সম্ভাবনার বাংলাদেশ, শান্তির দেশ হবেই
গত ২৬ জুন শুক্রবার একইদিনে গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটি খবর এসেছে। প্রথমটি হলো বিশ্বের শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে এ বছর সূচকে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড পিস ‘গ্লোবাল পিস ইনডেক্স’ (জিপিআই) এই সূচক প্রকাশ করেছে। আর দ্বিতীয় খবরটি ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, ক্ষেত্রবিশেষ গণমাধ্যমের ওপর ‘নিয়ন্ত্রণ আরোপ’কে বাংলাদেশের মানবাধিকারের অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ২০১৪ সালে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ ‘তথ্য’ দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর অবশ্য বাংলাদেশকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছে দেশটিতে রয়েছে প্রাণবন্ত সুশীল সমাজ এবং বহুমাত্রিক সংসদীয় গণতন্ত্র। তবে রাজনৈতিক সহিংসতা ও দলীয় অন্তর্কোন্দলকে বাংলাদেশের জন্য ‘গুরুতর সমস্যা’ হিসেবেও মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর গ্লোবাল পিস ইনডেক্স অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। এ ছাড়া বিশ্বের ১৬২টি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। মজার বিষয় হলো ইনস্টিটিউট ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড পিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের চেয়েও বরাবরের মতো অনেক পিছিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৯৪ তম।
অবশ্য সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের সুচকে ১৬২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫৭তম অবস্থানে। অর্থাৎ এই জায়গায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। আর এই সহিংসতা কারা করছে? স্বাধীনতাবিরোধী আর ধর্মান্ধরা। দেশে বিদ্যমান দুর্বল গণতন্ত্রের মধ্যেও যদি রাজনৈতিক হানাহানি না থাকতো তাহলে এই দেশই যে সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ হয়ে উঠতো না তা কে বলবে? হাজারো সীমাবদ্ধতা, দুঃখ-কষ্টের অন্ত নেই, তারপরও কতো শান্তির দেশ এই বাংলাদেশ! অল্পতেই তুষ্ট এই দেশের মানুষের মধ্যে যদি গুটিকয়েক স্বাধীনতাবিরোধী না থাকতো, রাজনৈতিক দলগুলো যদি আর একটু সহনশীল হতো আমি নিশ্চিত এই বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বর শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াত।
যুক্তরাষ্ট্র কী বললো না বললো সেটির চেয়ে বড় কথা শান্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। আর যুক্তরাষ্ট্রই নয়, আমাদেরও ওই এক কথা যদি রাজনৈতিক সহিংসতা না থাকতো তাহলে এদেশটা সবদিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারত।
আমাদের বাঙালিদের কী অতকিছু চাই? আমরা কী চাই? দু`বেলা দু`মুঠো ভাত। সেটা পেয়েছি। আর শান্তিতে একটু ঘুম। খুব বেশি কি চাওয়া? রাস্তায় যে সন্তানটি বের হয় মায়ের যেন দুশ্চিন্তা না হয়, নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা চাওয়া, খুব বেশি কি? বিপদে পড়লে পুলিশ এসে যেন উদ্ধার করে, এই টুকুইতো চাওয়া। আমরা কি এই চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারিনা? কীসের অভাব আমাদের? দরকার শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। সবদলইতো শান্তি চায়। হতে পারে না এমন একটা চুক্তি, যাতে থাকবে জাতীয় স্বার্থে সবাই এক হবে। দেশের উন্নয়ন বাধা পায় এমন কোনো কাজ করবো না আমরা। দেশের মানুষ খুশি হবে যেসব কাজ করলে সবাই মিলে সেই সব কাজই করা হবে। এগুলোতো খুবই সাধারণ চাওয়া!
আমরা কি এই স্বপ্ন দেখতে পারিনা? অবশ্যই পারি। কোনো একদিন নিশ্চয়ই সারা বিশ্নে সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠবে। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে জানি। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করলে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পথে কোনো বাধাই থাকবে না। এইতো কদিন আগে ক্রিকেট বিশ্বের মোড়ল ভারতকে কী চমৎকারভাবে আমাদের ছেলেরা হারিয়ে দিয়ে সিরিজ জয় করে নিল, ক`বছর আগেও কি আমরা ভাবতে পেরেছিলাম ভারত-পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড সবাইকে হারিয়ে দেবো? ভাবিনি। কিন্তু আমরা পেরেছি। শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবেও আমরা স্বীকৃতি পাবো।
চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা দূর করা, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি, এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগের বিস্তার রোধ করা, টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং উন্নয়নে বিশ্বব্যাপি অংশীদারিত্ব, জাতিসংঘের এই টার্গেটগুলো পূরণে আমরা কি এগোয়নি? অনেকদূর এগিয়েছি। ‘গ্লোবাল পিস ইনডেক্স’ (জিপিআই) এই সূচকেই গত বছর ছিলাম ৯৮তম। তার আগের বছর ছিলাম ১০৫তম। তার মানে হাজারো অভিযোগের মধ্যে আমরা এগুচ্ছি। আমরা এগিয়ে যাবো।
গত এপ্রিল মাসে দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক `সোশ্যাল প্রোগ্রেস ইমপারেটিভ` নামে একটি অলাভজনক সংস্থার জরিপ। তাদের সূচকেও এগিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ডগলাস নর্থ ও জোসেফ স্টিগলিজ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এ সূচকে বাংলাদেশ পুষ্টি ও মৌলিক চিকিৎসা সেবায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে জীবনধারণের উপজীব্য শাখায় এ দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। আর উন্নয়নের ভিত্তি রচনায় বাংলাদেশ সর্বোচ্চ স্কোর করেছে। গত মার্চে ফ্রান্সভিত্তিক বাণিজ্যিক ঋণ ও বিমা গ্রুপ কোফেইস এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সম্ভাবনাময় সেরা ১০টি দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
আমাদের মাথাপিছু আয় এখন ১৩৫০ ডলার। এটা যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে দেখেন না সাদা চামড়া ইমিগ্রেশন লাইনে আমাদের যে অপমানটা করে তার জুতসই জবাব দেওয়া যাবে। তখনতো তারাই ভিসার জন্য লাইন দিবে এদেশে আসার জন্য। আমাদের যে বিউটিফুল বাংলাদেশ। এই দেশের প্রকৃতির স্বাদ কে নিতে না চাইবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে যে বসে আছে বাংলাদেশ। আছে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বড় ম্যানগ্রোভ বন, সবুজে ঘেরা পার্বত্য অঞ্চল। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। কী নেই আমাদের!
এই যুক্তরাষ্ট্রইতো আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ি বলতো। আমরা এখন খাদ্য রফতানি করি। ২৫ বছরে আমাদের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। পাশের দেশ ভারতের যা করতে লেগেছে ৪০ বছর। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) জরিপ করে দেখিয়েছে সুখের দেশ হিসেবে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ।
তবে আমরা জানি একটি সুখী, সমৃদ্ধ, অগ্রসর জাতি হিসেবে দাঁড়াতে হলে আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এ দেশের তারুণ্য নতুন যুগ খুঁজছে। তারাই দেশটাকে নিয়ে যাবে শিখরে। আর আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি শুধু একটু নিয়মের মধ্যে চলেন তাহলে তো কথাই নেই। আমরা সবাই নিয়মের মধ্যেই আছি থাকবো। আমরা এক জাতি একই ভাষায় কথা বলি একই সংস্কৃতির মানুষ। সকলের মধ্যে এই বোধ কাজ করলে সমস্যা বলে কিছুই থাকবে না।
শুধু দেশবিরোধী কিছু শয়তানকে যারা দেশটাকে পিছিয়ে নিতে চায় সেই সব যুদ্ধাপরাধী, আর কিছু ধর্মান্ধ মুর্খ মানুষ যারা বাংলাদেশকে প্রাচীনযুগে নিয়ে যেতে চায়, যারা আমাদের নারীদেরকে ঘরে আটকে রাখতে চায়, যারা প্রগতিবিরোধী, যারা ধর্মের নামে ব্যবসা করে, যারা রাজনীতির নামে ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ে সেই সব গুটিকয়েক দৈত্যকে যদি আমরা বোতলবন্দি করে ফেলতে পারি তবে অবশ্যই আমরা সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ হবো। আমাদের যে বেশি কিছু চাওয়ার নেই, এক হাতিরঝিল দেখেইতো আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই! আমরাতো এই দেশের শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলেমেয়ে।
আমাদের শক্তি তারুণ্য। আর তারুণ্যের শক্তিই বাংলাদেশের সম্ভাবনা। গণজাগরণ মঞ্চে সেটি দেখিয়েছি। তারুণ্য সব ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কোনো বাধাই আর বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। আমরাতো যুদ্ধ করে এদেশের মানচিত্র এঁকেছি। কয়টা দেশ তা পেরেছে? আমরা রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। আর কে পেরেছে? আমরাও এক নম্বর শান্তির দেশ হয়ে উঠবো। চাই শুধু একটু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি।
এইচআর/বিএ/পিআর