ঐতিহ্য লুণ্ঠনের অলিম্পিক


প্রকাশিত: ০৩:৫২ পিএম, ০৪ আগস্ট ২০১৬

জয় পরাজয় নয়, খেলায় অংশ নেয়াটাই  বড় কথা- এর চেয়ে চটকদার শ্লোগান আর হয় না। গোটা দুনিয়া হয়ে ওঠে অলিম্পিকের নামে। অলিম্পিকে পদকজয়ীদের সংখ্যা থেকে পদক পাবে না এই সংখ্যাটা শতগুণ বেশি। সুতরাং আধুনিক অলিম্পিকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিন দারুণভাবে সফল। বিশ্বসেরা অ্যাথলেটরা অতিমানবীয় সব কীর্তি দেখিয়ে প্রতিনিয়ত আলোকিত করে চলেছেন অলিম্পকের মহামঞ্চ।

টাকার থলি নিয়ে বড় বড় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো  ছুটছে বিশ্বসেরা অ্যাথলেটদের পেছনে। অলিম্পিক পদক জেতা মানেই রাতারাতি যশ-খ্যাতি প্রাচুর্য সব মুঠোবন্দী হওয়া। এ পর্যন্ত  সবই ঠিক আছে; কিন্তু সরল মনে কেউ যদি প্রশ্নটা করে, অপেশাদার তত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আধুনিক অলিম্পিকে নেইমার, সেরেনা উইলিয়ামস কিংবা জকোভিচরা কিভাবে অংশ নিচ্ছেন?

অলিম্পিকের নীতি- আদর্শের আলোকে আরো বৃহৎ পরিসরে যদি প্রশ্ন ওঠে, অলিম্পিক থেকে ‘আধুনিক অলিম্পিক’ করার প্রয়োজনই বা পড়ল কেন?  প্রাচীন অলিম্পিককে কবরই বা দেয়া হলো কেন? প্রাচীন অলিম্পিক শুধুই নামসর্বস্ব। এর বিপরীতে কুবার্তিন প্রবর্তিত আধুনিক অলিম্পিক যেন ধনীর আদরে গর্বিনী। কবি গুরু রবি ঠাকুরের ভাষায়-
‘ধনির আদরে গরব না ধরে, এতই হয়েছ ভিন্ন
আজ কোনখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোন চিহ্ন।

Olympicঐতিহ্য লুণ্ঠনের দায় এড়ানোর কোন সুযোগ কি আছে আধুনিক অলিম্পিকের? এ প্রসঙ্গের গভীরে যাওয়ার আগে ঐতিহ্য লুণ্ঠনের টাটকা একটা দৃষ্টান্তের দিকে নজর দেয়া যাক। অলিম্পিকের শতবছর পূর্তি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯৬ সালে শতবর্ষী অলিম্পিকের আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা।

অলিম্পিকের নাম-ঐতিহ্য-মিথ এসবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আদৌ কি কোন সম্পর্ক আছে?  তাহলে শতবর্ষী আসরের আয়োজক কেন যুক্তরাষ্ট্র?  পুঁজি ও শক্তিশালি রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে আটকে থাকাটাই অলিম্পিকের জন্য নিয়তি নির্ধারিত। শতবছর পূর্তি অলিম্পিকের আসর বসল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে আবার কুবার্তিনকে নিয়ে টানাটানি কেন? অলিম্পিকের ঐতিহ্য লুণ্ঠনের পথটা যে দেখিয়েছিলেন ফরাসী সংঘঠক কুবার্তিন এটাকে পাশ কাটানোর কোন সুযোগই যে নাই!
 
কুবার্তিন প্রবর্তিত আধুনিক অলিম্পিকের মূল দর্শনের জায়গাটিতে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। আধুনিক অলিম্পিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অপেশাদার তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। প্রাচীন অলিম্পিক ছিল পেশাদারদের। এক কথায়, পেশাদার বলতে বুঝায় খেলে যারা টাকা উপার্জন করে। প্রাচীন অলিম্পিকে অংশ নিত বিশ্বসেরা সব পেশাদার অ্যাথলেটগণ। পদক জিতলেও প্রচুর অর্থ পেতেন তারা। অনিয়মিতভাবে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রাচীন অলিম্পিক। এরপরই অলিম্পিক দখলে চলে যায় অপেশাদারদের হাতে। আর অলিম্পিকের নাম ব্যবহার করে রাজনীতির শুরু ওখান থেকেই।

পেশাদার মানে মেহনতি শ্রেণি। আর অপেশাদার, মানে অভিজাত শ্রেণি। সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা। এই অপেশাদার আন্দোলন শুরু হয় ১৮৬০ সালের দিকে। এর উদ্ভাবক মুলত অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। সুর্য অস্ত না যাওয়া ব্রিটিশ রাজত্বকে দীর্ঘায়িত করতে গোটা দুনিয়াতে মেহনতি মানে শ্রমিক শ্রেণির বিপরীতে একটা অভিজাত শ্রেণি দাঁড় করানোর অংশ হিসাবে এই অপেশাদার তত্ত্ব আমদানি করে ব্রিটিশরা। এর বড় কোপটা এসে পড়ে অলিম্পিকের উপর।

অভিজাতদের দৌরাত্যে ১৮৭৫ সালের অলিম্পিক ভালোবাবে শেষই হতে পারল না। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৯ সালে গ্রীসে অনুষ্ঠিত হয় প্রাচীন অলিম্পিকের সর্বশেষ আসর; কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিলো না। অল্প কিছু অভিজাত, মানে অপেশাদারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো অলিম্পিক। এভাবেই কবর রচিত হল প্রাচীন অলিম্পিকের।

এই সময়টিতেই মঞ্চে আবির্ভূত হলেন কুবার্তিন। অলিম্পিক নামটিকে ব্যবহার কওে ব্যাক্তিগত উচ্ছাভিলাস  তথা ফ্রান্সের ভাবমুর্তি পুনরুদ্ধার করতে এগিয়ে আসলেন এই ফরাসী। বিশ্ব রাজনীতিতে তখন ঘোর দুর্দশায় ফ্রান্স। ১৮৭০ সালে প্রাশিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ফরাসীদের গৌরব তখন লুটোপুটি খাচ্ছে ধুলোয়। ১৮৯২ সালে অলিম্পিককে নতুনভাবে শুরু করার  প্রস্তাব নিয়ে বিশ্ব দরবারে হাজির হলেন কুবার্তিন।

গঠন করলেন ‘ইউনিয়ন্স অব স্পোর্টস অ্যাথলেটিক্স’; কিন্তু সেভাবে সাড়া পেলেন না তিনি। অনুধাবন করলেন... ‘শক্তিশালি রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া বেশিদুর এগুতে পারবেন না।’  তাই ফরাসী হয়েও সমর্থন নিলেন  চিরশত্রু ইংরেজদের।  অলিম্পিকের সঙ্গে অপেশাদার বিষয়টা জুড়ে না দিলে ব্রিটিশদের মন গলাতে পারবেন না। এই বাস্তবতা বুঝতে একটুও দেরি হলো না কুবার্তিনের।

বাস্তবতা বুঝেই, ১৮৯৪ সালে, সারা বিশ্ব থেকে অপেশাদার ক্লাবগুলোকে আমন্ত্রণ জানালেন প্যারিসে। ১২টা দেশ থেকে দু’হাজার প্রতিনিধি এসে যোগ দিল এই সম্মলনে। অকুণ্ঠ সমর্থন পেলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে। ১২ দেশের ১৪ প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হলো ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি, সংক্ষেপে আইওসি। আর এই কমিটিই তৈরি করলো ’অ্যামেচার কোড’। আর এই ’অ্যামেচার কোড’ এর মধ্য দিয়েই অলিম্পিকে প্রতিষ্ঠিত হলো অপেশাদার তত্ত্বের।

এভাবেই আইনগতভাবে অলিম্পিকে প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে গেল পেশাদারদের। অর্থাৎ খেলাকে যারা জীবিকা হিসাবে নিয়েছিলেন আধুনিক অলিম্পিকে  নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন তারা।  হাততালি পাওয়ার জন্য অপেশাদার শ্লোগান খুব গালভরা হলেও , বড় সঙ্কটের শুরু এখান থেকেই। প্রথমত অপেশাদার নিরুপনের মানদণ্ড কী হবে? একজন দেখা গেল পেশাদার লীগে ফুটবল খেলেন; কিন্তু সেই লোক অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিলে সে পেশাদার না অপেশাদার?

যেহেতু বেতন পান, তাই শরীর চর্চার শিক্ষকদের অলিম্পিকে অংশ নেয়া বন্ধ করে দেয়া হলো। অভিযোগ উঠল সমাজতান্ত্রিক বলয়ে থাকা পুর্ব ইওরোপ, তথা রাশিয়ার বিপক্ষেও। সমাজতান্ত্রিক  দেশগুলোতে অ্যাথলেটদের জীবন-জীবিকার ব্যয় বহন করে রাষ্ট্র। তাই তারা অপেশাদার নয় উঠল এমন অভিযোগ। দেখা গেল একজন অ্যাথলেটিক্সে পদক জিতলেন; কিন্তু তিনি আবার ফুটবলে পেশাদার লিগে খেলেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে কেড়ে নেয়া হলো তার পদক। এর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলেন তিনি। অলিম্পিক শেষ হওয়ার পর এমনি অসংখ্য মামলা জমতে শুরু করল ক্রীড়া আদালতে।

এর থেকেও বড় সঙ্কট দেখা দিল। অলিম্পিকে অপেশাদাররা অংশ নেয়াতে এর মান গিয়ে ঠেকল তলানিতে। পেশাদাররা মানেই তো শ্রেষ্ঠ সব ক্রীড়াবিদ। সেরাদের অনুপস্থিতিতে রঙ হারাতে শুরু করল অলিম্পিক।  বিশ্বসেরা ক্রীড়াবিদরা  না থাকায় অলিম্পিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করল স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলোও। ধুঁকতে শুরু করল আধুনিক অলিম্পিক।  এমনি অবস্থায় ১৯৮০ সালে আইওসির সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হলেন স্পেনের হুয়ান আন্তোনিও সামারাঞ্চ।

দেনার দায়ে ডুবতে বসেছ অলিম্পিক টাইটানিক। কুবার্তিনের দর্শনকে ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি। মুত্যু ঘন্টা বাজল অপেশাদার তত্ত্বের। অলিম্পিকের মঞ্চে তিনি ফিরিয়ে আনলেন বিশ্বসেরা অ্যাথলেটদের। ঝাঁকে ঝাঁকে পেশাদাররা অংশ নেয়া শুরু করলেন অলিম্পকে। সেরাদেও স্পর্শে জেগে উঠল অলিম্পিক। সাজ সাজ রব পড়ে গেল স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে।

এখনকার অলিম্পিকে  কুবার্তিনের অপেশাদার তত্ত্ব কৌতুক না আধুনিক অলিম্পিকের জন্ম পাপের প্রায়শ্চিত্ত এনিয়ে হতে পারে দারুণ এক বিতর্ক।  মজাটা হচ্ছে এই অপেশাদার তত্ত্ব কিন্তু এখনো আছে। আছে অলিম্পিক শ্লোগানও... জয় নয়, যোগদানই আসল কথা; কিন্তু সর্ব্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া ক্রীড়াবিদ যখন স্বর্ণ পদক জিতছেন তখন অপেশাদার তত্ত্বের যে মুখ লুকানোরও জায়গা থাকে না। কুবার্তিন অবশ্য বলতে পারেন, ‘শুধু আমি একা কেন? আদর্শচ্যুতিই অলিম্পিকের মূল দর্শন।’ কেননা গ্রীকদের কাছ থেকে অলিম্পিকরে ঐতিহ্য লুণ্ঠনের যে পথটা দেখিয়েছিলেন কুবার্তিন, সেই পথ ধরেই অলিম্পিকের শতবছর পূর্তি হয় বিশ্বের সবচেয় বড় পেশির অধিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

অলিম্পিক নিয়ে জাগো চ্যাম্পিয়নের বিশেষ এই আয়োজন পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

আইএইচএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।