ফুটবলের বাইরে আমি একজন সাধারণ মানুষ : মেসি


প্রকাশিত: ০৬:৪৯ এএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

লিওনেল মেসি। কেউ বলেন তিনি স্রষ্টার আশ্চর্য সৃষ্টি, কেউ আবার বলেন তিনি নাকি মহামানব। ভক্তদের দৃষ্টিতে তিনিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার। যাদের পেলে-ম্যারাডোনার খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তাদের চোখ জুড়ায় মেসির খেলা দেখে। ফুটবল পায়ে সবুজ ক্যানভাসে যেন তিনি ছবি এঁকে যান। মন্ত্রমুগ্ধের মত মানুষ তাকিয়ে থাকে তার ড্রিবলিংয়ের দিকে।

সেই লিওনেল মেসি ফুটবলের বাইরে তার জীবনের বিশেষ কয়েকটি দিক নিয়ে হাজির হলেন মিশরীয় টিভি চ্যানেল ‌ওএন টিভির সামনে। সাংবাদিক আমর আদিবের প্রশ্নের জবাবে শুধু ফুটবলের বাইরে নয়, মাঠের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। যা প্রচারিত হয়েছে দু`দিন আগে। সেই সাক্ষাৎকারটিই জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দিয়েছেন রুশাদ রাসেল।  

প্রশ্ন : আপনি তো অনেক দাতব্য কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, আপনার নিজেরই মেসি ফাউন্ডেশন আছে। এছাড়া আপনি মিশরে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বিপক্ষে ক্যাম্পেইনের সঙ্গেও যুক্ত। এই ক্যাম্পেইন সম্পর্কে আমাদের বলুন।
মেসি : এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় এবং এই ক্যাম্পেইনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে আমারো খুব ভালো লাগছে। হেপাটাইটিসে আক্রান্তদের সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসতে এই ক্যাম্পেইনটি খুব বড় ভূমিকা রাখছে। পুরো কার্যক্রমে আমি খুশি।

প্রশ্ন : প্রতিদিনের জয়-পরাজয়ের চাপ কখনো কি ক্লান্ত করে দেয় না? যখন হারেন তখন নিজেকে কিভাবে সামাল দেন?
মেসি : খেলাটাই এমন আপনাকে প্রতিনিয়তই লক্ষ্য অর্জনের পিছনে ছুটতে হবে। অনেক ভালো দল আছে এবং তাদের সঙ্গে খেলাটা সবসময় সহজ নয়। কখনো হারবেন, কখনো জিতবেন। আমার কাছে মনে হয় যখন বয়স কম ছিলো তখনকার তুলনায় এখন হারগুলোকে সহজে মেনে নিতে পারি। এখন বুঝি এই খেলাটাই এমন, আপনি কখনো জিতবেন, কখনো না।

প্রশ্ন : মানুষ যখন হারের দায়ভার আপনার উপর চাপিয়ে দেয় সেটা কি আপনাকে পীড়া দেয় না? এই ধরুণ সবাই যখন বলে ‘আজকে মেসি গোল করতে পারেনি’ বা ‘মেসি আজকে ভালো খেলেনি’ এসব কথা পীড়া দেয়?
মেসি : না, মোটেই না। মিডিয়া বা এসব সমালোচনা সয়ে গেছে। আগেই বলেছি আমি দলীয় লক্ষ্যগুলোই পূরণের চেষ্টা করি। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সর্বোচ্চটা করি, এরপরেও অনেক সময় এতে কাজ হয় না, তখন শান্ত থাকার চেষ্টা করি।

প্রশ্ন : তাহলে বলতে চাচ্ছেন আলোচনা-সমালোচনা কিছু আপনাকে পীড়া দেয় না?
মেসি : হ্যাঁ, সেটাই। এতদিন এই পেশাদারি ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে শিখেছি কিভাবে মিডিয়া, সমালোচনাকে সামলাতে হয়। সবচেয়ে ভালো হলো এসব থেকে দূরে থাকা, ভালো বা মন্দ যাই বলুক না কেন।

প্রশ্ন : ইন্টারনেট খুললেই দেখা যায় মেসি বনাম অমুকের পরিসংখ্যান নিয়ে তুলনা হচ্ছে। এসবে কি বিব্রত হোন?
মেসি : না, আমার কাছে মনে হয় প্রত্যেকেই আলাদা। আমি প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে চাই, দলের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখতে চাই। আমার মনে হয় সব প্লেয়াররাই এভাবেই দেখে ব্যাপারটা। তুলনা করে বাইরের মানুষজন, প্লেয়াররা সেভাবে এসব আমলে নেয় না।

প্রশ্ন : অনেকেই জানতে চান আপনার ফ্রি কিকের রহস্য কি, কিভাবে এমন অসাধারণ গোল করেন? এগুলো কি অনেক প্র্যাকটিসের ফসল না ন্যাচারিলি করতে পারেন?
মেসি : এজন্য আলাদা কোনো প্র্যাকটিস করি না, নরমাল প্র্যাকটিসই করি। সকালে ট্রেনিংয়ে যাই, কখনো সারাদিন ট্রেনিং করতে হয়। ম্যাচের সূচি অনুযায়ী নির্ধারিত হয় কতক্ষণ ট্রেনিং করবো। আলাদাভাবে ফ্রি কিক প্র্যাকটিস সেভাবে করা হয় না। ট্রেনিং শেষে বাসায় ফিরি, ছেলেকে স্কুল থেকে আনি, পরিবারের সঙ্গে ডিনার করি। অন্যসব সাধারণ মানুষের মতই দিনটা কাটে (হাসি)।

প্রশ্ন : আপনি কি পরে আপনার ম্যাচগুলো কি আবার দেখেন?
মেসি : খুব একটা দেখা হয় না, হঠাৎ হয়তো দেখি। আসলে আমাদের সেভাবে সময় থাকে না। আমাদের অনেক ম্যাচ খেলতে হয়, অবসর সময় পাওয়া যায় খুব অল্প। মাঝে মাঝে যখন বিশেষ ম্যাচ হয়, হাতে সময় থাকে, তখন দেখা হয়। এমনিতে দেখি না।

প্রশ্ন : আপনি আজকে এখানে বিশ্বের সেরা প্লেয়ার হিসেবে বসে আছেন, যখন প্রথম বার্সায় এসেছিলেন এমন কিছু চিন্তা করেছিলেন?
মেসি : না, বার্সায় আসার সময় এমন কিছু চিন্তাও করিনি। শুধু একটাই স্বপ্ন ছিলো প্রথম একাদশের হয়ে খেলবো, প্রফেশনাল ফুটবলার হবো। এই বছরগুলোতে আমি অনেক স্বপ্নকেই বাস্তবে দেখতে পেয়েছি। তবে আজকের অবস্থানে আসবো সেটা কল্পনাও করিনি।

প্রশ্ন : আপনি বলেছিলেন যখন আর উপভোগ করবেন না অবসর নিয়ে নিবেন। আপনার মতে অবসরের সঠিক বয়স কোনটা??
মেসি : আসলে ব্যাপারটা তেমন না। আপনি কোনো নির্দিষ্ট বয়স বলতে পারেন না, আমি প্রফেশনাল ফুটবল ছেড়ে দিলেও তখন কোথাও না কোথাও ফুটবল খেলে যাবোই, সুযোগ পেলেই খেলবো। ৩/৪ বছর বয়স থেকেই এই খেলাটার সঙ্গে ভালোবাসা, প্যাশন জড়িয়ে, যতদিন খেলতে পারবো খেলবো।

প্রশ্ন : তারপরও আপনার কাছে কোন বয়সটাকে মনে হয় অবসর নেয়ার সময়?
মেসি : আপনার শরীরই আপনাকে সেটা বলে দিবে, একটা সময় এসে বলবে এবার থামা উচিত। প্রফেশনাল ফুটবলে ফিজিক্যালিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্লেয়ারের ক্ষেত্রে একেক সময়, প্রত্যেকের জন্যই আলাদা।

প্রশ্ন : আপনাকে অনেক বাজে ফাউলের স্বীকার হতে হয়, এটা আপনাকে বিরক্ত করে না?
মেসি : না, এটাই স্বাভাবিক। যখন প্রতিপক্ষ আপনাকে ফেলে দিবে, আপনি তখনো ভূমিকা রাখতে পারেন। আর রেফারি যদি আপনার পক্ষে সিদ্ধান্ত না দেয়, মেনে নিতেই হবে,এটাই ফুটবলের নিয়ম।

প্রশ্ন : এই দাঁড়ির পিছনের কারণটা জানতে পারি? সৌভাগ্যের জন্য বা অন্য কোনো কারণে?
মেসি : তেমন নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। যখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম, আমার মুখে দাঁড়ি ছিলো, আমরা ভালোও খেলছিলাম, তাই শেষ পর্যন্ত দাঁড়ি রেখেই দিই। আগের থেকে কোনো চিন্তাভাবনা করে রাখিনি।

প্রশ্ন : আপনি কি জানেন, আপনার ভক্তরা আপনার চুলের স্টাইল, দাঁড়ি সব অবিকল নকল করে?
মেসি : তাই নাকি, আমার জানা ছিলো না। এটা শুনে ভালোই লাগলো। তবে সবাই একই চুলের স্টাইল আর দাঁড়ি রাখলে (হাসি)।

প্রশ্ন : তাহলে আপনি দেখতেই পাচ্ছেন তরুণ প্রজন্ম আপনার স্টাইল অনুকরণ করছে, এটা কি আপনার উপর বাড়তি দায়িত্ব?
মেসি : আমি ভাবতেও পারিনি এই স্টাইল চ্যালেঞ্জ প্রভাবিত করতে পারে। আমি এভাবে ভাবি না। অনেকেই আমাকে দেখে, আমার মত স্টাইল অনুকরণ করে হয়তো। তবে আমি সবসময় নিজের পারসোনালিটির সঙ্গে মানানসই কিছু করার চেষ্টা করি, আমার মতই থাকতে চাই।

প্রশ্ন : অনেক খেলোয়াড়ই যেমন ধরুন জিদান অবসরের পর কোচ হয়েছে। আপনার কি এমন কোনো চিন্তা ভাবনা আছে?
মেসি : আমি সত্যিই জানি না। এই মুহূর্তে আমি কোচিং ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছিও না বা এই নিয়ে চিন্তিতও নই। হয়তো অবসরের কয়েক বছর পর আমি কোচিং করানোর কথা ভাববো। এখন আমি খেলাটাকেই উপভোগ করতে চাইছি এবং এসব নিয়ে ভাবতে চাইছি না, কারণ নিজেও জানি না ভবিষ্যতে কি হবে।

প্রশ্ন : আপনি অনেক প্লে-স্টেশন গেইমেই আছেন। গেমে নিজের পারফরমেন্সে কি সন্তুষ্ট?
মেসি : (হাসি) গেইমে অনেক কিছুই করা সম্ভব, যা বাস্তবে করাটা অনেকটাই অসম্ভব।

প্রশ্ন : তাহলে প্লেস্টেশন কি সহজ না কঠিন বলবেন?
মেসি : আমি বলতে চাইছি প্লে-স্টেশনে আপনি বাস্তব ফুটবলের চেয়ে অনেক বেশি কিছু করতে পারেন।

প্রশ্ন : এমন কোনো ম্যাচ আছে যেটাকে নিজের সবচেয়ে বাজে ম্যাচ হিসেবে মনে রেখেছেন? না বাজে হারগুলোকে ভুলে থাকতে পছন্দ করেন?
মেসি : অনেক হতাশাজনক ম্যাচই আছে, সব ম্যাচ তো জিততে পারিনি। সাম্প্রতিক সময়ে আর্জেন্টিনার হয়ে পরপর তিনটা ফাইনাল হার ভীষণ পীড়া দেয়। আমরা দারুণ কিছু অর্জন করতে চেয়েছিলাম, খুব কাছে এসেও পারিনি।

প্রশ্ন : আপনার অবসরের ঘোষণা শুনে পুরো বিশ্ব কষ্ট পেয়েছিলো, তবে যখন আপনি ফেরার ঘোষণা দেন সবাই খুশি হয়েছে। আপনি নিজে খুশি এই সিদ্ধান্তে?
মেসি : অবশ্যই, আমি খুব খুশি। আসলে আমরা এত ভালো খেলার পরও টুর্নামেন্ট জিততে না পারাটা ভীষণ হতাশ করেছিলো।

প্রশ্ন : কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানেন যে আপনার ফেরার সিদ্ধান্ত সবাইকে কতটা স্বস্তি দিয়েছে।
মেসি : আসলে সমর্থকদের জন্যও হারটা সহজ ছিলো না। তারাও আমাদের মত বিশেষ কিছু অর্জনের অপেক্ষায় ছিলো। তারাও ভীষণ হতাশ হয়েছে।

প্রশ্ন : যে কোনো সাক্ষাতকারেই আপনি কোন প্রশ্নটা আশা করেন আপনাকে করা হবে, কিন্তু কেউ কখনো সেই প্রশ্নটা করে না??
মেসি : ‌(হাসি) আমি জানি না। আমি অনেক সাক্ষাতকার দিয়েছি, সবাই আমার ব্যাপারে কম বেশি সবকিছুই জানে। আমি খুব সাধারণ থাকতে পছন্দ করি, আমি সরাসরি বলতেই পছন্দ করি। সবাই জানে আমি কেমন, নতুন করে খুব বেশি জানার কিছু নেই।

প্রশ্ন : মিশর ও অন্যান্য আরব কান্ট্রিগুলোর ভক্তদের জন্য কিছু বলতে চান??
মেসি : আমি খুব আনন্দিত এই ভেবে আমি এখানে মহতী এক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হতে পেরেছি।এই কাজের একজন হতে পেরে আমি খুশি এবং এই কাজের সুবাধেই এমন অনেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হবে যেখানে আগে যখন এসেছিলাম তখন যাওয়া হয়নি।

এমআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।