ভুল অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশনে ভেস্তে গেল অমন সুন্দর শুরু


প্রকাশিত: ০৩:৫৫ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েস যখন ব্যাট করছিলেন, তখন এক ওভার থেকে আরেক ওভারের ব্রেকে হঠাৎ সাউন্ড বক্সে বেজে উঠল মমতাজ বেগমের জনপ্রিয় গান ‘ খাইরুন লো..., তোর ঐ লম্বা লম্বা চুল..., চিরল চিরল...।’

নেলসনের স্যাক্সটন ওভালে বাংলা গান। তাও দেশ বরেণ্য শিল্পি মমতাজ বেগমের জনপ্রিয় গান। ম্যাচ দেখতে আসা অল্প কিছু বাঙ্গালি দর্শক আর প্রেস বক্সে বসা বাংলাদেশি সাংবাদিকের মধ্যে অন্যরকম রোমাঞ্চ।

কিন্তু বড় জোর মিনিট খানেক শোনা গেল মমতাজ বেগমের সেই সুরের মূর্ছনা। তারপরই থেমে গেল সব। প্রথম ইনিংসের পুরো সময় ব্রেকে শুধু জনপ্রিয় ইংলিশ মিউজিকই বাজল। হঠাৎ বেজে ওঠা মমতাজ বেগমের গান অল্পতে থেমে যাবার মতই অবস্থা বাংলাদেশ ব্যাটিংয়েও। বলা ভালো পুরো ইনিংসেও।

Babuসকালে কি দারুণ সূচনা ! তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েস এমন আস্থা ও আত্ববিশ্বাস নিয়ে ব্যাটিং করছিলেন যা দেখে মমতাজ বেগমের গানের মতই পুলক জাগাচ্ছিল মনে। দুই ওপেনারের ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ ও অ্যাপ্লিকেশন দেখে মনে হচ্ছিল, আগের দিনের কথা বুঝি সত্য হতে যাচ্ছে। তিন নম্বর ওয়ানডেতে এসে বুঝি সত্যিই নিজেদের খুঁজে পেয়েছে টাইগাররা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বৃহস্পতিবার সবার কণ্ঠে ছিল প্রথম দুই ম্যাচের ভুল ত্রুটি কাটিয়ে ওঠার দৃঢ় প্রত্যয়। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা থেকে শুরু করে প্রতিটি সদস্যর মুখে শোনা গেছে দুটি সংলাপ, ‘নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন ও উইকেট সম্পর্কে ধারনা জন্মেছে আমাদের। সেই ধারনা কাজে লাগিয়ে আর আগের দুই ম্যাচে করা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সেরাটা দিতে চাই শেষ ম্যাচে।’

তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েসের শুরুর ব্যাট চালনা দেখে মনে হলো সত্যিই বুঝি নিউজিল্যান্ড কন্ডিশনের সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছে টাইগাররা। আগের দুই ম্যাচের ভুল ত্রুটি কাটিয়ে শনিবার বুঝি রান পাহাড় গড়ে তুলবে মাশরাফির দল। সিরিজে প্রথমবারের মত উদ্বোধনী  জুটি ৫০ পেড়িয়ে গেল। ১১.১ ওভারে বিনা উইকেটে স্কোর ৫০। ঠিক ২০.৩ ওভারে অফস্পিনার জিতেন প্যাটেলের বল সীমানার ওপারে পাঠালেন তামিম। বিনা উইকেটে রান গিয়ে ঠেকল ১০০‘তে।

এরচেয়ে সুন্দর সূচনা আর কিইবা হতে পারে। এমন সাবলীল ও শক্ত ভীতের ওপর দাড়িয়ে ৩০০`তে পৌঁছে যাওয়া যায়। ভক্ত ও সমর্থকরা যখন ৩০০`র আশপাশে স্কোরের চিন্তায় মগ্ন, ঠিক তখন বিনা মেঘে বজ্রপাত। অপ্রয়োজনীয় শট খেলে উইকেট বিসর্জন ইমরুল কায়েসের। বোলার ছিলেন মিচেল সান্টনার। এই বাঁহাতি স্পিনারের বলে স্লগ সুইপ খেলতে গিয়ে আকাশে তুলে বিদায় নিলেন ইমরুল। তার ব্যাটের বাইরের কোনায় লেগে বল উঠে গেল আকাশে। শর্ট থার্ডম্যান থেকে বেশ খানিকটা ডানে দৌড়ে অনেকটা অ্যাক্রোবেটিক কায়দায় এক হাতে তা ধরে ফেললেন ব্রুম।

মুখে ভুল ত্রুটি কাটিয়ে ওঠার কথা বললেও আবারও ভুল পথে পা বাড়ালেন ইমরুল। ওভার প্রতি ৫ রানের ওপরে আসছে। একটু রয়ে সয়ে ইনিংসকে আরও লম্বা করি, খালি এমন ভেবে ব্যাট করলেই চলতো। কিন্তু ইমরুল তার ধার কাছ দিয়েও গেলেন না। এ বাঁহাতি ওপেনারের ৬২ বলে ৪৪ রানের ঐ ইনিংস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভোজ বাজির মত বদলে গেল বাংলাদেশ ইনিংসের দৃশ্যপট।

পরের ৬৬ রানের ভিতরে সাজ ঘরে পা বাড়ালেন পাঁচ ব্যাটিং স্তম্ভ সাব্বির রহমান রুম্মন, মাহমুদউল্লাহ, তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান। কিউই বোলাররা দুর্দান্ত বোলিং করলে তবু একটা কথা ছিল। মানা যেত বোলিংটা ভাল হয়েছে। কিছু ডেলিভারি আনপ্লেয়েবল ছিল, তাই হয়ত পর পর উইকেটের পতন ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি।

একদম নিজেদের ভুলে ও বাজে শট খেলে আউট হলেন দলের চার সেরা উইলোবাজ সাব্বির, মাহমুদউল্লাহ, সাকিব ও তামিম। অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন ছিল চোখে লাগার মত খারাপ। শুরুর ২০-২৩ ওভার আর শেষ দিকে অনভিজ্ঞ নুরুল হাসান সোহানের ইনিংস টুকু বাদ দিলে তামিম, সাব্বির , মাহমুদউল্লাহ ও সাকিবের মত পরিণত অভিজ্ঞ পারফরমাররা দায়িত্ব সচেতনতার পরিচয় রাখতে পারেননি। তাদের দায়িত্বহীনতার কারণেই একটা বড় সড় স্কোর গড়ার পথ হলো রুদ্ধ।

এর মধ্যে তামিম ছিলেন শতভাগ ওয়েল সেট হয়ে। ইনিংসের অর্ধেক শেষ হবার আগে ( ২৩.২ ওভার ) পঞ্চাশে পৌঁছে যাওয়া তামিমের সামনে ছিল লম্বা ইনিংস খেলার পর্যাপ্ত সময় ও অবারিত সুযোগ। নিকট অতীতে বিশেষ করে বিপিএলে নিজের সহজাত ও স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্তক ব্যাটিং বাদ দিয়ে এক প্রান্ত আগলে রাখার পাশাপাশি রান চাকা সচলের কাজটি বেশ দক্ষতার সাথে করে দেখানোর কারণে তার প্রতি সবার বিশ্বাসটাও বেড়েছে বেশি। ভাবা হচ্ছিল ইমরুল মধ্য চল্লিশে ফিরলেও তামিম হয়ত আর ভুল পথে পা বাড়াবেন না।

কিন্তু বাস্তবে হলো তার উল্টোটা। হাতে প্রচুর ওভার থাকা সত্বেও তামিম অযথা বেপরোয়া শট খেলতে গিয়ে নিজের উইকেট দিয়ে আসলেন। কিউই ফাষ্ট বোলার জেমস নিশামের বলে ৫৯ ( ৮৮ বলে) রান করে অযথা ক্রস ব্যাটে স্লগ করতে গিয়ে আকাশে ক্যাচ তুলে দিলেন তামিম।

অবশ্য তামিম ফেরার আগেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসে লাগল। ইমরুল ফেরার পর উইকেটে এসেই নয়ন জুড়ানো কভার ড্রাইভ , স্কোয়ার কাট ও পুল করে বাউন্ডারি হাকানো সাব্বিরের আকর্ষণীয় ইনিংসটি জ্বলে ওঠার আগেই নিভে গেল। মাত্র ১৪ বলে চার বাউন্ডারিতে ১৯ রান করা সাব্বির আউট হলেন কিউই পেসার হ্যানরির লেগ স্টাম্পের বাইরে পরে বেড়িয়ে যাওয়া ডেলিভারিকে অযথা গ্ল্যান্স, ফ্লিক ও পুলের মাঝামাঝি গোছের শট খেলতে গিয়ে। বল ব্যাটের ওপরে লেগে চলে গেল কীপার রঞ্চির গ্লাভসে।

braverdrink
 
প্রসঙ্গত, প্রথম ওয়ানডেতে প্রায় একই ধরণের বলে ঠিক একই শট খেলতে গিয়ে ডাউন দ্যা লেগে ক্যাচ তুলে ফেরত আসেন ইমরুল কায়েস। আর এ সফরে এসে হঠাৎই নিজেকে খুঁজে ফেরা মাহমুতউল্লাহ আবার ব্যর্থতার ঘানি টানলেন। আগের দুই ম্যাচে ০ ও ১ রান  করা মাহমুউল্লাহ ( ৩) আউট হলেন নিউজিল্যান্ড ফাষ্টবোলার টিম সাউদীর একটা খাট লেন্থের ডেলিভারিতে। পেট ও বুকের মাঝামাঝি উচ্চতায় থাকা ঐ বলকে অনসাইডে য তোন জায়গা দিয়ে সাজঘরে ফেরত পাঠানো যেত। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ আড়ষ্ট হাতে যে পুল শটটা খেললেন তা গিয়ে জমা পড়ল ৩০ গজে দাঁড়িয়ে থাকা নেশামের হাতে।

সাকিব-মোসাদ্দেক ক্ষত সাড়িয়ে ইনিংসকে নতুন ভাববে সাজানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু হায় অফস্পিনার জিতেন প্যাটেলের সোজা ডেলিভারিতে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়ালেন মোসাদ্দেক ( ১১)। এরপর সাকিব হলেন রান আউট (১৮)। ১৭৯ রানে ৭ উইকেট পতনের পর মনে হলো অমন সুন্দর সূচনার পরও বুঝি ২০০ হবে না।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্কোর গিয়ে ঠেকল ২৩৬  এ। এটা সম্ভব হলো নুরুল হাসান সোহানের দৃঢ়তায়। আহত মুশফিকুর রহিমের বদলে সুযোগ পাওয়া এ তরুন প্রানপন চেষ্টা করলেন দলকে সামনে এগিয়ে নিতে। সিনিয়র ও অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের দূর্বল ও ভুলে মাখা অ্যাপ্রোচ- অ্যাপ্লিকেশনের দিনে এই তরুণ কিছু সময় মাথা ঠান্ডা রেখে সিঙ্গেলস-ডাবলসে খেলে খেলে শেষ দিকে হাত খুলে করলেন ৩৯ বলে ৪৪। আর তাতেই স্কোর ২৩০‘র ঘরে।

জীর্ণ- শীর্ণ অবস্থার উত্তোরণ ঘটলেও আক্ষেপ-অনুশোচনা থেকেই গেল। অমন সুন্দর শুরু । প্রথম উইকেটে ১০০ পেরিয়ে যাবার পরও শেষ পর্যন্ত রান আড়াইশো হলো না। আফসোস থেকেই গেল।

এআরবি/এমআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।