মুড়ির সঙ্গে দপদপিয়ার জীবন


প্রকাশিত: ০৫:১২ এএম, ১৭ জুন ২০১৫

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালি, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরাকাঠি এই পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুড়ি তৈরির ওপর জীবিকা নির্বাহ করেন।  আসন্ন রমজান উপলক্ষ্যে এই গ্রামগুলোতে রাতদিন চলে মুড়ি তৈরির ব্যস্ততা।  দপদপিয়ায় বছরে প্রায় ২ কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়।  

মুড়িকে যত সাধারণই ভাবা হোক না কেন, দপদপিয়ার মানুষ প্রমাণ করেছেন মুড়ি ভাজাটাই একটা শিল্প।  এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা।  একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক ২ মণ মুড়ি ভাজতে পারেন।  মুড়ি তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অনেক পরিবার  দেখেছেন স্বচ্ছলতার মুখ।  

কুড়কুড়ে, মুড়মুড়ে মুড়ি বাঙালির প্রাচীন মুখরোচক খাবার।  মুড়ি ভাজাকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ।  তাদের মধ্যে নারীরাই উল্লেখযোগ্য।  দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে মুড়ি ভাজাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন এমন পরিবার বিছিন্নভাবে পাওয়া যায়।  কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এ পেশার ওপর নির্ভরশীল এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন।  একটি নয় দুটি নয়, ঝালকাঠির দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালি, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরাকাঠি এ পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুড়ি তৈরির ওপর জীবিকা নির্বাহ করেন।  এই গ্রামগুলোতে এখন রাতদিন চলে মুড়ি তৈরির ব্যস্ততা।  

শুধু ঝালকাঠি নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুড়ি উৎপাদন হয়।  কিন্তু ঝালকাঠির দপদপিয়ার মতো একক পেশায় সর্বাধিক জনগণের অংশগ্রহণের কারণেই এ ইউনিয়নের নাম হয়েছে মুড়ি ইউনিয়ন।  গোটা দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে সুখ্যাতি পাওয়া এ অঞ্চলের মুড়ি এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।  ঝালকাঠির মুড়ি বিদেশেও সমান জনপ্রিয়।  পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এ অঞ্চলের উৎপাদিত মুড়ি।  রোজার মাসে মুড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় শবেবরাতের পর থেকে তাদের মুড়ি ভাজার ধুম লেগে যায়।  তখন তারা উৎসবের আমেজে পরিবারের সদস্যরা মিলে মুড়ি ভাজেন।  এখানে দুই পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজা হয়।  যারা একটু স্বচ্ছল তারা নিজেরা বাজার থেকে ধান কিনে আনেন।  তারপর বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরি করে মুড়ি ভেজে নিজেরাই বাজারজাত করেন।  আবার যারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল তারা আড়তদারদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চাল আনেন।  এই চালে মুড়ি ভেজে আড়তে সরবরাহ করেন।  এতে তাদের লাভ কম হয়।

এছাড়াও ঝালকাঠির সদর উপজেলার কির্ত্তীপাশা এবং রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন দাসের বাড়ি (হাউদ বাড়ি নামে পরিচিত) মুড়ি তৈরির কারিগররা মুড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।  

মুড়ি তৈরি করা অবস্থায় কথা হয় দপদপিয়ার হারুণ ও তার স্ত্রী তাসলিমা বেগমের সঙ্গে।  তারা বলেন, রমজান উপলক্ষে মুড়ি তৈরির চাপ বেশি। আড়তদাররা এক বস্তা (৫০ কেজি) চাল দিয়ে ৪২/৪৩ কেজি মুড়ি নিয়ে যান।  এতে পারিশ্রমিক হিসেকে ৪ থেকে সাড়ে ৪শ টাকা প্রদান করেন।  এ টাকা থেকে আমাদের লাকড়ি, লবণ, হাড়ি-পাতিল, চুলাসহ অনেক খরচ আছে।  সবমিলিয়ে আমাদের পারিশ্রমিক অনেক কম পড়ে।  তারপরও  পেটের তাগিদে মুড়ি ভাজতে হয়।



মুড়ি ভাজার সময় মুজিবুর, পারভিন, ফাতেমা, সাথী, রাজিয়া, আ. শুক্কুরসহ আরো অনেকের সঙ্গে কথা হয়।  তারা বলেন, ছেলে-মেয়েসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়।  তারপরও মানুষের কাছে হাত পেতে চাওয়ার চেয়ে কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করি।  তবে শ্রম ও খরচের তুলনায় মজুরি কম পাই।  কয়েকদিন পূর্বে অনেক গরম এবং বর্তমানে বৃষ্টি এ কারণে চাহিদামত মুড়ি ভেজে এগোতে পারছি না।  শুধু লবণ পানি ছাড়া আর কোনো ধরণের ক্যামিকেল না মিলিয়ে প্রাকৃতিকভাবেই এ মুড়ি ভাজা হয়।  

তারা আরো বলেন, আপনাদের মত অনেক লোক আসে, ছবি তুলে।  আপনাদের সংবাদ হয় কিন্তু আমাদের কোনো উপকার হয় না।  বাজারে যেসব মুড়ি পাওয়া যায় তা থেকে এই মুড়ি দেখতে যেমন আলাদা তেমনি স্বাদ ও দাম বেশি।  মেশিনের মাধ্যমে সার মিশ্রিত মুড়ি অপেক্ষাকৃত কম খরচে তৈরি করে কম মূল্যে বাজারজাত করায় এই গ্রামবাসীর রোজগারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এসব মুড়ি সহজ উপায়ে সার মিশিয়ে তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো খুবই ক্ষতিকর।  সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই মুড়ি ইউনিয়নকে বাণিজ্যিক মুড়ি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. সোহেল খন্দকার।  তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে মুড়ি গ্রামগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণ করে আরো অধিক উৎপাদন এবং এ পেশায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।  

মেসার্স খান ব্রাদার্সের মালিক আড়তদার মো. বুরজুক আলী খান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এক বস্তা (৫০ কেজি) চাল কারিগরদের কাছে ভাজতে দেই।  সেখান থেকে ৪২/৪৩ কেজি মুড়ি পাওয়া যায়।  এজন্য তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় সাড়ে ৪ শত টাকা।  এ মুড়িতে কোনো ভেজাল বা ওষুধ মেশানো হয় না।  তাই এটি সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যসম্মত।  এটি বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।  এমনকি অনেকে বিদেশে যাবার পূর্বে দেশি মোটা মুড়ি হিসেবে ২/৩ কেজি করে নিয়ে যান।  

ঝালকাঠি বিসিক উপ-পরিচালক অসিম কুমার ঘোষ জাগো নিউজকে জানান, মুড়ি তৈরির কারিগররা ঋণ সহায়তা চাইলে তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা হবে।

এমজেড/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।