সিলেটে ৯টি সিনেমা হলের মধ্যে ৬টিই বন্ধ
মানসম্পন্ন সিনেমার অভাব ও দর্শকদের চাহিদামতো হলের পর্দা ও পরিবেশ না থাকায় হল বিমুখ হয়ে পড়েছেন সিনেমা হলের দর্শকরা। ফলে সিনেমা হল ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। এতে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিলেটের সিনেমা হলগুলো।
সিলেটের নয়টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র তিনটি। বাকি ৬টিই বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি তিনটি সিনেমা হলও বন্ধ হওয়ার পথে।
তবে বিজিবি ও সৈনিক অডিটোরিয়াম সিনেমা হল বাদ দিলে বেসরকারি হলের মধ্যে সচল আছে মাত্র একটি `নন্দিতা`। বন্ধ হওয়া ছয়টির মধ্যে ‘অবকাশ ও রঙমহল’ সিনেমা হল দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে স্থাপন হয়েছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। বন্ধ হওয়া অপর চারটির একটি `দিলশাদ` সিনেমা হলে ঝুলছে `বিক্রয় হবে` বিজ্ঞপ্তি। এছাড়া বন্ধ রয়েছে লালকুঠি, মনিকা ও কাকলি সিনেমা হল। সিলেটের সিনেমা হলগুলো বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
৫ থেকে ৬ বছর আগেও নন্দিতা, দিলশাদ, অবকাশ, লালকুঠি, রঙমহল, মনিকা, কাকলি, বিজিবি ও জালালাবাদ সৈনিক এই নয়টি সিনেমা হল দর্শকদের পদচারণায় মুখোর ছিল। এখন আর সেই দৃশ্য নেই। যে তিনটি কোনো রকম টিকে আছে সেগুলোতেও দর্শক হাতেগুণা। সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার সুষ্ঠু পরিবেশও বজায় নেই।
নব্বইয়ের দশকের সিনেমা হলের নিয়মিত দর্শক ছিলেন সিলেট নগরের নবাবরোড এলাকার বাসিন্দা সুরুজ আলী। তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। সিনেমা হলের বর্তমান সময়ের এই সঙ্কটের কথা তুলতেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, নব্বইয়ের দশকের পুরো দশ বছরই আমি সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখেছি। মাঝে মধ্যে খুব ভালো মানের ছবি আসলে স্বপরিবারে হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি। আর এখন স্বপরিবারে হলে যাওয়া দূরে থাক, কাছ দিয়ে গেলেও বিব্রত হতে হয়। দর্শক কমে যাওয়ার মূলে হলের আশপাশ ও ভেতরের পরিবেশও একটি কারণ।
সুরুজ আলী আরো বলেন, ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সিনেমা গৌতম ঘোষের `মনের মানুষ` দেখতে হলে গিয়েছিলাম। কিন্তু হলের সেই পরিবেশ না থাকায় এবং দর্শকরা সেরকম সমঝদার না হওয়ায় ভালো এই সিনেমাটিও নির্বিঘ্নভাবে দেখা যায়নি। এ অবস্থায়তো রুচিশীল দর্শক হল বিমুখ হবেই।
সুরুজ আলী সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিপ্লব ঘটে যাওয়াকেও দায়ী করেছেন। ঘরে বসেইতো দর্শকরা ভারতীয় বাঙলা ও দেশি চ্যানেলগুলোতে বাঙলা সিনেমা দেখতে পারছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সিলেট নগরের তালতলা এলাকাতেই পাশাপাশি তিনটি সিনেমা হল ছিল। বছর পাঁচেক আগেও সেখানে প্রচুর ব্যবসা হয়েছে। দর্শক সমাগমও ছিল অনেক। এখন শুধুমাত্র `নন্দিতা` সিনেমা হলই টিকে আছে। অবকাশ ভেঙে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে `জননী মার্কেট`। দিলশাদে ঝুলছে `বিক্রয় হবে` বিজ্ঞপ্তি।
অপরদিকে নগরের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজার এলাকায় ছিল লালকুঠি ও রঙমহল নামে দু`টি সিনেমা হল। রঙমহল ভেঙে সেখানে রঙমহল টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। নাম থাকলেও সেখানে আর সিনেমা হল নেই।
একের পর এক সিনেমা হল বন্ধের কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা দর্শক শুণ্যতার কথাই বলছেন। তারা জানাচ্ছেন, নিম্নমানের চলচ্চিত্র আর একই অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দেখতে দেখতে সিনেমার প্রতি মধ্যবিত্তরাও নিরাসক্ত হয়ে পড়েছেন। অথচ বছর কয়েক আগেও মধ্যবিত্তদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। কিন্তু দিনদিন নিম্নমানের ছবি নির্মাণ ও চলচ্চিত্রের নামে অশ্লীলতা, বিকৃত অঙ্গভঙ্গি আর রুচিহীন শরীর প্রদর্শনীর কারণে পুরো সিনেমা ব্যবসাতেই ধস নেমেছে।
সাধারণ মূল্যবোধ সম্পন্ন লোকদের পক্ষেও এসব দেখা আর সম্ভব হচ্ছে না। পরিবার নিয়ে দেখারতো প্রশ্নই আসে না। দর্শক টানতে এক সময় সিনেমা হল মালিকরাও `কাটপিস` প্রদর্শন করে পয়সা কামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে এসব কাটপিস আর অশ্লীলতার বড় দুয়ার খুলে যাওয়ায় সেই চেষ্টাতেও বিফল হন হল মালিকরা।
ফলে সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে, বন্দরবাজারের লালকুঠি, বাঘবাড়ির মনিকা ও কদমতলীর কাকলি সিনেমা হল। বিদেশি চলচ্চিত্র (ইংলিশ) প্রদর্শনের নামে যৌনতা নির্ভর ছবি প্রদর্শন করে দর্শকদের রুচি নষ্ট করার অভিযোগ ছিল বিজিবি (সাবেক বিডিআর) অডিটোরিয়ামের বিরুদ্ধে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এখানে নিয়মিত দুটি ইংলিশ ছবি প্রদর্শন করা হতো।
এরমধ্যে একটি ছিল যৌনতা নির্ভর। এলাকাবাসী এসব ছবি বন্ধের জন্যে বারবার আবেদন-অনুরোধ জানালেও কাজ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে এই ধরনের ছবি প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়। এখন বিজিবি অডিটোরিয়ামে দেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন হলেও সেখানে নিয়মিত অশ্লীল কাটপিস প্রদর্শন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যবসা সচল রাখলেও নন্দিতা, বিজিবি ও জালালাবাদ সৈনক অডিটোরিয়ামের অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই করুণ। সেই মান্ধাতা আমলের আসন দিয়েই কোনো রকমে চলছে তাদের ব্যবসা। ছবি চলাকালে কাটপিস জুড়ে দেয়া ছাড়া নতুন কিছুই যোগ হয়নি। বাড়েনি দর্শক সেবাও। ফলে ছারপোকাসহ মশাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিনোদন’-এর নামে রুচিহীনতাকে গিলতে হয় দর্শকদের। সেখানে কোনো রুচিবানরা যেতে পারেন না।
নন্দিতা সিনেমা হলে ছবি দেখতে আসা মুদি দোকান কর্মচারি জামাল মিয়া জানালেন, সবগুলো ছবির গল্প প্রায় একই রকম। আবার অনেক ছবি হিন্দি ও ইংরেজি ছবির ‘হুবহু অনুকরণ’ বা কাটপিস ঢুকানো হয়। যে কারণে একবার ছবি দেখার পর দ্বিতীয়বার তা দেখার আগ্রহ থাকে না। পাশাপাশি হলগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, উন্নতমানের বসার ব্যবস্থা ও ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম ও উন্নত টয়লেট-ওয়াশরুম নেই। যে কারণে হলগুলো রুচিশীল দর্শকদের টানতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সিনেমা হল মালিক সমিতির সভাপতি কলন্দর আলী জাগো নিউজকে জানান, সিলেটে এখন এক নন্দিতা সিনেমা হলই টিকে আছে। তবে এটি পরিচালিত হচ্ছে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ঢাকার প্রতিষ্ঠান লিজ নিয়ে এটি পরিচালনা করছে।
একমাত্র বেসরকারি হল হওয়ার পরও সেটি দর্শক শূন্যতায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটিও যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ছবি ও হলের মান এবং অশ্লীলতাকে দর্শক কমে যাওয়ার কারণ মনে করেন তিনি।
সিলেট জেলা তথ্য অফিসের উপপরিচালক যুলিয়া জেসমিন মিলি জাগো নিউজকে জানান, চলচ্চিত্রের মান রক্ষা করতে ও ভালো মানের ছবি নির্মাণের জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর জন্যে সরকারি অনুদানও প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের কারণে দর্শকরা বাইরের মুভির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষত হিন্দি মুভি তাদের রুচিকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।
এছাড়া দেশীয় চলচ্চিত্রে কাটপিসসহ অশ্লীলতা ঢুকে পড়ায় সাধারণ মানুষও এর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এরপরও সুস্থধারার সংস্কৃতি চর্চার জন্য পারিবারিকভাবে দর্শন উপযোগী ভালোমানের ছবি নির্মাণের কোনো ত্রুটি করা হচ্ছে না। সিলেটের হলগুলো একের পর এক বন্ধ হওয়ার জন্যে হল মালিকদের অনৈতিক মুনাফার লোভ ও সেবার প্রতি অনিহাকে দায়ী করেন তিনি।
ব্রিটিশ আমলেই সিলেটে সিনেমা ব্যবসা চালু হয়। সিলেটে বঙ্গ বিহারী দাশ নামের এক বণিক প্রথম রঙমহল ও পরে লালকুঠি সিনেমা হল দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সিলেট টকিস নামে তা পরিচিত ছিল। এরপর ধীরে ধীরে অপর সিনেমা হলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়।
এমজেড/একে/আরআই