আশরাফুলের আংশিক মুক্তি ও কিছু কথা


প্রকাশিত: ১০:২২ এএম, ৩০ আগস্ট ২০১৬

কথায় বলে ‘১৩’ নাকি অপয়া! শুধু কথার কথা বলা কেন, ১৩ সংখ্যাকে সত্যি সত্যিই অপয়া ধরা হয়। কোনোরকম সংস্কার মানেন না, মুক্ত মনের অনেক প্রগতিশীল মানুষও ১৩‘কে অপয়া ভাবেন। তাই যে কোন শুভ কাজে যতটা সম্ভব ১৩‘কে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টাও থাকে সবার।

সমাজে এমন অনেকে আছেন, যারা মাসের ১৩ তারিখে কোনো পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান করেন না। যে খেলার বড় অংশ ক্রিকেটার সংস্কারবাদি, সেই ক্রিকেটে ‘১৩’ নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তার শেষ নেই।

অনেকেই বলেন, ‘আনলাকি থার্টিন।’ তবে ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুল কিন্তু ১৩‘কে আনলাকি বা অপয়া ভাবেন না। ভাবার অবকাশও নেই।

তার কাছে ১৩ সংখ্যা পয়োমন্তঃ হয়ে গেছে। হয়ত থাকবে সারা জীবন। কারণ ম্যাচ পাতানোর দায়ে নিষিদ্ধ আশরাফুল আবার মুক্ত হয়েছেন ১৩ আগস্ট। ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ স্বীকার করে ২০১৩ সালে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন অভিষেকে টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠতম সেঞ্চুরিয়ান। আইসিসি দূর্নীতি দমন সংস্থা সাক্ষী প্রমাণ ও তদন্তের পর তাকে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এ সময়ের মধ্যে তার সব রকম ক্রিকেটীয় কর্মকান্ডের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পাশাপাশি ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ সময়ের মধ্যে ঘরের ক্রিকেট ও জাতীয় দলে খেলা বন্ধ রাখার কথা বলা হয়। তবে তিন বছর পর তাকে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারই আলোকে গত ১৩ আগস্ট আংশিক শাস্তিমুক্ত হলেন আশরাফুল।

তবে পুরো শাস্তি মওকুফের জন্য তাকে আরও দুই বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট তার শাস্তি পুরোদমে মওকুফ হয়ে যাবে। তখন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নেয়ার সব রকম নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তার আগের দুই বছর ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট ও জাতীয় লিগ খেলতে পারবেন আশরাফুল। তবে তার ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশ গ্রহণের ওপর এখনো কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে। থাকবে আরও দুই বছর। মানে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যেও আইসিসি ইচ্ছে করলে তার শাস্তি মওকুফ করার এখতিয়ার রাখে।

asrafuতবে সেটা না করলে আগামী দুই বছর জাতীয় দলে খেলার কোনই সুযোগ থাকবে না। এর পাশাপাশি ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি আসরে অংশ নেয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে। তার মানে বিপিএল খেলার অনুমতি নেই। তবে আইসিসির বেঁধে দেয়া শর্তে একটা ছোট্ট ফাঁক-ফোকর আছে। বাংলাদেশে বিপিএল ছাড়াও ফ্র্যাঞ্চাইজি দীর্ঘ পরিসরের আসর বিসিএলও হয়, আইসিসি আশরাফুলকে শাস্তি দেবার সময় হয়ত তা খুঁটিয়ে দেখেনি। তাই বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি। আর তাই আশরাফুল ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজি বিসিএল খেলতে পারবেন কি না?

তা নিয়ে জেগেছিল সংশয়। বিসিবি সে সংশয় কাটাতে আইসিসির স্মরণাপন্ন হয়। পরে জানা যায়, আইসিসি আশরাফুলের ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি দীঘ পরিসরের টুর্নামেন্ট মানে বিসিএল খেলায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।

তারপরও আশরাফুল বিসিএলে নেই। অর্থাৎ আশরাফুলকে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরতে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে। আইসিসি তার প্রতি সদয় হলে ভিন্ন কথা। না হয় আগামী নভেম্বরে যে বিপিএল হবে, তাতেও মাঠে নামা হবে না। তার মানে আপাততঃ আশরাফুল জাতীয় লিগ আর প্রিমিয়ার লিগ ছাড়া আর কিছুই খেলতে পারবেন না। এখন অদুর ভবিষ্যতে আইসিসি যদি তার আচার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, তাহলেই কেবল একদম মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে যাবেন আশরাফুল। ততদিন পর্যন্ত তাকে পুরোপুরি মুক্ত বলা যাবে না।

আইসিসির নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও  ফ্র্যাঞ্চাইজি বিসিএলে কেন নেই আশরাফুল? তা নিয়েও আছে সংশয়। কেউ কেউ বলছেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে চান না বলেই বিসিএলে নেই আশরাফুল। তবে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু বলছেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, ‘কোচের ইচ্ছেতে কেন হবে? কোচ কি আর বিসিএলে দল সাজান? দল নির্বাচন করি আমরা নির্বাচকরা।’

তাহলে আশরাফুল কেন বিসিএল খেলতে পারছেন না? মিনহাজুলের সোজা সাপটা ব্যাখ্যা, ‘নিয়মের বাইরে থাকায় আশরাফুলকে বিসিএলে বিবেচনায় আনা যাচ্ছে না।’ বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিনহাজুল বলেন, ‘জাতীয় লিগ ও বিসিএলে দল সাজিয়ে দেই আমরা (নির্বাচকরা)। তার জন্য একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। যেহেতু জাতীয় লিগ আগে হয়, তাই জাতীয় লিগ দেখে আমরা বিসিএলে দল সাজাই। জাতীয় লিগে ভাল খেলা পারফরমাররা বিসিএলে অগ্রাধিকার পায়।

অর্থাৎ জাতীয় লিগে নজরকাড়া পারফরমাররাই হন বিসিএলে ফাস্ট চয়েজ। এখন আশরাফুল যেহেতু নিষিদ্ধ ছিল, তাই তার পক্ষে আর গত দুই জাতীয় লিগ খেলা সম্ভব হয়নি। সে কারণে সে আমাদের প্রক্রিয়া বা নিয়েমের বাইরে পড়ে গেছে। তাই তাকে বিবেচনায় আনা যায়নি।’

আবার অন্য পক্ষর মত কোচ হাথুরুসিংহে চান না আশরাফুল এখন বিসিএল খেলুক। তার যুক্তি, ‘যেহেতু জাতীয় দলে খেলায় আইসিসির পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা আছে, তাই আশরাফুল বিসিএল খেললে লাভ কি?’ প্রশ্ন উঠেছে আশরাফুল বিসিএল খেলবেন কি খেলবেন না, তা ঠিক করে দেবার জন্য আছেন নির্বাচকরা। এখানে কোচের মতামতের কি কোন গুরুত্ব আছে? বাস্তবতার নিরিখে কোনই গুরুত্ব নেই।

কিন্তু আশরাফুল বিষয়ে কোচের মতামত নেয়া হয়েছে। সেটা করেছেন ক্রিকেট অপারেশন্স কামটির চেয়ারম্যান আকরাম খান নিজে। তিনি নিজে স্বীকার করেছেন, আমি এবং নান্নু ভাই (মিনহাজুল আবেদিন) হাথুরুর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আশরাফুলের বিষয়ে কথা বলেছিলাম।’

এখন প্রশ্ন উঠেছে কেন আশরাফুল ইস্যুতে কোচের মতামত নেয়া। হ্যাঁ, মানা যেত তাকে আবার নতুন করে জাতীয় দলে নেয়ার প্রশ্ন উঠলে তখন কোচের মতামতের গুরুত্ব থাকবে; কিন্তু আশরাফুল বিসিএল খেলতে পারবেন কি না? এ সম্পর্কে কোচের কিই বা বলার আছে? এটা কি তার বিষয়?

অনেকেই একে নজিরবিহীন ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। তাদের কথা, পৃথিবীর কোন দেশের বিদেশি কোচ ঘরোয়া আসরের নিয়ম-নীতি বেঁধে দেন? ঘরোয়া ক্রিকেটে কে কোন আসর খেলবে, তা টুর্নামেন্ট কমিটি ও নির্বাচকদের বিষয়। তারাই ঠিক করে দেবেন। এখানে বিদেশি কোচের বক্তব্য নেয়ার দরকার কি? কারো কারো মত, বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপন কোচ হাথুরুসিংহেকে বেশি পছন্দ করে, তার মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেন বলেই ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি প্রধান যেচেই আশরাফুল ইস্যুতে কোচের মতামত নিয়েছেন।

এদিকে যার বিসিএল খেলা নিয়ে নানা কথাবার্তা, সেই আশরাফুল কিন্তু ভাবলেশহীন। তার কথা, ‘আমি ক্রিকেটে ফিরতে পেরেই মহা খুশি। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরার আনন্দটাই আমার কাছে বড়। আমি ধৈর্য্য ধরে আছি। জানি আগামীর পথচলা মসৃন হবে না। আমাকে যে কোন পর্যায়ে জায়গা করে নিতে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে। যখন যে আসরে খেলার সুযোগ পাবো, তাতেই সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে দিব।’

নন্দিত আশরাফুল ম্যাচ পাতানোয় জড়িয়ে হয়েছিলেন নিন্দিত। এখন আংশিক মুক্ত। আশরাফুল ভক্তদের বিশ্বাস ও আশা- তাদের প্রিয় ক্রিকেটার আবার ক্রিকেটে ফিরবেন। আবার জাতীয় দলের লাল সবুজ জার্সি গায়ে চাপাবেন। আশরাফুল নিজেও সে স্বপ্ন দেখেন; কিন্তু প্রশ্ন হলো- ৩২ বছরের আশরাফুলকে জাতীয় দলে ফিরতে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও দু’বছর। তখন তার বয়স হবে ৩৪। ওই বয়সে জাতীয় দলে ফিরতে পারবেন তো?

এখন বাংলাদেশ দলে যে পরিমান মেধাবি ক্রিকেটার ও ভাল পারফরমারের ছড়াছড়ি, তাদের ভীড়ে মধ্য তিরিশের আশরাফুল কি আবার জায়গা করে নিতে পারবেন? আশরাফুল মনে করেন, পারবেন। তাই তো মুখে এমন কথা, চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া মিসবাহ-উল হক আর চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ইউনুস খান যদি এখনো ভাল খেলতে পারেন, তাহলে আমি কেন পারবো না?

দেখা যাক সত্যিই আশরাফুল আবার জাতীয় দলে ফিরতে পারেন কি না?
        
জাগো চ্যাম্পিয়নের ১০ম সংখ্যা পুরো পড়তে ক্লিক করুন এখানে...

আইএইচএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।