বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা আবিষ্কার মুস্তাফিজ


প্রকাশিত: ০৭:৩২ এএম, ২৭ মে ২০১৬

চলতি আইপিএলে খেলা চলছে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব ও  সানরাইজার্স হায়দারাবাদের মধ্যে। ধারাভাষ্যে ক্রিকেটের কিংবদন্তুী সুনিল গাভাস্কার এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের কট্টর সমালোচক রমিজ রাজা। নিজের প্রথম ওভারেই মেডেন তুলে নিলেন মুস্তাফিজ। সুযোগ পেলেই বাংলাদেশকে সমালোচনার বানে বিদ্ধ করা ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজা এ সময় বলে উঠলেন, ‘সানি, ম্যাজিক্যাল স্পেল।’ একমত হয়ে গাভাস্কার বললেন, ‘টোটালি। আরও এককাঠি এগিয়ে রমিজ জানালেন।’ আনবিলিবেভল, আন রিয়াল...।’

আমাদের বাঁ-হাতি স্লোয়ার-কাটার মাস্টার মুস্তাফিজকে নিয়ে বিশ্বসেরা ক্রিকেটারদের মঞ্চ আইপিএলে ধারাভাষ্যকারদের এমন উচ্ছাস এখন নিত্যদিনের ঘটনা। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের সঙ্গে ম্যাচে মুস্তাফিজ ম্যাজিকে মুগ্ধ জনপ্রিয় ধারভাষ্যকার রবি শাস্ত্রী বললেন, ‘আমার সব প্রশংসাবানী পাচ্ছে মুস্তাফিজ (হি গেট অল মাই ওয়ার্ডস)।’

ওই খেলায় ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার পেলেন আশীষ নেহরা। পুরস্কার নিতে মঞ্চে এসে নিজের বোলিং পারফরম্যান্সের কৃতিত্ব দিলেন বাংলাদেশের এই কাটার-মাস্টারকে। তার কথায়’ আমি গ্রিপিং করা শিখছি মুস্তাফিজের কাছ থেকে। তার কাছ থেকে আরও শিখতে চাই। চেষ্টা করে যাচ্ছি, আশা করছি পারব।’

আইপিএলে সানরাইজার্স ক্যাপ্টেন ডেভিড ওয়ার্নার মুস্তাফিজকে ব্যবহার করেন ভীষন সাবধানতার সঙ্গে। পরিস্থিতি বুঝে কাজে লাগান তার সেরা অস্ত্রটিকে। প্রতিপক্ষের রান আটকানো দরকার, সব বোলাররা সমানে মার খাচ্ছে, শেষ ভরসা হিসাবে ওয়ার্নার ডাকলেন বিশ্ব ক্রিকেটে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া দ্য ফিজকে।

বল হাতে নিয়েই অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন এই ২০ বছরের তরুণ। রাশ টেনে ধরছেন রানের পাগলা ঘোড়ার। প্রতিপক্ষ দলের সেট ব্যাটসম্যান। ব্যাটহাতে আগ্রাসন চালিয়ে ম্যাচকে নিয়ে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যথারীতি ডাক পড়ল মুস্তাফিজের। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা ব্যাটসম্যানটিকে সাজঘরমুখো করার অলিখিত দায় মুস্তাফিজেরই।

খুব সাবধানে ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায়শই বেশ কয়েক ওভার পর মুস্তাফিজকে আক্রমনে আনছেন ওয়ার্নার। আর এতে করে বেশ মজা হচ্ছে কমেন্ট্রি বক্স, গ্যালারি কিংবা দর্শকদের মধ্যে। হোয়ার ইজ দ্য ফিজ? কিংবা হেয়ার ইজ দ্য ফিজ?’ ইএসপিএন-ক্রিকইনফোর ধারাভাষ্যকারদের এই কথাগুলো এখন সবার মুখে মুখে। মুস্তাফিজকে আক্রমনে আনতে দেরী হলেই, ক্রিকইনফোর ধারাভষ্যে, ‘হোয়ার ইজ ফিজ?’ আর মুস্তাফিজকে আক্রমনে আনলে, হেয়ার ইজ দ্য ফিজ’। মাঝে মধ্যই এই স্লোয়ার স্পেশালিস্টকে দিয়ে এক ওভার করিয়েই আক্রমন থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন সানরাইজার্স অধিনায়ক। ধারাভাষ্যকাররা আশ্বস্ত করছেন... ফিজ মাঠেই আছে। যথাসময়ে ঠিকই তাকে দেখা যাবে।’ এই যথাসময় মানে প্রয়োজনমত মুস্তাফিজকে ঠিকই কাজে লাগাবেন ওয়ার্নার।

ক্রিকেট থেকে ফাস্ট বেলিংয়ের ঝাঁঝ কমে আসছে দিনকে দিনই। কোর্টনি ওয়ালস-কার্টলি অ্যামব্রোস কিংবা ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনুসদের পরবর্তী সময়ে ব্রেট লি-শেন বন্ড কিংবা পাকিস্তানি স্পিড স্টার শোয়েব আখতাররা থামতে দেননি ফাস্ট বোলিংয়ের মিছিল। গত দশকের বেশি সময় ধরে  ফাস্ট বোলিংয়ের বিজ্ঞাপনটা একাই টিকিয়ে রেখেছেন স্টেইনগান খ্যাত ডেল স্টেইন। বয়স এবং ইনজুরি মিলিয়ে এই প্রোটিয়া ফাস্ট বোলার এখন ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায়।

ব্যাট-বলের লড়াইয়ে পেসাররা স্বমহিমায় থাকবেন, আগের প্রজন্মের ফাস্ট বোলারদের এমন আকাঙ্খার জায়গাটিতে নিজেকে নিয়ে গেছেন আমাদের কাটার মাস্টার।  মুস্তাফিজের মধ্যে ফাস্ট বোলিংয়ের শিল্পি ওয়াসিম আকরামকে দেখতে পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন প্রোটিয়া ফাস্ট বোলার স্টেইন। তার কথায়, ‘আকরামের মতই মুস্তাফিজের বোলিং দেখাটাও দারুণ উপভোগ্য। এটা ঠিক যে আকরামের মত অত বেশি সুইং সে দিতে পারে না। তবে ক্রিকেটে খুব বড় প্রতিভা সে।’

মুস্তাফিজের বিশেষত্বেও জায়গাটিকে এই প্রোটিয়া ফাস্ট বোলার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘সচরাচর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডানহাতি পেসারদের অফ কাটার দেখে অভ্যস্ত ব্যাটসম্যানরা। বাঁহাতি মুস্তাফিজ কাটারের সঙ্গে পরিবর্তন করছে বলের গতিও। যা ব্যাটসম্যানেরা আগে দেখেনি।’ মুস্তাফিজের আবির্ভাবকে নতুন প্রজন্মের ফাস্ট বোলিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন এই প্রোটিয়া ফাস্ট বোলার। তিনি জানালেন, ‘গত বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট আর অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক দারুণ বোলিং করেছে। সাদা বলে খুবই ভাল সুইং করিয়েছে বোল্ট। আর স্টার্ক গতি দিয়ে আনন্দ দিয়েছে সবাইকে। এদের সঙ্গে যোগ হয়ে গেল মুস্তাফিজ। আমার বিশ্বাস সে আগামীতে আরও পরিণত হয়ে উঠবে।’

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মুস্তাফিজের প্রশংসার প্রতিযোগিতায নেমেছেন গ্রেট ক্রিকটোররা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ড্যারেন স্যামির কথারই প্রতিধ্বনি গোটা ক্রিকেট দুনিয়াজুড়ে। বলেছেন, ‘মুস্তাফিজ পুরো ক্রিকেট বিশ্বের জন্যই দারুণ এক আবিষ্কার। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে তাকে পেয়েছে।’ স্বভাবতই মুস্তাফিজকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে বিশ্ব ক্রিকেটে। ইংলিশ কাউন্টি সাসেক্স তাকে দ্রুত পাওয়ার জন্য হয়ে উঠেছে মরিয়া। বহুল আলোচিত অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসর বিগ ব্যাশের দলগুলোর লাইন পড়ে গেছে আমাদের কাটার মাস্টারের জন্য।

তবে প্রশংসার পাশাপাশি মুস্তাফিজকে পরিচর্যার উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মলিক মুত্তিয়া মুরালিধরন। বর্তমানে হায়দারাবাদ সানরাইজার্সের কোচ এই লংকান ঘূর্ণি জাদুকর সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মুস্তাফিজ শুধু বাংলাদেশের নয় সানরাইজার্সেরও সম্পদ। খুবই সম্ভবনাময় সে। আমার বিশ্বাস তাকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে অনেক দূর যাবে।’ পরিচর্যা না করলে যত্ন না নিলে যে, শুধু প্রতিভার জোরে লম্বা সময় আলো ছড়ানো যায় না, খুবই সুন্দরভাবে এই কথাটি বুঝিয়ে দিয়েছেন মুরালিধরন।

মুস্তাফিজ কত বড় প্রতিভা সেটা এক কথায় জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের সেরা দুই ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং সাকিব আল হাসান। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে, বাংলাদেশের সেরা প্রতিভা কে? এই প্রশ্নের জবাবে এক কথায় সাকিব-মাশরাফি দু’জনই বলে দিলেন মুস্তাফিজের নাম।

মুস্তাফিজ অবশ্যই অনেক বড় প্রতিভা। তাই দায়িত্বটাও অনেক বেশি। মুস্তাফিজ যতই ক্রিকেট বিশ্বের সম্পদ হোক; সে তো বাংলাদেশের। এই দামি সম্পদকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয় সেটা স্বল্প পরিসরে দেখিয়ে দিয়েছেন হায়দারাবাদ অধিনায়ক ওয়ার্নার। বিশ্ব ক্রিকেট সবার প্রিয়, ‘দ্য ফিজ’ দীর্ঘ সময় আপন আলোয় ক্রিকেট দুনিয়াকে উজ্জল রাখলেও সেই কৃতিত্বের ভাগীদার যে বাংলাদেশই! আর সঠিক পরিচর্যার অভাবে, যত্নের অভাবে যদি ফিউজ (আল্লাহ না করুক) হয়ে যায় ফিজ, এর দায়ভারও এসে বর্তাবে বাংলাদেশের ওপর।

সম্পূর্ণ ওয়েব-ভার্সনের জাগো চ্যাম্পিয়ন পড়তে এখনই ক্লিক করুণ এই লিংকে ।

লেখক: ক্রীড়া সম্পাদক, দৈনিক বণিক বার্তা।

এমআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।