এক দশকের সাকিব


প্রকাশিত: ০৩:১৫ পিএম, ০৬ আগস্ট ২০১৬

বাবার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ছেলে নাম করবে, একজন ফুটবলার হিসেবে। সাকিব আল হাসানকে নিয়ে তার বাবা মাশরুর রেজার স্বপ্নটা ছিল এমনই। সাকিবের বাবাও যে ছিলেন একজন ফুটবলার। তাই ছেলে সাকিবকে নিয়ে মাশরুর রেজার এমন স্বপ্ন দেখা অবাস্তব নয়। বরং চরম বাস্তবতার নামান্তর।

কিন্তু পায়ের জাদু রেখে সাকিব জাদু দেখাতে চাইলেন হাতে। কেননা ক্রিকেট তো পায়ের খেলা নয়, ব্যাট কিংবা বল তুলে নিতে হয় হাতেই। সঙ্গে বুদ্ধি খাটিয়ে প্রতিপক্ষ বোলার কিংবা ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করতে হয়। হ্যাঁ, বাংলাদেশ দলে সাকিবের দায়িত্ব কিন্তু এমনই। ব্যাটে-বলে সমান তালে যিনি পারফর্ম করে যান। তিনি আর কেউ নন, নাম তার সাকিব আল হাসান। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার স্বীকৃতিই তার যোগ্য প্রতিদান।  

আজ ৬ আগস্ট (শনিবার) আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ বছর পূর্ণ করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব। ৬ আগস্ট ২০০৬, হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল বাঁহাতি এই অলরাউন্ডারের।

shakib

দেশসেরা ক্রিকেটার, বিশ্বেসেরা অলরাউন্ডার, ষোলো কোটি বাঙ্গালির অহংকার সাকিরের এই এক দশকে রয়েছে অনেক স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা। যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন উন্নতির জোয়ারে ভাসছে, সাকিব তাদের অন্যতম।

গত এক দশকে সাকিব বিশ্বের নামিদামি লিগগুলোতে অংশগ্রহণ করেছেন। মোস্তাফিজুর রহমান, তামিম ইকবাল-মুশফিকদের আগে বৈশ্বিক লিগে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। খেলেছেন  বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল), ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), কাউন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), বিগ ব্যাশ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের মতো ক্রিকেটের জমজমাট আসরগুলোতে। নিজের সেরাটা ঢেলে দিয়ে কুড়িয়েছেন প্রশংসাও। যেখানেই খেলেন না কেন  খেলেছেন বাংলাদেশকে পরিচিত করে এসেছেন নতুনভাবে। সাকিব বলেন, ‘বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। সেটা আইপিএল, সিপিএলে কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই হোক। সবসময়ই দেশের মাথা উঁচুতে রাখতে চাই।’

২০০৬ সালে বাংলাদেশ দল গিয়েছিল জিম্বাবুয়ে সফরে। হাবিবুল বাশার, আশরাফুলদের সঙ্গী হন বিস্ময় বালক সাকিবও। ৬ আগস্ট হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফরহাদ রেজা ও মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। ওই ম্যাচে ১০ ওভার বল করে ৩৯ রান দিয়ে ১ উইকেট নেন সাকিব। ব্যাট হাতে ৩০ রান করে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। ম্যাচটিতে শাহরিয়ার নাফিসের সেঞ্চুরিতে ভর করে বাংলাদেশ জয় পায় ৮ উইকেটে, ৩২ বল হাতে রেখেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একজন পাক্কা অলরাউন্ডার হিসেবে সাকিবের জাত চেনানোর শুরু তখন থেকেই।

ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি ফরমেটে সাকিবের অভিষেক হয় ২০০৭-এ। সে বছর ২৮ নভেম্বর খুলনা বিভাগীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাকিব ২৬ রান করেন এবং ৪ ওভার বল করে ৩১ রান দিয়ে ১ উইকেট নেন। ওই ম্যাচে টাইগাররা জয় তুলে নেয় ৪৩ রানে।

shakib

২০০৭ সালে হাবিবুল বাশার সুমনের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যান সাকিব। ওই বিশ্বকাপে তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিমের ক্রীড়া নৈপুণ্যে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সেবার টাইগাররা খেলেছিল সুপার এইটে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা পারফরম্যান্সের শুরুটা সেবারই। দলের মতো ব্যক্তি সাকিবও দারুণ সফল হন তখন। ৯ ম্যাচে তিনি ২৮.৮৫ গড়ে ২০২ রান করেন। তবে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন মোহাম্মদ আশরাফুল (২১৬)। সাকিব ৪৩.১৪ গড়ে ৭টি উইকেট নেন। 
 
২০০৭ সালে দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডে খেলতে বাংলাদেশ সফরে আসে ভারত। ১৮ মে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে সাকিবের টেস্ট অভিষেক হয়। ওই ম্যাচে ১৩ ওভার বোলিং করেন। ২৯ রান দিলেও ছিলেন উইকেটশূন্য। ব্যাট হাতে ৪৯ বল মোকাবিলা করে ২৭ রান করেন। সাকিবের অভিষেক টেস্টটি ড্র হয়। এখানে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই, আন্তর্জাতিক তিন ফরমেটে সাকিবের অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশ হারেনি। এরপর তাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন টাইগাররা।

সাকিব বাঁহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার। ব্যাট-বলের সমান তালের পারফরম্যান্স তাকে নিয়ে গেছে এক নতুন উচ্চতায়।  এখন দলের অন্যতম ভরসার প্রতীক সাকিব। তার সবচেয়ে বড় অর্জন ক্রিকেটের তিন ফরমেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হওয়া।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সব ক্রিকেট সংস্করণে নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার হওয়ার কীর্তি গড়েন তিনি, যা বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসেই প্রথম! এ ছাড়া প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে ৪ হাজার রান করার গৌরব অর্জন করেন সাকিব।

২০০৯ সালে মাশরাফির ইনজুরিজনিত অনুপস্থিতির কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের বাকি সময়টা নেতৃত্ব দেন সাকিব। ২২ বছর ১১৫ দিন বয়সে বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ও ইতিহাসের পঞ্চম কনিষ্ঠতম অধিনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন তিনি। সাকিবের নেতৃত্বে দ্বিতীয় টেস্টও জিতে নেয় বাংলাদেশ। দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পান টাইগাররা। ওই ম্যাচে ব্যাট হাতে ১৬ ও অপরাজিত ৯৬ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ৫৯ রানে ৩ এবং ৭০ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ ও ম্যান অব দ্য সিরিজ- দুটো পুরস্কার নিজের দখলে নেন সাকিব। ওই টেস্ট সিরিজে তিনি ৫৩.০০ গড়ে ১৫৯ রান করে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার হন। ১৮.৭৬ গড়ে ১৩ উইকেট নিয়ে কেমার রোচের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিও হন সাকিব। সত্যিই অসাধারণ!

shakib

তার অধীনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ২-০ তে জেতার পর বাংলাদেশ ওয়ানডে সিরিজও ৩-০ তে জেতে। সিরিজে সাকিব দুটি হাফ-সেঞ্চুরি করেন। এই অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্য ওয়ানডে সিরিজেও তিনি সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।

গোটা বছরজুড়ে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের কারণে সাকিবকে ‘টেস্ট প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার-২০০৯’ ঘোষণা করে আইসিসি। এ ছাড়া ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার-২০০৯’ এর জন্যও মনোনীত হন তিনি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আইসিসির সেরা খেলোয়াড় হওয়ার মনোনয়ন পান সাকিব।

গত এক দশকে সাকিবের হাসির মাঝে লুকায়িত রয়েছে অনেক কষ্টও! বিদেশি লিগে খেলতে গিয়ে তার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সব শেষ আইপিএলে তো একাদশে জায়গা হয়েছে খুব কমই। তবে এই কলকাতা নাইট রাইডার্সের দুইবারের শিরোপা জয়ে সাকিবের ভূমিকা ছিল অনন্য।

সাকিবের প্রশংসায় এনামুল হক জুনিয়র বলেছিলেন, ‘বিশ্বে সাকিব আল হাসান একজনই। ওর সেরকম অনুশীলনও লাগে না। পুরোই ব্যতিক্রমী এক বোলার। ওর সবকিছু নির্ভর করে মেজাজের ওপর। অনুশীলন করে কেউ হয়তো ওর মতো হতে চেষ্টা করতে পারে। তবে বিশ্বে সাকিব একজনই থাকবে।’

গত নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ চলছিল। ওই সিরিজেই একদিনের ম্যাচে প্রথমবারের মতো পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। হঠাৎ খবর এলো, সুদূর আমেরিকায় সন্তান সম্ভবা স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরের কাছে যেতে হবে। গেলেন। এরপর কন্যা সন্তানের বাবা হয়ে দেশে ফিরে আবারো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে নেমে পড়েন সাকিব। তখন বাংলাদেশ কোচ হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, ‘সাকিব এমন একজন ক্রিকেটার যার অনুশীলন দরকার হয় না! ’

এদিকে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক দশক পূর্ণ হওয়ায় সাকিবকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার শামসুর রহমান শুভ। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের কাছ থেকে আরো অনেক প্রত্যাশা রয়েছে তার। বলেন, ‘সাকিব তো বাংলাদেশ দলের জন্য অনেক কিছু করেছে এবং আরও অনেক কিছু করার সামর্থ্য রয়েছে। এখন ওর বয়স ২৯। সাকিব যেহেতু ১০ বছর টানা খেলেছে তাই সে অনেক অভিজ্ঞ। জাতীয় দলে থাকার জন্য ওর যে ইচ্ছা, প্রচেষ্টা সেটি সবার জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।  থাকবেও।’

প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত ১৫৭ ওয়ানডে খেলেছেন সাকিব। ৩৫.১৮ গড়ে করেছেন ৪৩৯৮ রান। এতে রয়েছে ৬টি সেঞ্চুরি ও ৩০টি হাফ সেঞ্চুরি। উইকেট শিকার করেছেন ২০৬টি।

৪২ টেস্ট খেলে ৩৯.৭৬ গড়ে ৩ সেঞ্চুরি ও  ১৯টি হাফ সেঞ্চুরিতে সাকিবের সংগ্রহ ২৮২৩ রান। উইকেট পেয়েছেন ১৪৭টি।  সাকিব টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন ৫৪ টি। ২৩.৯৭ গড়ে করেছেন ১১০৩ রান। এর মধ্যে ৬টি ফিফটি।  উইকেট পকেটে পুরেছেন ৬৫টি।

এনইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।