মেসিদের ম্যাচের বলবয় এখন জাতীয় দলের গোলরক্ষক

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৩:০৪ পিএম, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

রাজবাড়ীর কল্যাণপুর গ্রামের ইউসুফ জমাদ্দার পরিবারসহ রাজধানীতে থাকেন ৩০ বছর ধরে। আরামবাগে বাসা নিয়ে হোটেল ব্যবসা করতেন পুরোনো ঢাকা নাজিরাবাজারে। ছেলেরা এখন আর ব্যবসা করতে দেন না ইউসুফ জমাদ্দারকে। নিজেরা আয়-উপার্জন শুরুর পর বাবাকে বলে দিয়েছেন- আর কোনো কাজ নয়। ৯ বছর আগে হোটেল ছেড়ে এখন দুই ছেলের আয়ে পরিবারসহ আয়েশে দিনা যাপন করছেন ইউসুফ জমাদ্দার। কোনো অনটন নেই সংসারে।

ইউসুফ জমাদ্দার ও তার পরিবারের দিন বদলে দিয়েছেন তার দুই ফুটবলার ছেলে পাপ্পু হোসেন ও সুজন হোসেন। দুইজনই গোলরক্ষক- সুজন খেলেন মোহামেডানে ও পাপ্পু হোসেন সাইফ স্পোর্টিংয়ে। এর মধ্যে পাপ্পুর নাম-ডাক এবং আয়-রোজগার দুটোই বেশি। করপোরেট দলে খেলেন, জাতীয় দলেও ডাক পেয়েছেন। অপেক্ষা কেবল অভিষেকের।

বাবার হোটেল ব্যবসায় সহযোগিতা আর পড়াশুনার ফাঁকে যে সময়টা পেতেন পাপ্পু সে সময়টায় মেতে থাকতেন ফুটবল নিয়ে। মোহামেডানের অন্ধভক্ত। সাদা-কালোদের কোনো খেলা মিস করতেন না, যদি ক্লাস বা পরীক্ষা না থাকতো। মোহামেডানের খেলা দেখতে দেখতেই বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন ফুটবলে।

খেলার মাঠে যেতে যেতে এক সময় হয়ে যান বলবয়। ২০০৯ সালে মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ দিয়ে বড় ম্যাচে বলবয়ের দায়িত্ব পালন শুরু। খুব কাছ থেকে প্রিয় দলের খেলা দেখার স্মৃতি এখনো যেন টাটকা পাপ্পু হোসেনের কাছে। এরপর এসএ গেমস ফুটবল এবং ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে হওয়া আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া ম্যাচেও বলবয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন পাপ্পু।

jagonews24

তৃণমূলের কোচ হিসেবে ফুটবলাঙ্গনে পরিচিত মুখ ইব্রাহিম খলিল। স্টেডিয়াম এলাকায় যার পরিচিতি কালা নামে। এই কালার কাছেই ফুটবল খেলা শিখে এখন অনেকেই বড়বড় ক্লাবে খেলছেন, যার মধ্যে অন্যতম পাপ্পু হোসেন। শুরুতে খেলতেন রক্ষণে। পরে পোস্টের নিচে নিয়ে আসেন কালা। ‘শুরুতে পাপ্পু ডিফেন্সে খেলেছে। আমার মনে হয়েছিল গোলকিপিংয়ে ভালো করবে। তাই একদিন বললাম- তুই গোলকিপিং কর। তারপর থেকেই সে পোস্টের নিচে’- বলছিলেন ইব্রাহিম খলিল কালা।

মতিঝিল-আরামবাগের ছেলেদের ফ্রি ফুটবল শেখাতেন কালা। এখনও শেখান। কালার ফুটবল পাঠশালায় ২০০৯ সালে যুক্ত হয়েছিল পাপ্পু, তার ভাই সুজন এবং মামা সোহেল রানা। তারপর থেকেই উন্নতির সিঁড়িতে হাঁটতে থাকেন পাপ্পু। ২০১১ সালে জেএফএ কাপ, পরের বছর নেপালে অনূর্ধ্ব-১৪ ফেস্টিভ্যাল ফুটবলে সুযোগ পান বর্তমানে জাতীয় দলের তিন নম্বর গোলরক্ষক পাপ্পু হোসেন।

কালার মাধ্যমেই পাপ্পু ২০১৩ সালে যোগ দেন মোহামেডানের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে। সেখান থেকে পরের বছর পেশাদার ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘে। তিন বছর আরামবাগে খেলার পর ২০১৭ সালে যোগ দেন সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবে। ২০১৯ সালের লিগের দ্বিতীয় পর্বে সাইফ থেকে মোহামেডানে নাম লেখান পাপ্পু। মোহামেডানে খেলেই পড়েন জাতীয় দলের ইংলিশ কোচ জেমির নজরে। পরের বছরই আবার ফিরে যান সাইফে। সাইফ থেকেই তিনি ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় দলে।

গত বছর ৪ ডিসেম্বর কাতারে বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচে ২৩ জনের দলে তাকে রেখেছিলেন জেমি ডে। তবে লাল-সবুজ জার্সিতে এখনো খেলা হয়নি তার। অভিষেকের অপেক্ষায় আছেন ২২ বছর বয়সী এই তরুণ। জাতীয় দলে না খেললেও লাল-সবুজ জার্সিতে বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন তিনি।

২০১৭ সালে এএফসি ও সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। ২০১৯ সালে বাহরাইনে খেলেছেন এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে। শ্রীলংকার বিপক্ষে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচে পুরো সময়ই খেলেছিলেন পাপ্পু হোসেন। ২০১৯ এর ডিসেম্বরের নেপালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমস ফুটবলও খেলেছেন তরুণ এই গোলরক্ষক।

jagonews24

‘গলি থেকে রাজপথ’-এ ওঠার মতো পাপ্পু হোসেনের জীবনটাও তরতর করে ওপরে উঠিয়েছে ফুটবল। জীবনের বাঁকবদলের গল্পটা কেমন ছিল তার?

‘আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি। রাজবাড়ী জেলার সদর উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামে বাড়ি। ৩০ বছর আগে মাকে নিয়ে বাবা ঢাকায় সংসার শুরু করেন। অলি-গলি আর আরামবাগ বালুর মাঠে ফুটবল খেলেছি। কালা স্যারের (ইব্রাহিম খলিল কালা) কাছে খেলা শিখতামও বলবয়ের কাজ করতাম। আমার ফুটবলার হওয়ার পেছনে কালা স্যারের অনেক অবদান। নিজে রোজগার শুরুর পর বাবাকে কোনো কাজ করতে দেই না। গত অক্টোবরে আরামবাগের বাসা ছেড়ে পল্টনে আরেকটু ভালো বাসা নিয়েছি। সেখানে মা-বাবা, ভাবী (সুজনের স্ত্রী) ও ছোট ভাই থাকেন। আল্লার রহমতে এখন আমরা অনেক ভালো আছি’- বলছিলেন পাপ্পু হোসেন।

ফুটবল খেলে উপার্জিত টাকা দিয়ে বাবার কিছু ঋণ ছিল তা শোধ করেছেন, রাজবাড়ীতে চাষের জমি কিনেছেন। বড় বোনকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ভাইকে পড়াশুনা করাচ্ছেন এবং নিজেও পড়ছেন ফারইস্ট ইউনিভার্সিটিতে (বিবিএ)। গ্রামের বাড়িতে চাচারা থাকেন। ‘সেখানে দুই ভাইয়ের নামে কেনা সাড়ে ৩৬ শতাংশ ফসলি জমিটা চাচারাই দেখাশুনা করছেন’-বলছিলেন পাপ্পু।

পরিবারে টানাপোড়েন নেই। এখন পাপ্পুর ধ্যানজ্ঞান শুধুই ফুটবল। মঙ্গলবার প্রিমিয়ার লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শেখ জামালের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে এগিয়েও ম্যাচটি হেরেছে ৩-২ গোলে। মনটা খারাপ। তারপরও নিজের বেড়ে ওঠা, ফুটবলার হওয়াসহ অনেক গল্পই শুনিয়েছেন তরুণ এই গোলরক্ষক। আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচে বলবয় থাকার কারণে খুব কাছ থেকে দেখেছেন মেসির খেলা। ক্যারিয়ারে যেটা অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা তার।

আরআই/আইএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।