে যখন ফসলের মাঠ ভরে যায় তখন জমিদারদের চোখ পড়ে সেদিকে।

এ অঞ্চলে ফসলের ভাল অবস্থা দেখে বীরভূম ও বর্ধমান থেকে কিছু বাঙালি এ অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। এরপর সাঁওতাল আদিবাসীদের সাথে তারা মহাজনী কারবার শুরু করে দেয়। কিছু দিনের মধ্যেই অনেক আদিবাসী পরিবার ঋণের জালে আটকা পড়ে। এর কিছুদিনের মধ্যেই অঞ্চলে থানা, আদালত ও আমলারা আসল। এরপর শুরু হল জমিদার, মহাজন ,পুলিশ ও আমলাদের জুলুম নির্যাতন। ফলে সে অঞ্চলে আদিবাসীদের টিকে থাকা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

১৮৪৮ সালের দিকে মহাজনদের জ্বালায় দামিন ই- কোহ এলাকার ৩টি গ্রামের সাঁওতাল পরিবার দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অন্যায়-অত্যাচার সাঁওতালদের ধৈর্য্যের মধ্যে থাকলেও মহাজনদের অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সাঁওতাল আদিবাসীরা মাঠে ফসল ফলায় আর ফসলের অধিকাংশই যায় মহাজন ও জমিদারের গোলায়। তাদের এ অবস্থা দেখে ভগনাডির নারায়ণ মাঝির চার ছেলে সিধু , কানু, চাঁদ ও ভৌরব বসে থাকতে পারলেন না। তাদের অন্তরে প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু করল।

সাঁওতালদের সংকটের সময় জমিদার মহাজনেরা সুযোগ বুঝে কিছু অর্থ শস্য অধিক সুদে আদিবাসীদের ঋণ দিত। উচ্চ হারে সুদ নিয়েও তারা ওজনে ঠকাত । তাদের নিরক্ষরতার সুযোগে মহাজন জমিদারেরা জাল স্বাক্ষর করা থেকেও বিরত ছিল না। প্রতিবাদ করলে তাদের মামলায় অভিযুক্ত করে সর্বশান্ত করা হয়। এই অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন চার ভাই।

সাঁওতালদের অন্যায় অত্যাচার ও মহাজনদের কবল থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে তাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা চলতে থাকে। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর স্থির করলেন সাঁওতাল রাজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তাদের অবস্থার মুক্তি হবে না। আর এই মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রয়োজন। তবে এ কর্মকাণ্ডে এলাকার খেটে -খাওয়া জনগণকে সামিল করতে না পারলে তাদের বিদ্রোহের আশানুরূপ ফল হবে না। তারা সরাসরি বিদ্রোহের ডাক না দিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিলেন।

এক্ষেত্রে তারা একদিন এলাকার লোকজনদের জমায়েত করে ঘোষণা  দিলেন তাদের চার ভাইকে ঠাকুর জিও স্বপ্নে আবিভূত হয়ে নির্দেশ দিয়েছেন অন্যায়-অত্যাচারী জোতদার, মহাজন, জমিদারদের উৎখাত করে সাঁওতাল রাজ্য কায়েমের জন্য। সাঁওতাল আদিবাসীসহ মুক্তিকামী জনতার মধ্যে এই ঘোষণা সঞ্চালিত হল । সিধু ও কানু ঘোষণা করলেন, ঠাকুরের আর্শীবাদ নিয়ে তারা অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবেন। ১৮৫৫ সালের গোড়ার দিকে তারা একটি পরোয়ানা প্রচার করলেন। সিধু, কানুর কাছে যখন সাঁওতালরা শুনলো ঠাকুর জিউ তাদের শোষকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলেছেন। তখন তারা আর বসে থাকতে পারলেন না। তারা মানসিকভাবে বিদ্রোধের জন্য প্রস্তুুত হতে লাগলেন।

আলোচনার জন্য ভগলাদিঘি গ্রামে সাঁওতালেরা সমবেত হলে সিদ্ধান্ত মত পরদিন এক সঙ্গে সবাই শিকারে বেরুবে। পরের দিন সিধু, কানুর নেতৃত্বে ৪০/৫০ জন সাঁওতাল যুবক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে শিকারে যাওয়ার পথে দারোগা মহেশ দত্ত, ২ জন সিপাই ও কয়েকজন মহাজনের সামনে পড়ে। দারোগার সঙ্গে ২ টি দড়ি বোঝাই গাড়িও ছিল। মূলত তারা সাঁওতালদের ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত জানতে পেরেছে। দারোগার সঙ্গে তাদের বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে বিদ্রোহী সিধু, কানুর সশস্ত্রদল ঘটনাস্থলে দারোগা মহেশ এবং কানু মানিক রায় নামের মহাজনকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর ভোগলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

 বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি লোকজনসহ অত্যাচারী জমিদার মহাজন অনেকে সাঁওতালদের হাতে নিহত হতে থাকে। ১৮৫৫ সালে ১৭ আগষ্ট সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের আত্নসমপর্ণের আহ্বান জানানো হয়। বিদ্রোহীরা সরকারের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সেনাবাহিনী মাঠে নামায় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে শত শত বিদ্রোহীকে হত্যা করা শুরু করে সেনাবাহিনী। এক দিকে কামান বন্দুক অপর দিকে তীর ধনুকের লড়াই। কয়েক দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী ভোগলাদিঘির গ্রাম ধ্বংস করে দেয়।

সিধু, কানুর বাড়িসহ গ্রামের সকল বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। আশ্রয়হীন ও খাদ্যহীনতার কারণে অনেকে দূর্বল ও অনেকে ধরা পড়লেন। বিদ্রোহীদের মনোবল আস্তে আস্তে দূর্বল হতে লাগল। কানু সঙ্গিদের নিয়ে হাজারী বাক অভিমুখে পালাবার সময় জারয়ার সিং নামক ব্যক্তির তৎপরতায় ১৮৫৫ সালের ৩০ নভেম্বরে ধরা পড়ে। শেষে কানুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, লুণ্ঠন, অত্যাচার ও হত্যার অভিযোগে ১৮৫৬ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারী স্পেশাল কমিশনার এলিয়টের এজলাসে তাদের বিচার হয়। বিচারে কানুকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করা হয়।

এই বিদ্রোহে ৩০ হাজার আদিবাসী প্রাণ হারায়। বিদ্রোহের ১৫৮ বছর পরও আদিবাসীরা অত্যাচার আর শোষণ থেকে মুক্ত হয়নি। বিট্রিশ সরকার গেছে, জমিদার মহাজন গেছে তবুও আজ স্বাধীন দেশে বাংলাদেশের মাটিতে বিট্রিশ সরকারের তুলনার কম নির্যাতিত হচ্ছে না সাঁওতালরা।

দিবসটি পালন উপলক্ষে আদিবাসী পরিষদ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচিতে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড.মিজানুর রহমান চৌধুরী অংগ্রহণ করবে।

এমদাদুল হক মিলন/এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।