মা ফুটবল খেলতেই দিতেন না, বাবা পছন্দ করতেন

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৯:৪৯ পিএম, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

নীলফামারী সদর উপজেলার আমিনুর রহমান চাইতেন তার ছেলে মো. আল-আমিন ফুটবল খেলুক। তবে বাঁধ সেঁধেছিলেন আল-আমিনের মা আমিনা বেগম। মায়ের স্বপ্ন ছেলে মস্তবড় ক্রিকেটার হোক।

আমিনুর-আমিনা দম্পতির মতবিরোধের মধ্যেই আল-আমিনকে বেশি টানতো ফুটবল মাঠ। সুযোগ পেলেই বল নিয়ে মাঠে ছুটে যেতেন। তার মা মোটেও সেটা পছন্দ করতেন না। ফুটবল খেলতে গেলে সেদিন মা ছেলের খাওয়াই বন্ধ করে দিতেন। বকাঝকা করতেন। বাবার সায় ছিলো বলে মায়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ফুটবলে মেতে থাকতেন আল-আমিন।

বিজ্ঞাপন

যশোরের শামসুল হুদা একাডেমি থেকে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার পর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয়েছিল আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের জার্সিতে। তবে শুরুর মৌসুমে বিভীষিকাময় ছিল আল-আমিনের জন্য। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে হয়েছিলেন নিষিদ্ধ।

আবার শামসুল হুদা একাডেমিতে ফিরে গিয়ে নিষিদ্ধের বছরটি কাটিয়েছেন ফিরে আসার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব হয়ে এবার খেলছেন বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল ক্লাবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

চলতি মৌসুমে এরই মধ্যে গোল করেছেন ৯টি। ৭ গোল নিয়ে তিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্বে স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে শীর্ষে। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে এসে কিভাবে নিজেকে ঘরোয়া ফুটবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন তা নিয়ে আল-আমিন একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জাগো নিউজকে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের প্রথম পর্বে ৭ গোল করে স্থানীয়দের মধ্যে শীর্ষে আছেন। গত মৌসুমে গোলই পাননি, এবার ৯ ম্যাচেই ৭ গোল। রহস্য কী?
আল-আমিন: রহস্য কিছুই না। সবই আমার পরিশ্রমের ফল। লিগ শুরুর পরই আমি মনে মনে লক্ষ্য স্থির করেছিলাম প্রথম পর্বে ৭-৮টি গোল করবো। আল্লাহর রহমতে পেরেছি।

জাগো নিউজ: গোলদাতাদের তালিকায় ব্রাদার্সের চেক সেনের সাথে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছেন। শীর্ষে থাকা রহমতগঞ্জের স্যামুয়েল বোয়েটেং ১১ গোল নিয়ে শীর্ষে। কী লক্ষ্য নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে খেলতে নামবেন?
আল-আমিন: লিগে আমি ২০ থেকে ২৫টি গোল করতে চাই। জানি এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে প্রথম পর্বে যে গোল করেছি, দ্বিতীয় পর্বে তার দ্বিগুণেরও বেশি করতে হবে। তাহলে আমি সর্বাধিক গোলদাতা হতে পারবো। সেটা পারবো বলে আমি আত্মবিশ্বাসী।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের অভিষেক আসরই আপনার জন্য অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল। আরামবাগ ক্রীড়া সংঘে খেলার সময় ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে নিষিদ্ধও হয়েছিলেন। সেখান থেকে পুনর্জন্ম হয়েছে আপনার। কীভাবে সম্ভব হলো?
আল-আমিন: সেই দুঃসময়ের কথা আমি কোনোনি ভুলতে পারবো না। আমি ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত ছিলাম না। আমাকে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। নিষিদ্ধ ছিলাম এক বছর। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে তার জবাব আমি মাঠে পারফরম্যান্স দিয়ে দেবো। আমি যশোরের শামসুল হুদা একাডেমিতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছি এবং নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর আবার প্রিমিয়ার লিগে ফিরেছি। গোলের মাধ্যমে আমি সেই অন্যায়ের জবাব দিচ্ছি।

জাগো নিউজ: নিষিদ্ধ থাকার বছরটি কীভাবে কেটেছিল আপনার?
আল-আমিন: ওই যে বললাম, কঠোর অনুশীলন করে কাটিয়েছি। তবে মানসিকভাবে আমি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। প্রতিদিনই আমি কেঁদেছি। কারণ, আত্মবিশ্বাস থাকলেও ভাবতাম আবার কি ফুটবলে ফিরতে পারবো!

জাগো নিউজ: নিষিদ্ধ হওয়ার পর যশোরের শামসুল হুদা একাডেমিতে কীভাবে গেলেন?
আল-আমিন: আমি তো ওই একাডেমিরই ছাত্র ছিলাম। ২০১৮ সালে আমি সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখান থেকেই আমি ওই বছর নেপালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও থাইল্যান্ডে উয়েফা অনূর্ধ্ব-১৫ প্রতিযোগিতার দলে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাফুফে আমাকে নিষিদ্ধ করার পর শামসুল হুদা একাডেমি থেকে আমাকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: আপনার ফুটবলার হওয়ার পথটা কেমন ছিল? পরিবার থেকে কতটা সহযোগিতা ও উৎসাহ পেয়েছিলেন?
আল-আমিন: সেটা এক বড় কাহিনী। আমার জন্য ফুটবলার হওয়া কঠিনই ছিল। কারণ, আমার মা ফুটবল খেলতেই দিতেন না। তার ইচ্ছা ছিল আমি বড় ক্রিকেটার হই। অন্যদিকে বাবা ফুটবল পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করতেন। আমি ফুটবল মাঠে গেলে মা আমাকে খেতেই দিতেন না। এমনকি গালমন্দও করতেন। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ফুটবল মাঠে চলে যেতাম।

জাগো নিউজ: আপনার বাবা তো নিশ্চয়ই এখন খুশি, তার চাওয়া অনুযায়ী আপনি ফুটবলার হয়েছেন। মা কি আগের মতোই আছেন?
আল-আমিন: মা এখন আর আগের মতো নেই। আমি যখন ২০১৮ সালে নেপাল ও থাইল্যান্ডে যাই, তারপর থেকেই মা আমাকে ফুটবল খেলতে সমর্থন শুরু করেন। তখন তার মধ্যে হয়তো ধারণা জন্মে আমি ফুটবলে ভালো করতে পারবো।

জাগো নিউজ: আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ দিয়ে যখন প্রিমিয়ার লিগ শুরু করেছিলেন তখন তো আপনি রক্ষণে খেলতেন। ফরোয়ার্ড হলেন কীভাবে?
আল-আমিন: আমি শুরুতে রক্ষণেই খেলতাম। অনূর্ধ্ব-১৫ লে রাইটব্যাকে খেলেছি। আরামবাগের তখনকার কোচ আমাকে খেলিয়েছেন লেফটব্যাকে। মাঝে মধ্যে লেফটউইংয়েও খেলিয়েছেন। এ নিয়েও আমার বাবার আপত্তি ছিল। তিনি বলতেন আক্রমণভাগে খেলতে, ১০ নম্বর জার্সিতে খেলতে। আমাকে বলতেন ‘রক্ষণে খেলিস কেনো? স্ট্রাইকার খেলবি, ১০ নম্বর জার্সি নিয়ে খেলবি। ওই জার্সির একটা নাম আছে। গোল করলেও সবাই মনে রাখে।’

বিজ্ঞাপন

আমি অবশ্য জেলা দলে ফরোয়ার্ড পজিশনেই খেলতাম। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে যখন শেখ জামালের জার্সিতে প্রিমিয়ার লিগে ফিরলাম তখন আক্রমণভাগে খেললেও নাম্বার নাইন পজিশনে সুযোগ পেতাম না। কারণ, তখন ওই পজিশনে ভালো বিদেশি ছিলেন, ফয়সাল আহমেদ ফাহিমও ছিলেন। তাই আমি উইংয়ে খেলতাম।

জাগো নিউজ: শেখ জামালের জার্সিতে প্রিমিয়ার লিগে গোল না থাকার কারণ কি নাম্বার নাইন পজিশনে খেলার সুযোগ না পাওয়া? এবার পুলিশের জার্সিতে কি সেই সুযোগ পাচ্ছেন?
আল-আমিন: গত লিগে আমি বেশিরভাগ ম্যাচ খেলেছি উইংয়ে। দ্বিতীয় পর্বে ফয়সাল আহমেদ ফাহিম ইনজুরিতে ছিলেন বলে কয়েকটি ম্যাচে একাদশেই সুযোগ পেয়েছিলাম। দুটি ম্যাচে নাম্বার নাইন পজিশনে খেলেছি। লিগে আমার গোল ছিল না, তবে দুইটা এসিস্ট ছিল। এবার আমি পুলিশ এফসিতে পুরোপুরি নাম্বার নাইন পজিশনেই খেলছি।

জাগো নিউজ : আপনার পরিবারে আর কে কে আছেন? অন্য কেউ খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত আছেন?
আল-আমিন : বাবা-মা এবং দুই ভাই এক বোনের সংসার আমারে। বাবা স’ মিলে চাকরি করেন, মা গৃহিনী। আমি ছাড়া কেউ খেলাধুলা করে না। ছোট ভাইয়ের বয়স মাত্র ১ বছর। বোন এবার দশম শ্রেণিতে উঠবে। আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। ব্যক্তিগত কারণে একটা গ্যাপ হয়েছে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা আছে।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: বলছিলেন আপনার বাবা চাইতেন আপনি গোল করেন। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্বে ৭ গোল করায় আপনার বাবার প্রতিক্রিয়া কী?
আল-আমিন: আসলে বাবা ফুটবল ভালোবাসলেও খেলা তেমন বোঝেন না। আমি যে স্থানীয়দের মধ্যে শীর্ষে আছি, সেটাও তাকে বলিনি। মাকে বলেছি। তিনি হয়তো বাবাকে বলেছেন।

জাগো নিউজ: প্রিমিয়ার লিগে করা ৭ গোলের মধ্যে কোন গোলটি আপনার মনে রাখার মতো?
আল-আমিন: আমি ৩ ম্যাচে জোড়া গোল করেছি এবং এক ম্যাচে একটি। মোহামেডানের বিপক্ষে ম্যাচে করা একমাত্র গোলটিই আমার কাছে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর ফেডারেশন কাপে বসুন্ধরা কিংসের বিপক্ষে জোড়া গোলের কথাও উল্লেখ করতে চাই।

জাগো নিউজ: স্থানীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল করে নিশ্চয়ই আপনি জাতীয় দলের কোচ ক্যাবরেরার নজর কেড়েছেন। আপনার কি মনে হয় মার্চের এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ক্যাম্পে ডাক পাবেন?
আল-আমিন: আমি এ পর্যন্ত নিজের পারফরম্যান্সে খুিশি। কিংসের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস না করলে তো গোল বাড়তো। আরো ভালো পারফরম্যান্স হতে পারতো। তবে নিজের পারফরম্যান্সে আমি খুশি। আত্মবিশ্বাসী যে আমাকে কোচ ডাকবেন। আগে কখনো জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পাইনি। যদি ডাক পাই, তাহলে ভালো করে চূড়ান্ত দলে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
আল-আমিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরআই/এমএমআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।