স্মরণকালের সেরা ফাইনাল দেখলো ফুটবল বিশ্ব

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৫:১৫ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২

ফুটবল অনুরাগীরা কি বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ, জমজমাট ও রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল ম্যাচটি দেখে ফেললো? সেই ১৯৩০ থেকে শুরু হয়ে দশকের পর, বিশেষ করে সত্তরের দশক থেকে কী এমন আকর্ষণীয়, আক্রমন-পাল্টা আক্রমনে ঠাসা ফাইনাল দেখেছে কেউ? স্মৃতি হাতড়ে, পরিসংখ্যান ঘেঁটে তো তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।

গতকাল ১৮ ডিসেম্বর রোববার মধ্য রাতের পর থেকে এ কৌতুহলি প্রশ্ন অনেকের মনেই উঁকিঝুকি দিচ্ছে। প্রশ্নটা মোটেও অমূলক নয়। বিশেষ করে জিকো, সক্রেটিস, ম্যারাডোনা, প্লাতিনি, রুমেনিগেদের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফাইনালে এত তীব্র লড়াই খুব কমই হয়েছে।

শুধু ফাইনালের কথা বলা কেন, বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে আর্জেন্টিনা আর ফ্রান্সের গতকালের ফাইনালের মত স্মরণীয়, আকর্ষণীয় ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই খুব কমই হয়েছে।

এতকাল ফুটবল বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচ হিসেবে ধরা হতো ১৯৮৬ সালে ব্রাজিল আর ফ্রান্সের কোয়ার্টারফাইনাল ম্যাচকে। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে অমিমাংসিত থাকা খেলায় শেষ পর্যন্ত জিকো ও সক্রেটিসের ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে হারিয়ে সেমিতে চলে যায় মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্স।

বড় ও নামি ফুটবল বিশেষজ্ঞরা সে ম্যাচকেই ফুটবলের ধ্রুপদি লড়াই এবং আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ম্যাচ হিসেবে ধরে থাকেন। এছাড়া ১৯৮২ সালে ইতালি আর ব্রাজিলের দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রচন্ড গতি, আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণের ম্যাচটিও খুঁব উঁচু মার্গের ফুটবল লড়াই হিসেবে চিহ্নিত। স্পেনের বার্সিলোনার সারিয়া স্টেডিয়ামে ইতালিয়ান ফুটবলের সোনার ছেলে খ্যাত পাওলো রোসির অনবদ্য হ্যাটট্রিকে যে লড়াইয়ে ব্রাজিলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয় ইতালি।

Messi

১৯৮৬ সালের ২১ জুন মেক্সিকোর জালিসকো স্টেডিয়ামে হয়েছিল ব্রাজিল আর ফ্রান্সের সেই স্নায়ুক্ষয়ী লড়াই। শুরু থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আক্রমণ, প্রতি আক্রমণে পূর্ণ ছিল খেলাটি। ৬৫ হাজার ফুটবলপ্রেমি চোখের সামনে দারুণ জমজমাট লড়াই উপভোগ করেন।

টিভির পর্দায় শত কোটি ফুটবল অনুরাগী দেখেন এক প্রচন্ড দ্রুত গতির, উচ্চ মার্গের ফুটবল। গতির ওপর যতটা সাজানো গোছানো ফুটবল খেলা সম্ভব, ব্রাজিল আর ফ্রান্স তাই খেলেছিল সে ম্যাচে। মুহুর্মুহু আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণে পূর্ণ ছিল ম্যাচটি।

১৭ মিনিটে স্ট্রাইকার ক্যারেকার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। লেফট উইং ব্যাক জুনিয়রের বাড়ানো বল ধরে স্ট্রাইকার ক্যারেকটা এগিয়ে দেন হলুদ জার্সিধারীদের; কিন্তু বেশিক্ষণ লিড ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ৪১ মিনিটে ফ্রান্স খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনে। ডমিনিক রোচেতাওয়ের কাছ থেকে বল পেয়ে ব্রাজিল গোলরক্ষক তাফারেলকে পরাস্ত করে ফ্রান্সকে খেলায় ফিরিয়ে আনেন ফরাসী ফুটবলের বড় তারকা প্লাতিনি। ১-১ হয়ে যাবার পর এগিয়ে যাবার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল ব্রাজিল।

কিন্তু তা হাতছাড়া করেন ব্রাজিলেল সোনার ছেলে ‘সাদা পেলে’ জিকো। বদলী খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে নেমে অল্প কয়েক মিনিট পরই পেনাল্টি শটে গোল করতে ব্যর্থ হন জিকো।

সেই পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারলে ব্রাজিল এগিয়ে যেত ২-১ ব্যবধানে। তাহলে খেলার চিত্র ও ফল ভিন্ন হতে পারতো; কিন্তু জিকোর নিচু ড্রাইভ ঠেকিয়ে ওদেন ফরাসী গোলকিপার জোয়ের বেটস। পরে টাইব্রেকারে ব্রাজিল হারে ৩-৪ ব্যবধানে।

Messi

ব্রাজিলেল পক্ষে গোল করতে ব্যর্থ হন সক্রেটিস এবং হুলিও সিজার। পেনাল্টি শ্যুটআউটের শেষ শটে লুইস ফার্নান্ডেজ গোল করে ফরাসী ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় জয়টি নিশ্চিত করেন। পেলে, গ্যারিঞ্চার পর ব্রাজিল ফুটবল ইতিহাসের দুই সেরা তারকা জিকো, সক্রেটিসের ব্রাজিল বিদায় নেয় বিশ্বকাপ থেকে। মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্স পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে।

এতকাল ধরা হতো সেটাই বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচ। আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ, গতি, ছন্দ ও ফুটবলের সব রকম সৌন্দর্য্যে ভরা ছিল সে ম্যাচটি। যারা দেখেছেন তাদের স্মৃতিতে ৮৬‘র বিশ্বকাপে ফ্রান্স আর ব্রাজিল কোয়ার্টারফাইনালের কথা এখনো ¯ভাস্মর হয়ে আছে।

এছাড়া আরও ক’টি ম্যাচকে ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বিশেষ ভাবে স্মরনীয়, উপভোগ্য আর আকর্ষণীয় লড়াই হিসেবে পরিগণিত করেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৫০ সালের ব্রাজিল আর উরুগুয়ে ফাইনাল (শেষ) ম্যাচ। ব্রাজিলের মারকানা স্টেডিয়ামে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে ব্রাজিল শুরুতে ১-০ গোলে এগিয়েও পারেনি। উরুগুয়ে ২ গোল করে ২-১ ব্যবধানে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে। লক্ষাধিক ব্রাজিলিয়ান নিজ চোখে প্রিয় দলের পরাজয় প্রত্যক্ষ করেন।

এরপরই চলে আসে ১৯৫৪ সালে পশ্চিম জার্মানি আর হাঙ্গেরি ফাইনাল। যে ম্যাচে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও পারেনি হাঙ্গেরি। জার্মানি দুই গোল শোধ করে তারপরও রাইট উইং হেলমুট রানের গোলে পায় ঐতিহাসিক জয় এবং সেটাই জার্মানদের প্রথম বিশ্বকাপ বিজয়।

জমজমাট লড়াই আর রুদ্ধশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বীতার তালিকায় ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড আর পশ্চিম জার্মানির ফাইনালটিও আছে। ৬৬ সালের ৩০ জুলাই ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ৯৭ হাজার দর্শকের সামনে ইংলিশ ফুটবলের সব সময়ের অন্যতম নামি তারকা ববি মুরের নেতেৃত্বে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে প্রথমবার ও এখন পর্যন্ত একবার বিশ্বকাপ বিজয়ী হয় ইংল্যান্ড।

এরপর ৭০-এর বিশ্বকাপে ইতালি বনাম পশ্চিম জার্মানি ম্যাচটিও বিশেষ স্মরণীয়। এছাড়া ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার ২-২ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচটিকেও বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ও টান টান উত্তেজনার ম্যাচ বলে ধরা হয়।

তবে আগের সব ম্যাচ এর লড়াই ও আকর্ষণ ঢাকা পড়ে গেছে গতকাল ১৮ ডিসেম্বর কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফাইনালে।

দ্রুত গতি, লয় ছন্দ আর সাজানো গোছানো আক্রমণে ফরাসী মাঝমাঠে জায়গা বের করে আর রক্ষণব্যুহ্যে চিড় ধরিয়ে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় মেসির আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধে ২ গোলে পিছিয়ে পড়া ফ্রান্স দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে যেন আহত বাঘ হয়ে ওঠে।

মাত্র ৯৭ সেকেন্ডে ২ গোল শোধ করে খেলায় ফিরে আসে। তারপর আবার এগিয়ে যায় মেসির দল। সেই গোল শোধ করে ৩-৩ এ সমতা এনেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি ফরাসীরা। আর্জেন্টাইন গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজের অনমনীয় দৃঢ়তার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। পেনাল্টি শ্যুটআউটে ৪-২ গোলে জয়ী হয় আর্জেন্টিনা।

বিশ্বের শত কোটি ফুটবল অনুরাগি প্রাণভরে এ ফাইনাল প্রত্যক্ষ করেন। ভক্ত, সমর্থক ও নিরপেক্ষ ফুটবল অনুরাগি সবার একটাই কথা, ফাইনালের মত এক ফাইনাল দেখেছি।

সত্যিই ফাইনালের মত ফাইনাল হয়েছে। এত আকর্ষণ, দ্রুত গতি, আক্রমন আর প্রতি আক্রমণে নয়ন জুড়ানো গোলের সমাহার-সবই ছিল ম্যাচটিতে। তাই এটা স্মরণাতীতকালের অন্যতম সেরা ও আকর্ষনীয় এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ লড়াই হিসেবে দর্শকদের মনিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে। থাকবে অনাদিকাল।

এআরবি/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।