কেন হারল বাংলাদেশ?


প্রকাশিত: ০১:৫৫ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭

পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটের ১৪০ বছরের ইতিহাসে আজ ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ মাঠে একটি নতুন রেকর্ড তৈরি হল। সেটা হচ্ছে, ১৮৯৪ সালের পর মানে, ১২৩ বছরের মাথায় কোন দল টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫৮৬ রানের বেশি করে ওই ম্যাচ হারল এবং সেই দলটির নাম ‘বাংলাদেশ’।

এর আগে ১৮৯৪ সালে ১৪ ডিসেম্বর সিডনিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ৫৮৬ রান করেও শেষ পর্যন্ত ম্যাচ হেরেছিল স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া।

Babuআজ ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে সেই রানের চেয়ে ১০ রান বেশি করা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৬০ রান করে অলআউট হয়ে হারল ৭ উইকেটে। ৬০০ থেকে মাত্র ৫ রান কম কওে ম্যাচ হারা- এও কি সম্ভব?

আজ সারা দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় হাজারো প্রশ্ন, আচ্ছা প্রথমবার প্রায় ৬০০ রান করা দল ওই টেস্ট ম্যাচ হারে কিভাবে? ইতিহাসে কি এমন নজির আছে?

আশা করি সে সব প্রশ্নকর্তাদের মধ্যে যারা জাগো নিউজের পাঠক তারা অন্তত ছয় ঘন্টা আগেই  জেনে গেছেন, প্রথম ইনিংসে ৫৯৫ রান করে কোন দলের টেস্ট হারার রেকর্ড ছিল না। এত রান করে শেষ পর্যন্ত হারের রেকর্ডটা বাংলাদেশেরই।  

রেকর্ড তৈরিই হয় ভাঙ্গার জন্য। ১২৩ বছর পর বাংলাদেশ এমন অস্বাভাবিক হারের রেকর্ড গড়ল। ঠিক আছে, হয়ত এরপর অন্য কোন দল প্রথম ইনিংসে এর বেশি রান করেও হারবে। সেটা প্রশ্ন নয়।

প্রশ্ন হলো এই ম্যাচ বাংলাদেশ হারল কিভাবে? ৫৯৫ রানের পাহাড় সমান স্কোর গড়ার পরও মুশফিকের দল যদি প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে থাকতো তাহলেও একটা কথা ছিল।

বাংলাদেশ ৬০০‘র দোরগোড়ায় থামার পর নিউজিল্যান্ড পাল্টা ব্যাটিংয়ে নেমে যদি ৭০০ করে ফেলতো, তখন একটা কথা ছিল। বলা যেত কিউইরা ১০০ রান লিড নিয়ে ফেলেছে, দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিংটা ভাল হয়নি, তাই শেষ পর্যন্ত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে এগিয়ে ছিল। তাও ৫৬ রানে। এগিয়ে থাকার পর দ্বিতীয় ইনিংসে আড়াইশো রান করতে পারলেও লিড দাঁড়াত ৩০০ প্লাস। শেষ দিনে লাঞ্চের এক ঘন্টা পর শেষ ইনিংস শুরু করে চতুর্থ ইনিংসে ৩০০ করে জেতা যে কোন দলের জন্য কঠিন কাজ। হয়ত ব্ল্যাক ক্যাপসদের জন্যও বেশ কঠিনই হতো।

কিন্তু তার কিছুই হয়নি। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকা পর্যন্ত ঠিক ছিল। সাকিব আল হাসানের প্রথম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি, মুশফিকুর রহীমের ১৫৯ রানের ঝকঝকে তকতকে ইনিংস- দুয়ের যোগফল ৩৫৯ রানের বিশাল ও রেকর্ড পার্টনারশিপ।

তারপরও বোলিংটাও খারাপ হয়নি। টম লাথাম ত্রানকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ন না হলে হয়ত আরও বড়-সড় লিড হতো; কিন্তু এই কিউই একা লড়ে ১৭৭ রানের যে সংগ্রামী ইনিংসটি গড়লেন, তাতেই দু’দলের রান পার্থক্য অনেক কমে গিয়েছে।

মূলতঃ ওই ইনিংসটাই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে ধরে রাখলো। তারপরও ৫৯৫ রান করার পর কামরুল ইসলাম রাব্বি, সাকিব আল হাসান, শুভাশিস রায় মাহমুদউল্লাহ ও তাসকিন ভাল বল করার কারণে লিড মেলে। ব্যাস ওই পর্যন্তই।

প্রথম ইনিংসে ৫৬ রানে এগিয়ে থাকা পর্যন্তই ম্যাচে বেশ ভাল অবস্থানে ছিল বাংলাদেশের। এরপর যত সময় গড়িয়েছে ততই অবিন্যাস্ত-এলোমেলো হয়েছে সব। লক্ষ্য-পরিকল্পনাও হয়ত কম কাজ করেছে।

একদম সমালোচকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হবে, নিউজিল্যান্ড ইনিংস ৫৩৯ রানে শেষ হবার পর থেকেই টিম বাংলাদেশের পতন শুরু। মনে হয় মুশফিক, তামিম, ইমরুল, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ এবং সাব্বিররা হয়ত ধরেই নেন, ম্যাচ হারার পথ তো বন্ধই হয়ে গেছে। আমরা এবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বীরের মত লড়ে ড্র করতে যাচ্ছি।

কিন্তু খেলাটা পাঁচদিনের। পাঁচ ঘন্টার নয়। এখানে আগে যত রমরমা অবস্থাই থাকুক না কেন, খেলা যত অন্তিম পরিণতির দিকে যেতে থাকবে, ততই কার্যকর ও ধারাবাহিক পারফরমেন্স দরকার। সময়ের দাবি মেটাতে না পারলেই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়তে হবে।

মনে হয় এই বোধ-অনুভব ও উপলব্ধিতে খানিকটা কমতি ছিল। ক্রিকেটারদের সবাই না হলেও বড় অংশ হয়ত ধরেই নিয়েছলে, যাক বাবা এই ম্যাচে হয়ত অনেক দিন পর দেশের বাইরে এসে হার এড়াতে যাচ্ছি আমরা। ম্যাচ বোধ হয় ড্র হতে যাচ্ছে।

এ ধারনাটাই কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে শুধু রান করা আর উইকেটের পতন ঘটানোই শেষ কথা নয়। এ ফরম্যাটে সময়েরও রয়েছে বিশাল গুরুত্ব। সে উপলব্ধিতে পরিষ্কার ঘাটতি ছিল। সে কারণেই পর্যাপ্ত সময় ও উইকেট থাকার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে শুরু হয় বলগাহীন ব্যাটিং।

ভুল পথে হাঁটেন তামিম, সাকিব এবং মুমিনুল। তারা যদি হিসেব কষে ব্যাটিং করতেন তাহলে সবার এত তাড়াহুড়ো ও বিগ শট খেলার তাড়া থাকতো না। তার বদলে সবাই রয়ে-সয়ে ধৈর্য্যকে পুঁজি করে ব্যাট চালাতেন। তাতে আপনা-আপনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসটা বেশি সময় ধরে চলতো।

প্রথম বার ১৫২ ওভার ব্যট করা দল খুব খারাপ করলেও হয়ত তার অর্ধেক সময় ধরে ব্যাট করবে। তাহলেও ৭৬ ওভারে মত সময় উইকেটে কাটানো উচিত ছিল। একবার ভাবুন, সে জায়গায় দ্বিতীয় ইনিংসে বালাদেশ ব্যাট করেছে মাত্র ৫৭.৫ ওভার। তার মানে দ্বিতীয় ইনিংসে অর্ধেক খারাপ ব্যাটিং করলেও এ ইনিংসের দৈর্ঘ্য বাড়ার প্রয়োজন ছিল অন্ততঃ আরও ২০ ওভার বেশি।

তাহলে অনায়াসে ম্যাচ ড্র করে ফেলা যেত। কারণ ২০ ওভারে ৬০ থেকে ৭০ রান বেশি আসতো। তার চেয়েও বড় কথা, বাংলাদেশ যে সময়ে অল আউট হয়েছে, তার চেয়ে অন্তত দেড় ঘন্টা পর ইনিংস শেষ হতো। ইনিংস লম্বা হলে, আপনা-আপনি ম্যাচের দৈর্ঘ্য বেড়ে যেত। তখন আর এভাবে হয়তো হারতে হতো না।

কারণ, তখন বাংলাদেশের লিড দাঁড়াত ৩০০‘র বেশি। নিউজিল্যান্ডের সামনে লক্ষমাত্রা দাঁড়াত ৩০০ প্লাস রান। তারা হয়ত তখন ৫০ ওভারেরও কম সময় পেত। টেস্টে চতুর্থ দিন ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৩০০ প্লাস করে জেতা বেশ কঠিন।

কিন্তু তার বদলে কিউদের সামনে লক্ষ্য মাত্রা দাঁড়াল মাত্র ২১৭। হাতে ছিল ৫৭ ওভার। বাংলাদেশ দলের কারো কারো লক্ষ্যবিহীন ব্যাট চালনা আর দূর্ভাগ্য সঙ্গী হলে পরাজয় অনিবার্য্য হয়ে ওঠে। যে পঞ্চ পান্ডবের ওপর দল নির্ভর করে তার শীর্ষ তিন- তামিম (২৫), মাহমুদউল্লাহ (৫) ও সাকিব (০)  দ্বিতীয় ইনিংসে কিছুই দিতে পারেননি। তিনজনের সংগ্রহ ছিল মোট ৩০।

এখানেই নির্ধারিত হয়ে গেছে খেলার ভাগ্য। এই তিনজনের অন্তত একজনও যদি লম্বা ইনিংস খেলতে পারতেন, তাহলেই ভিন্ন হত চালচিত্র। তামিম স্বীকার করেছেন, তাদের অ্যাপ্রোচে খানিক ভুল ছিল। এ ভুলের সাথে যোগ হয়েছে ইনজুরির ভয়াল থাবা।

দ্বিতীয় ইনিংসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একজোড়া ইনজুরির ঘটনা ঘটেছে। প্রথমটি হলো চতুর্থ দিন পড়ন্ত বিকেলে। তামিমের সাথে ভালই এগুচ্ছিলো ইমরুল কায়েসের জুটি। দেখে মনে হল নিজেকে ফিরে পেয়েছেন- ‘আজ ইমরুলের ব্যাট জ্বলে উঠবেই।’ হয়ত একটা বড় ইনিংসও বেরিয়ে আসতে পারে।

braverdrink
কিন্তু হায় ২৫ রান করার পর হঠাৎ উরুর ইনজুরির শিকার হলেন তিনি। এটা প্রথম ধাক্কা। এরপর দ্বিতীয় ধাক্কা মুশফিকের মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়া। কিউই বাঁ-হাতি ফাস্ট বোলার টিম সাউদির বাউন্সার থেকে চোখে সরিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে বিপর্যয় ডেকে আনলেন মুশফিক। মাথার পেছনে হেলমেটের ওপর দিয়ে ঘাড়ের আশাপাশে ব্যথা পেলেন মুশফিক। তার পক্ষে আর মাঠেই নামা সম্ভব হয়নি।

মোদ্দা কথা দ্বিতীয় ইনিংসে দু’দুজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানের সার্ভিস প্রায় না পাওয়া, অর্থাৎ দ্বিতীয় ইনিংসে সতর্ক-সাবধানী ব্যাটিংয়ের কমতি, দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে ইনজুরির ভয়াল থাবা। মুলতঃ এই দুয়ে মিলেই ম্যাচ হেরে যাওয়া।

টেস্ট ক্রিকেট ৫ দিনেরন এবং ১৫ সেশনের খেলা। এক, দুইদিন কিংবা তিনদিন ভাল খেলেও শেষের দিকে গিয়ে বড় ধরনের ভুল করে পিছিয়ে পড়ে অনভিজ্ঞ দলগুলো। সেটাই হয়েছে বাংলাদেশের।

সাড়ে তিনদিন ব্যাটিং ও বোলিংয়ে এগিয়ে থাকা দল, দু’দিনের দুটি ভিন্ন সেশনে দায়িত্বহীন ব্যাটিং করেছে। তারই মাশুল এ পরাজয়। টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি সেশন ভাল খেলতে হবে। এক সেশনে ভাল খেলে পরের সেশনে আবার সব খুইয়ে ফেললে হবে না।

ধারাহিকতা রাখতে হবে প্রতিদিনের প্রতি সেশনের খেলায়। তবেই টেস্ট সাফল্যের সূর্য্য উঠবে। না হয় হটাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে আবার ঘন মেঘে ঢেকে যাবে সব কিছু।

এআরবি/আইএইচএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।