মুশফিকের সেঞ্চুরি যেন সাহসের ‘বাতিঘর’


প্রকাশিত: ০৯:১৭ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ক্যারিয়ারটা অনেক লম্বা। প্রায় একযুগের। ২০০৫ সালের মে থেকে শুরু। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে অভিষেক। স্টিভেন হার্মিসন, ম্যাথিউ হগার্ড, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ কিংবা সাইমন জোন্সদের অগ্নিঝরা ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে যেখানে জাভেদ ওমর, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুল, খালেদ মাসুদ পাইলটরা ব্যাট করতে নামছিলেন দুরু দুরু বুকে কাঁপন নিয়ে, সেখানে মাত্র মাত্র ১৮ বছর বয়সী এক তরুণকে ব্যাট করতে নামতে দেখে হয়তো ইংলিশরাই মনে মনে হাসছিলো সেদিন।

৬৫ রানেই ৪ উইকেটে হারিয়ে কাঁপছিল বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার। লর্ডসের উইকেটে তখন লিকলিকে, একহারা গড়নের মুশফিকুর রহীম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আম্পায়ারের কাছ থেকে গার্ড নিলেন। তার আগেই ইংলিশ পেসাররা একের পর এক বাউন্সার দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বুকের কাঁপনকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ওই সময় ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই সাইমন জোন্সকে মোকাবেলা করলেন মুশফিক।

বাংলাদেশ ওই ইনিংসে অলআউট হয়েছিলো ১০৮ রানে। এর মধ্যে তিনজন ব্যাটসম্যান ছুঁয়েছিলেন দুই অংকের ঘর। এর মধ্যে মুশফিকের রান ১৯। ৮৫ মিনিট টিকেছিলেন ক্রিজে। খেলেছেন ৫৬ বল। জাভেদ ওমর বেলিমই শুধুমাত্র তার চেয়ে বেশি ৪ বল খেলেছিলেন।

sohelমুশফিকের প্রথম অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার। লর্ডস টেস্টের আগে কখনোই ঘরোয়া ক্রিকেটে মুশফিকের সঙ্গে খেলা হয়নি তার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে নার্দাম্পটনে কাউন্টি ক্রিকেট দল নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে তিনদিনের প্রস্তুতি ম্যাচে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি হাঁকান মুশফিক। ১৬৭ বলে অপরাজিত ছিলেন ১১৫ রানে। ১৮ বছর বয়সী এতটুকুন একটা ছেলের ব্যাটে, ইংল্যান্ডের মাটিতে সেঞ্চুরি দেখে অবাক হয়ে যান হাবিবুল বাশার।

বাংলাদেশ দলের বর্তমান নির্বাচক পরে এ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, এর আগে আমি মুশফিকের সাথে কখনও খেলিনি। অথচ, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার আগেই প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরি করে বসলো সে। তার টেকনিক দেখে আমি অবাক। প্রথম দেখাতেই আমার মনে হলো, সে সত্যিই চমৎকার একজন ব্যাটসম্যান।’

এরপর তো লর্ডসে অভিষেকই হয়ে গেলো তার। ক্রিকেটের তীর্থস্থান নামেই পরিচিত ইংল্যান্ডের লর্ডস। কেউ কেউ বলেন, ক্রিকেটের মক্কা। ওই মাঠে বাংলাদেশেরও টেস্ট অভিষেক। লর্ডসে নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল হাবিবুল বাশার অ্যান্ড কোং। মুশফিকুর রহীমের ক্যারিয়ারেরই সূচনা হলো সেই মাঠ থেকে। ওই টেস্টের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে হাবিবুল বাশার বলেছিলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, লর্ডসে তার অভিষেকের সময় সে নার্ভাস ছিল না কি ছিল না, সেটা আমি জানি না। তবে, আমরা বাকিরা সবাই নার্ভাস ছিলাম। কারণ, লর্ডস এই প্রথম আমরা টেস্ট খেলতে নেমেছিলাম।’

খালেদ মাসুদ পাইলট তখন বাংলাদেশের সেরা উইকেটরক্ষক। তার উপস্থিতিতে ১৮ বছর বয়সী আরেকটা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে দলে নেয়াটা ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত বিষয়। চিন্তারও বাইরে। সেখানে তখনকার প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ মুশফিকুর রহীমকে দলে নিয়ে অনেকটা বাজিই খেললেন। মাত্র ৫ ফিট ৪ ইঞ্চ উচ্চতার এই ব্যাটসম্যানকে ঠেলে দিলেন ইংলিশদের আগুনঝরা পেস তোপের সামনে।

স্টিভেন হার্মিসন, অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ কিংবা সাইমন জোন্সদের বিপক্ষে মুশফিক যখন ব্যাট করার জন্য মাঠে নামছিলেন, তখন দুরু দুরু বুকে কাঁপন সৃষ্টি হয়েছিল তারও। ফারুক আহমেদ নিজেই এ কথা জানিয়েছিলেন পরে, ‘যখন লর্ডসের বুক ছিরে ধীরে ধীরে মুশফিক ব্যাট হাতে উইকেটের দিকে যাচ্ছিল, আমার মধ্যে তখন মিশ্র অনুভুতি তৈরি হয়েছিল। কারণ, তারা অনেক বেশি বাউন্সার দিচ্ছিল তখন। আমি চিন্তা করছিলাম, এত এত বাউন্সারের সামনে না কী অঘটন ঘটে বসে!’

braverdrink

এরপর তো মুশফিক ছোট্ট বয়সে যে সাহস দেখালেন, তা রীতিমত ভাষায় বলার অযোগ্য। ৮৫ মিনিট আগুনঝরা বোলিংয়ের সামনে টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা চার পেসার বল করছিলেন তখন। একের পর এক বাউন্সারে যেখানে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের হাঁটু কাঁপছিল, সেখানে মুশফিক বুক ছিতিয়ে ৫৬টি বল মোকাবেলা করলেন। ফারুক আহমেদ সেটাই স্মরণ করলেন এভাবে, ‘সে অনেক সাহস দেখিয়েছিল সেদিন। পরে এটা একটা দারুণ অনুভুতি তৈরি করেছিল।’

সেই সাহসটা ধীরে ধীরে মুশফিক সঞ্চার করে দিয়েছেন পুরো দলের মধ্যেই। নিজেই সেই সাহসকে পুঁজি করে এগিয়ে গেছেন একের পর এক। বাংলাদেশ দল নির্বাচনের পলিসিই পরিবর্তন করে দিলেন তিনি। আগে বাছাই করা হতো উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। মুশফিকের পর বাছাই করা শুরু হলো ব্যাটসম্যান-উইকেটরক্ষক।

লর্ডসে যে সাহস নিয়ে ক্রিকেট আঙ্গিনায় পথচলা শুরু হলো মুশফিকুর রহীমের, সেই সাহস নিয়ে এখনও পথ চলছেন বাংলাদেশ টেস্ট দলের বর্তমান অধিনায়ক। বাংলাদেশ বলেই হয়তো এক যুগের ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলা হয়েছে মাত্র ৫২টি; কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে তিনি পরিণত করেছেন বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে। শুধু সেরা ব্যাটসম্যানেই নয়, একজন ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। হায়দরাবাদ টেস্টে বাজে কিপিং কিংবা নেতৃত্ব নিয়েও তার প্রশ্ন উঠেছে। ভবিষ্যতে হয়তো কিপিং ছেড়ে দিতে হতে পারে, এমনকি নেতৃত্বও; কিন্তু একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে এখনও মুশফিকের বিকল্প তৈরি হয়নি টিম বাংলাদেশে।

৫২ টেস্টে ৩৪.৬৪ গড়ে রান করেছেন ৩০৪৯। হায়দরাবাদেই ছুঁয়েছেন তিন হাজারের মাইলফলক। তার চেয়ে বড় কথা, অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করে জবাব দিয়েছেন ভারতীয়দের। তৃতীয় দিন শেষ মুহূর্তে যখন মাত্র আর ২ বল বাকি, তখন তার ভাঙা আঙ্গুল লক্ষ্য করে বল করলেন ইশান্ত শর্মা। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলেন মুশফিক। ফিজিও এসে ব্যথানাশক স্প্রে দেয়ার পর আবার ব্যাট করতে দাঁড়িয়ে গেলেন। যেন সাহসের এক বাতিঘর। ইশান্তকে পরের বলে জবাবটা দিলেন দুর্দান্ত এক বাউন্ডারি মেরে। বুঝিয়ে দিলেন, যতই বাউন্স দাও কিংবা বল দিয়ে শরীরে আঘাত করো, সাহসে কখনও ছিড় ধরাতে পারবে না।

হায়দরাবাদে টেস্টের তৃতীয় দিনের শুরুতে উমেশ যাদব, ইশান্ত শর্মা আর ভুবনেশ্বর কুমার যেভাবে বোলিং করেছিলেন, সাকিব আল হাসান তাকে বর্ণনা করেছেন, ‘আমার ক্যারিয়ারে সম্ভবত একটি সেরা স্পেল মোকাবেলা করলাম।’ সেই বোলিংয়ের সামনে বুক চিতিয়ে ব্যাটিং করেছেন মুশফিকুর রহীমও। সাকিবের সঙ্গেই গড়েছিলেন ১০৭ রানের জুটি। এরপর মিরাজকে নিয়ে গড়েন ৮৭ রানের জুটি। নবম উইকেট জুটিতে তাইজুলকে নিয়ে গড়েন ৩৯ রানের জুটি।

শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরিটা করেই ফেললেন তিনি। ভারতের মাটিতে এসে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি উপহার দিলেন তিনি। ইশান্ত শর্মার মিস ফিল্ডিংয়ের পর বল ছুঁয়ে ফেলল বাউন্ডারির সীমানা। আম্পায়ারও সন্দিহান ছিলেন কিছুটা, বাউন্ডারি হয়েছে কি না তা নিয়ে। যখন হাত নেড়ে ইশারা করলেন, তখন তাসকিন এসে ঝড়িয়ে ধরলেন মুশফিককে। ব্যাট হাতে অভিনন্দনের জবাব দিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।

এই নিয়ে টানা দ্বিতীয়টি। সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে খেলেছিলেন ১৫৯ রানের দারুন এক ইনিংস। এরপর ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে। সব মিলিয়ে মুশফিকের ৫ সেঞ্চুরির পাঁচটিই এসেছে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন দেশে।

মুশফিকের এই সেঞ্চুরির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো, ক্যারিয়ারের ৫ সেঞ্চুরির চারটিই তিনি করেছেন বিদেশের মাটিতে। নিজ দেশের মাটিতে ২০১০ সালেই ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটি করেন মুশফিক। চট্টগ্রামে ওই সেঞ্চুরিটি হাঁকিয়ে তিনি আউট হয়েছিলেন ১০১ রান করে। এরপর দীর্ঘ বিরতি। সেঞ্চুরিরই দেখা পাচ্ছিলেন না। একবার ৯৫ বরে আউট হয়েছিলেন। সবশেষে ২০১৩ সালে শ্রীলংকার গলে খেললেন বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস।

তৃতীয় সেঞ্চুরি এলে ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কিংস্টনে। এরপর এবার নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়েলিংটনে খেললেন ১৫৯ রানের বড় ইনিংস। শুধু তাই নয়, ওই টেস্টে সাকিবকে নিয়ে গড়েন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৩৫৯ রানের বিশাল জুটি। এবার ভারতের বিপক্ষে হায়দরাবাদ টেস্টে খেললেন আরও একটি সাহসি ইনিংস। সেঞ্চুরির পর লোয়ার অর্ডারকে সঙ্গে নিয়ে করেছেন ১২৭ রান। তার এই সাহসে ভর করেই বাংলাদেশ করতে পেরেছে ৩৮৮ রান।

আইএইচএস/এমআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।