ফিরে দেখা ২০২৪

ফুটবলে চার ট্রফি, সালাউদ্দিনের বিদায় ও হামজা

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ১০:০৬ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

আর কয়েক ঘণ্টা পর বিদায় নেবে ২০২৪ সাল। পৃথিবীর চিরায়িত নিয়মে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরেকটি বছর। পূরনো জীর্ণতা মুছে ফেলে মানুষ নতুন প্রত্যাশায় শুরু করবে নতুন একটি বছর। নতুন বছরের খাতা খোলার আগে সমাজের সব সেক্টরের মানুষ মিলিয়ে নেয় বিদায়ী বছরের হিসাব-নিকাশ। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কত মিল ছিল সে সমীকরণ মিলিয়ে থাকেন সবাই। ব্যতিক্রম নয় ক্রীড়াঙ্গনের মানুষও।

২০২৪ সালে কেমন ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন? ফুটবলের ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কতটুকু মিল ছিল? সফলতা নাকি ব্যর্থতার পাল্লা ভারী? বিদায়ী বছরের বিশ্লেষণ থাকছে এই প্রতিবেদনে।

মোটা দাগেই লিখে দেওয়া যায় বিদায়ী বছরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল নারী ফুটবল দলের সাফ শিরোপা ধরে রাখা। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

নেপালের কাঠমান্ডুতে হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে স্বাগতিকদের হারিয়ে শিরোপা ধরে রাখে সাবিনা-ঋতুপর্ণা চাকমারা। ২০২২ সালে এই নেপালেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়েছিল। এই অঞ্চলের নারী ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সবার ওপরে ভারত ও নেপাল। সেই দুটি দেশকে টপকে টানা দুইবার সাফ জেতা বাংলাদেশের নারী ফুটবলের উন্নতির বার্তা বহন করে। চমক বা অঘটন নয়, বাংলাদেশের মেয়েরা দুইবারই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে সেরার মুকুট মাথায় পরেছে।

সিনিয়র দলের পাশাপাশি মেয়েদের জুনিয়র দলেরও সাফল্য ছিল ২০২৪ সালে। ঢাকায় হওয়া সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারতের সাথে। অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপেও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ বছর সাফ জিতেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ বালক দলও। অর্থাৎ বিদায় নেওয়া বছরে বাংলাদেশ চারটি ট্রফি জিতেছে সাফ অঞ্চলে। যার তিনটিই নারী ফুটবলে।

নারী ফুটবলে সাফল্য এলেও যথারীতি হতাশার চিত্র পুরুষ জাতীয় দলে। ২০২৪ সালে জাতীয় দল ৮ ম্যাচ খেলে জিতেছে মাত্র দুটি। তাও ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে।

ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ হেরেছেও বাংলাদেশ। একটি থিম্পুতে ভুটানের বিপক্ষে, আরেকটি ঢাকায় মালদ্বীপের বিপক্ষে। ২০১৬ সালের পর আবার ভুটানের বিপক্ষে মাথা নত হয়েছে বাংলাদেশের। ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো মালদ্বীপের কাছে হেরেছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।

ফুটবলে এবার ছিল নির্বাচনের বছর। মাঠের বাইরে এটিই ছিল ফুটবলের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। দীর্ঘ ১৬ বছর পর অবসান হয়েছে কাজী মো. সালাউদ্দিনের রাজত্ব। তিনি অবশ্য নির্বাচনই করেননি। নতুন সভাপতি হয়েছেন সাবেক ফুটবলার তাবিথ আউয়াল।

বাফুফের নির্বাচন ঘিরে কেবল ফুটবল অঙ্গনেই নয়, চায়ের টেবিলে ঝড় উঠেছিল ক্রীড়াঙ্গনের সব জায়গাতেই। কাজী মো. সালাউদ্দিন পঞ্চমবারের মতো নির্বাচন করতে চেয়েও যখন ইউটার্ন নিয়েছিলেন তখনই নিশ্চিত হয়েছিল নতুন নেতৃত্ব পেতে যাচ্ছে দেশের ফুটবল। দেখার ছিল কে বসেন দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় চেয়ারে? বাফুফের সাবেক সহসভাপতি তাবিথ আউয়াল ফিরে এসেছেন সভাপতি নির্বাচিত হয়ে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী ফুটবলের সফলতার গল্প থাকলেও ঘরোয়া ফুটবলে আছে চ্যাম্পিয়নদের লিগ না খেলার মতো ঘটনা। নারী ফুটবল লিগে এবার খেলেনি টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস। জাতীয় দলের সিংহভাগ খেলোয়াড় নিয়ে এবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে চমক দেখিয়েছে নাসরিন স্পোর্টস একাডেমি। নাসরিন ৮ ম্যাচের মধ্যে একটি ম্যাচ ড্র করেছিল। ২২ পয়েন্ট নিয়ে প্রথমবার নারী লিগে বিজয় উৎসব করে ক্লাবটি।

২০২৪ সালে দেশের ফুটবলে আরেকটি বড় খবর ছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লেস্টার সিটিতে খেলা হামজা চৌধুরীকে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলাতে ফিফার অনুমতি দেওয়া।

অনেক দিন ধরেই আলোচনায় ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ইংলিশ ফুটবলার। তিনি বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার আগ্রহ প্রকাশের পর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছিল বাফুফে। হামজার বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র করে দেওয়া, পাসপোর্ট করে দেওয়া, লেস্টার সিটি এবং ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ছাড়পত্র এনে দেওয়ার পর আবেদন করা হয়েছিল ফিফায়।

ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটি সবকিছু বিবেচনা করে হামজাকে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার অনুমতি দিয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে নতুন বছরের ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচ দিয়ে লাল-সবুজ জার্সিতে অভিষেক হবে হামজা চৌধুরীর।

এ বছর চিরবিদায় নিয়েছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে গঠন হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। সেই দলটি ভারতের বিভিন্ন শহরে প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল। দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিল তারাই প্রথম। সেই দলের অনেক খেলোয়াড়ই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ২০২৪ সালেই মারা গেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ৫ জন সদস্য।

এশিয়ান নারী ফুটবলের অন্যতম মর্যাদার আসর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। সেই লিগে বাংলাদেশের কোনো ক্লাব না খেললেও প্রথমবারের মতো মাঠে অভিষেক হয়েছে তিন নারী ফুটবলারের। বাংলাদেশের কোনো ক্লাব না খেললেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ছিলো ভুটানের ক্লাব রয়েল থিম্পু কলেজ এফসি।

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের চার তারকা ফুটবলার অধিনায়ক সাবিনা খাতুন, মারিয়া মান্ডা, মনিকা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমাকে নিয়েছিল ভুটানের ক্লাবটি। সাবিনা খাতুন ছাড়া বাকি তিনজন খেলেছেন। সাবিনা খাতুনের আগের ক্লাব ভারতের কিকস্টার্ট থেকে সময়মতো ছাড়পত্র না পাওয়ায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলা হয়নি বাংলাদেশ অধিনায়কের। বিদায়ী বছরে ভারতের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে সে দেশের নারী লিগ খেলেছেন সানজিদা আক্তার।

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে নতুন টুর্নামেন্ট অন্তর্ভূক্ত হয়েছে ২০২৪ সালে। আগের মৌসুমের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের চাম্পিয়ন ও ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের এক ম্যাচের এই টুর্নামেন্ট নিয়ে প্রতি বছর খেলা মাঠে গড়ানোর পরিকল্পনা করেছে বাফুফে।

গত মৌসুমে তিনটি ট্রফিই জিতেছিল বসুন্ধরা কিংস। তাই ফেডারেশন কাপ রানার্সআপ মোহামেডান খেলেছে এই টুর্নামেন্টে। ২২ নভেম্বর খেলা হয়েছিল বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। ঘটনাবহুল ম্যাচে মোহামেডানকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথম ট্রফিটি ঘরে তুলে বসুন্ধরা কিংস। দর্শক উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় ২০ মিনিট খেলা বন্ধ ছিল।

দেশের রাজনীতির পট পরিবর্তনের ধাক্কা লেগেছিল ক্রীড়াঙ্গনে। দীর্ঘ সময় ধরে ঘরোয়া ফুটবলে শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র নিজেদের গুটিয়ে নেয়। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের তিনবারের চ্যাম্পিয়ন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও একবারের চ্যাম্পিয়ন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র নেই এবারের ফুটবল মৌসুমে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হামলা হয়েছিল আবাহনী ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবসহ কয়েকটি ক্লাবে। আবাহনীও খেলবে না বলে বাতাসে খবর ভাসছিল। শেষ পর্যন্ত আবাহনী খেললেও কোনো বিদেশি নেয়নি তারা। বিদেশিশূন্য আবাহনী খেলছে এবারের ফুটবল মৌসুম।

এ বছরে বাফুফে নিজেদের করে পেয়েছে দেশের অন্যতম ক্রীড়া স্থাপনা চট্টগ্রামের এমএ আজীজ স্টেডিয়ামকে। সরকার ১০ বছরের জন্য এই স্টেডিয়াম ফুটবলকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।

আরআই/আইএইচএস/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।