নতুন আলোর সন্ধানে এবারের বিপিএল!


প্রকাশিত: ০৬:২৩ পিএম, ০৩ নভেম্বর ২০১৬

ঘুরে-ফিরে প্রতিবার এক অদ্ভুত তাড়াহুড়ো? কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও কাজ যেন শেষ মুহূর্তের জন্য রেখে দেয়া হয়। বিপিএল শুরুর সময় যত ঘনিয়ে আসে, নানা কাজকর্ম তত বাড়ে। শেরে বাংলায় ব্যতিব্যস্ত লোকজনের আনাগোনাও তত বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। আসর শুরুর ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে ঘোষণা হলো টাইটেল স্পন্সরের নাম।

বৃহস্পতিবার দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ হয়েছে শেরেবাংলায়। নাহ, স্টেডিয়াম পরিচর্যা, আলোকসজ্জা কিংবা সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ নয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে টাইটেল স্পন্সরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ঠিক পর পরই শুরু হয়ে গেল প্রমাণ সাইজের ‘শাহ সিমেন্ট’ লেখা সাইট স্কিন কভার বসানোর। আউটফিল্ডের চারিদিকে বিলবোর্ড বসানোর কাজও শুরু হয়েছে অনেক দেরিতে। মোদ্দা কথা, বৃহস্পতিবার দুপুর গড়ানোর পর থেকেই আসলে বোঝা যাচ্ছে দেশীয় ক্রিকেটের অন্যতম জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় টি-টোয়েন্টি আসর বিপিএল শুরু হতে যাচ্ছে।

তার আগে গতকাল বুধবার বিকেলে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম ও তার আশপাশ ঘুরে যাওয়া কেউ টেরই পাননি বিপিএল ধামাকা দরজায় কড়া নাড়ছে; কিন্তু বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই সাজ সাজ রব। বোঝা গেল এখানে শিগগিরই কোনো ক্রিকেট যজ্ঞ হবে। পড়ি কী মরি করে নানা কাজকর্মে ব্যস্ত অনেকে। এই যে প্রতিবার একদম শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি শুরু এবং খেলা শুরুর আগে পর্যন্ত কাজকর্ম চলা- এটা যে প্রায় নিয়ম ও রীতি হয়ে গেছে, তার যথাযথ ব্যাখ্যা নেই।

তবে আয়োজক বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছেন, ‘শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো না করে কী করবো বলুন? এই তো সেদিন পর পর দুুটো সিরিজ হয়ে গেল। প্রথমে আফগানিস্তানের সাথে ওয়ানডে সিরিজ। তারপর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। তাই পর্যাপ্ত সময় মেলেনি। এ ব্যাখ্যা একদম প্রত্যাখ্যান করার মতোও নয়। ৩০ অক্টোবর খেলা শেষ হয়েছে। মাঝে সময় মিলেছে মোটে চার দিন। তবুও আয়োজকরা দু’দিন সময় পেয়েছেন। বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের শেষ টেস্ট পুরো পাঁচ দিন চললে ১ নভেম্বর পর্যন্ত মাঠ ব্যস্ত থাকতো।

যেহেতু টাইটেল স্পন্সর থেকে শুরু করে সহযোগী স্পন্সর- সব ভিন্ন, তাই মাঠ ঢেলে সাজানোর কাজে পাওয়া যেত মোটে ৪৮ ঘণ্টা। সেদিক থেকে প্রস্তুতিতে দু’দিন বোনাস সময় মিলেছে। আগে ভেন্যু বাড়ানো এবং হোম অ্যান্ড অ্যাওয়েতে খেলা অনুষ্ঠারে কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হচ্ছে না।

তবে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক বললেন, ‘আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ছাড়া বাইরে ৭ বিভাগীয় শহরে খেলা আয়োজন সম্ভব না। তাই রাজধানী ঢাকার বাইরে শুধু চট্টগ্রামে খেলা হবে।’ প্রথমে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে খেলা হওয়ার কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত শেরে বাংলার পাশাপাশি বন্দর নগরীতে খেলা হবে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে।

ঢাকায় টানা ১০ দিন খেলার পর বিরতি। ১৩ নভেম্বর ঢাকায় প্রথম পর্ব শেষ। ১৭ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম পর্ব। ২২ নভেম্বর শেষ হবে চট্টলা পর্ব। ২৫ নভেম্বর থেকে আবার শেরে বাংলায় শুরু শেষ অংশ। এবার সময়সূচিতে খানিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। শুক্রবার দিন জুমার নামাজের কারণে খেলা শুরু হবে আধ ঘণ্টা দেরিতে; বেলা আড়াইটায়। অন্য দিন খেলা মাঠে গড়াবে দুপুর ২টায়।

চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স আর নতুন নামে নতুন করে ফিরে আসা রাজশাহী কিংসের। শুক্রবারের উদ্বোধনী ম্যাচ শুরু হবে দুপুর আড়াইটায়। প্রথম দিনের দ্বিতীয় ম্যাচটি রংপুর রাইডার্স ও খুলনা টাইটান্সের মধ্যে। শুরুর সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টা। আয়োজকদের প্রস্তুতি দেরিতে শুরু হলেও দলগুলো অন্য যে কোনো বারের তুলনায় একটু আগে সময় নিয়ে শুরু করেছে। গড়পড়তা প্রায় ৪ থেকে ৫ দিন আগেই শুরু হয়ে গেছে অনুশীলন।

তার মানে প্রায় এক সপ্তাহর অনুশীলনে মাঠে নামার সুযোগ থাকছে এবার। জাতীয় দলের অধিনায়ক ও বিপিএলে সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা এই আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। তার কথা, আমরা খেলোয়াড়, আমাদের খেলার মাঠটা ঠিক থাকা জরুরি। মাঠে যেন আমরা ক্লিয়ার ক্রিকেট খেলতে পারি। আমাদের সেদিকে ফোকাস রাখতে হবে। আর বাইরের জিনিসিটা আমাদের ভাবার বিষয় না।’

কিন্তু ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের বিষয়টাও তো আছে। প্রায় প্রতিবার আসর শেষ হওয়ার পরও পারিশ্রমিক পেতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে ক্রিকেটারদের। মাশরাফির ব্যাখ্যা, ‘সেটাও এখন আর আমাদের অত ভাবনার বিষয় নয়। এখন তো বোর্ড সমুদয় দায়দায়িত্ব নিয়েছে। এখন তো পেমেন্ট নিয়ে আগের সেই চিন্তাটা নেই। ফ্র্যাঞ্চাইজিরা টাকা না দিলে বোর্ড পেমেন্ট করে দেয়। তো এটা নিয়ে আমাদের ভাবার সুযোগও নেই। আর শেষ বছর যদি দেখেন, দেখবেন বেশির ভাগ দলই পেমেন্ট দিয়ে দিয়েছে।’

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যিনি টিম বাংলাদেশের ‘প্রাণভোমরা’ সেই সহযোগীদের অনুপ্রেরণার প্রতীক ও টিম ম্যানেজমেন্টের সর্বোচ্চ আস্থা যার ওপর- সেই মাশরাফি মনে করেন দেশের ক্রিকেটে বিপিএল ইতিবাচক ভূমিকাই রাখছে। আমি মনে করি, ‘বিপিএল এখন খুব ইতিবাচকভাবে এগোচ্ছে। খেলোয়াড় হিসেবে চাই আমরা সবাই যেন মাঠের খেলাটা ঠিকমতো খেলতে পারি।’

ঠিক মনোজ্ঞ বলা যুক্তিযুক্ত হবে কি না? তা নিয়ে আছে ছোট্ট প্রশ্ন। তবে আগের তিনবারের প্রতিবার জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে। যেখানে ভারতের অনেক নামি তারকা অংশ নিয়েছেন; কিন্তু এবার কোনো উদ্বোধনী পর্বই নেই। কেন নেই?

আয়োজক মহল থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ-ইংল্যান্ডের সিরিজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১ নভেম্বর। তারপর কনসার্ট করে আবার মাঠ খেলা উপযোগী করতে সময় লাগতো বেশি। তাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাদ দেয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি তারকাদের সম্মিলনে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানই বন্ধের পাশাপাশি স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কমেছে। আইকন ক্রিকেটার মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সৌম্য সরকার ও সাব্বির রহমান রুমানের দরও আগের যে কোনো বারের তুলনায় এবার কম। সাকিবকে দেয়া হয়েছে ৫৫ লাখ। মাশরাফি, মুশফিক, তামিম ও মাহমুদউল্লাহ পেয়েছেন ৫০ লাখ টাকা করে।

আর দুই নতুন আইকন সৌম্য সরকার ও সাব্বির রহমান রুম্মন পাচ্ছেন ৪০ লাখ করে। তবে ভেতরের খবর, ওই অর্থের বাইরেও সাকিবসহ আইকন ক্রিকেটাররা বাড়তি টাকা পেয়েছেন। স্থানীয় ক্রিকেটারদের পাশাপাশি একই সঙ্গে ম্যাচ রেফারি, আম্পায়ার ও স্কোরারদের ম্যাচপ্রতি পারিশ্রমিকও ছেঁটে ফেলা হয়েছে। বিপিএল মানেই ধুম-ধাড়াক্কা ক্রিকেট। চার ছক্কার ফুলঝুরি। গ্যালারিতে সব বয়সী দর্শকের ভিড়। ক্রিকেটের পাশাপাশি বিনোদন ও বিপণনের অবারিত সুযোগ। বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান না থাকায় খালি চোখে সেই বিনোদনের খোরাক একটু কম মনে হচ্ছে।

তাই বলে বিপিএলের আকার, পরিধি ও ডামাডোল কম নয়। সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগীদের উৎসাহ-আগ্রহ আগের মতোই আছে। বরং ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট জয়ের পর ক্রিকেট নিয়ে উৎসাহ-আগ্রহ বেড়েছে আরও। অনেকের মতে, আগের যে কোনো বারের তুলনায় এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ভালো খেলবেন। কারণ ক্রিকেটের বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে খেলতে তাদের সাহস, প্রত্যয়, মনোবল, সামর্থ্যেরে প্রতি আস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। মাঠে তার প্রতিফলন দেখার অপেক্ষায় তাই অগণিত ক্রিকেট ভক্ত।

পাশাপাশি এবারো ক্রিস গেইল, কুমারা সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়বর্ধনে, তিলকারত্নে দিলশান, শহীদ আফ্রিদি, ডোয়েন ব্রাভো, মারলন স্যামুয়েলস, আন্দ্রে রাসেলের মতো বিশ্ব তারকারা ব্যাট ও বল হাতে মাঠ মাতাতে আসছেন এবার। দেশের তিনটি প্রসিদ্ধ কর্পোরেট হাউস বেক্সিমকো, জেমকন ও  ডিবিএলসহ সাত সাতটি প্রতিষ্ঠিত কর্পোরেট হাউস এবার ফ্র্যাঞ্চাইজি। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ক্রিকেটে শুধু পরতে পরতে উত্তজনা আর আকর্ষণ নয়, অনিশ্চয়তাও অনেক বেশি।

যে কোনো সময় যে কোনো ঘটনা ঘটে যায়। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ওঠা-নামা আরও বেশি। তাই কাগজে কলমের হিসেব কষে লাভ নেই। মাঠে অনেক সময়ই তা মেলে না। তারপরও বেশিরভাগ ক্রিকেট অনুরাগী ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞ কাগজে-কলমে সাকিব আল হাসানের ঢাকা ডায়নামাইটস আর তামিম ইকবালের চিটাগাং ভাইকিংসকে অন্য দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে রাখতে চান। তবে আগের তিনবার যিনি হেসেছেন শেষ হাসি- সেই মাশরাফি বিন মর্তুজার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকেও খাটো করে দেখতে চান না অনেকেই। দেখা যাক, অনিশ্চয়তা ভরা এ আসরের শেষ হাসি হাসে কোন দল?

তাদের সঙ্গে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, খালেদ মাহমুদ সুজন ও খালেদ মাসুদ পাইলটরা বিভিন্ন দলের সঙ্গে জড়িত। সব মিলে টেস্টে অমন আলো ঝলমলে পারফরম্যান্স এবং বিরাট প্রাপ্তির পর এবারের বিপিএল বাড়তি আলো ছড়াবে। মাঠ মাতাবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জয়গানে মুখর থাকবে। আর অন্তত দু’তিনজন নতুন তারার আবির্ভাব ঘটবে- এমন আশা করাই যায়, কী বলেন?

জাগো চ্যাম্পিয়নের ১৪তম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

আইএইচএস/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।