লা মাসিয়া : ঐতিহ্যবাহী এক ফুটবল একাডেমির করুণ মৃত্যু

রুশাদ রাসেল
রুশাদ রাসেল রুশাদ রাসেল , স্পোর্টস কন্ট্রিবিউটর
প্রকাশিত: ১০:৪৮ এএম, ২৭ জুন ২০২০

২০১২ সালে 'ফোর ফোর টু' ভিক্টর ভালদেসের সঙ্গে প্রথম দেখা করে বার্সেলোনার নতুন অনুশীলন মাঠে। এর এক মাসে আগে এওয়ে ম্যাচে লেভান্তের বিপক্ষে বার্সেলোনার ১১ জন একাডেমি গ্রাজুয়েট খেলোয়াড় মাঠে নামে। যেটা ছিল তখনকার বিবেচনায় অকল্পনীয়। ভিক্টোর ভালদেস সেই দিনটি নিয়ে সবসময়েই গর্ব করেন।

‘আপনি যে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না যে তাদের ১১ জন খেলোয়াড়ই একাডেমি থেকে আসেনি কেন। এটা এমন একটা জিনিস যাকে অন্য সেরা দলগুলোর লক্ষ্য করা উচিত। আপনাকে সেরা ক্লাব হওয়ার জন্য বড় খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ানোর দরকার নেই’- বলছিলেন ভালদেস।

তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই জিনিসটা ১৫-২০ বছরের ফল। রাতারাতি এটা হয়ে যায়নি। যারা ক্লাবের সঙ্গে এখন নেই তারাও ঋণী এই দিনটির জন্য। পুরোনো কোচদের কাছ থেকে অনেক বার্তা পেয়েছি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর। তারাও এই সাফল্যের অংশ।’

ভালদেস, মনতোয়া, পুয়োল, পিকে, আলবা, বুসকেটস, ফ্যাব্রিগাস, জাভি, ইনিয়েস্তা, পেড্রো এবং মেসিরা লেভান্তকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল। লা মাসিয়ার অনেক গ্রাজুয়েট তখন বেঞ্চে ছিল। কোচ ছিলেন টিটো ভিলানোভা। যিনি নিজেও একজন লা মাসিয়ার ছাত্র ছিলেন এবং পরবর্তীতে পেপ গার্দিওলার অধীনে সহকারী কোচ ছিলেন। কাতালানদের ট্রেনিং গ্রাউন্ডের নামকরণ করা হয়েছে টিটো ভিলানোভার নামে যিনি ২০১৪ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

ক্যাম্প ন্যু থেকে ৪ মাইল দূরে লবরেগ্যাট রিভার ভ্যালিতে অবস্থিত ট্রেনিং গ্রাউন্ডটি আসল মাসিয়ার থেকে আরও সুন্দর করে সাজানো। মাসিয়া অর্থ ‘ফার্মহাউজ’। আসল ফার্মহাউজটি এখনও বার্সেলোনা স্টেডিয়ামের বাইরে আছে। ২০০৭ সাল থেক ভ্রমণপিয়াসুরা সহজেই বার্সার ১ম ট্রেনিং গ্রাউন্ডটি দেখতে পারেন স্টেডিয়ামের ডান সাইডে।

বার্সার পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম। গুটিকয়েক ক্লাবের মধ্যে বার্সা অন্যতম ছিল যারা আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ট্রেনিং গ্রাউন্ড করেছিল। তাদের নতুন ট্রেনিং গ্রাউন্ডটি রিয়াল মাদ্রিদের মত নয়, তবুও আছে ৮৪টা রুম, আছে একটি বিল্ডিংয় যেটা আইবিস হোটেলের মত দেখতে। অনেক গ্রাজুয়েট এখান থেকে বার্সার মূল দলে খেলে ফেলেছে।

২০১০ সালের ব্যালন ডি’অরে মেসি, জাভি ও ইনিয়েস্তার শীর্ষ তিনে থাকাটা লা মাসিয়ার এ যাবৎকালের অন্যতম সেরা অর্জন। যখন তারা একসঙ্গে লা মাসিয়া থেকে বার্সেলোনার মূল দলে জায়গা করে নেয় তখন তাদের রুমে ছাপ রেখে গিয়েছিল ‘আমরা একসঙ্গে শক্তিশালী’ কথাটার। ক্লাবের রুমে ইয়োহান ক্রুইফ ও লাইরেয়ানোর ছবিও আছে যারা ক্লাবের আমূল পরিবর্তন করেছিল ১৯৭০ এবং ১৯৮০'র দশকে।

বার্সেলোনা স্পষ্টবাদী মানুষের পাশাপাশি অসাধারণ খেলোয়াড়দের তৈরি করতে চায়, যেন প্রতিপক্ষ কখনও তাদের শত্রু না ভাবে, এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে ভালো কিছু তৈরি হয় এবং কোনকিছু ধ্বংস না হয়ে। তেমনি ফুটবলও এমনভাবে পুনরুদ্ধার করতে হবে যাতে সেটাকে কেউ চুরি মনে না করে। রাতের বেলা লা মাসিয়াতে ওয়াইফাই বন্ধ থাকে।

১২ মিলিয়ন ইউরোতে ৬ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ইয়োহান ক্রুইফ স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়েরা অসাধারণ একটি পরিবেশ পায়। বার্সা বি দলের জন্য ৬ হাজার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্টেডিয়ামটি বেশ ভালো, যেখানে গেল ১০ বছর গড়ে দর্শক ছিল ২৯০০ জন। এখন চাইলেই বি দলের স্টেডিয়ামে খেলা শেষ করে মূল দলের খেলা দেখতে ক্যাম্প ন্যুতে যাওয়া যাবে না। বার্সার নারী দল যারা ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী নারী দল, তাদেরই মূল স্টেডিয়াম এই বি দলের মাঠটি। বার্সা নারী দল ২০১৯ সালের নারী চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালিস্টও ছিল।

ইয়োহান ক্রুইফের ছবি এবং তার উক্তিতে পুরো স্টেডিয়াম সয়লাব। ‘ফুটবল একটি খেলা যা খেলা হয় মস্তিষ্ক দিয়ে’, ‘আমি ১-০ গোলের জয়ের থেকে ৫-৪ ব্যবধানের জয়কেই এগিয়ে রাখি’ ইত্যাদি উক্তি রয়েছে সেখানে।

বিশ্বের সেরা একাডেমি হিসেবে পরিচিত লা মাসিয়ার গৌরব দিনকে দিন বাড়তেছিল কিন্তু সেটি তলানিতে নামতেও সময় নেয়নি। লেভান্তের বিপক্ষে ২০১২ সালের ম্যাচটি বার্সার লা মাসিয়ার জন্য অন্যতম বড় খাদ ছিল।

যে দলটা ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মাত্র ১টি লা লিগা জিতেছে, সেই দলটাই রূপান্তর হয় ধারাবাহিকভাবে লা লিগা জয়ের ক্লাবে। পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও ছড়ি ঘোরাতে থাকে স্থানীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের নিয়ে, যাদেরকে পরে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অন্যতম সেরা বানানো হয়েছিল। ফেরাল সরিয়ানো যিনি ম্যানচেস্টার সিটির বর্তমান প্রধান নির্বাহী অফিসার এবং বার্সার হয়ে ৫ বছর সহ-সভাপতি ছিলেন, তার মতে এটা একটা সুন্দর চক্র যেখানে সাফল্যকে কেবল সাফল্য দিয়েই পরিবর্তন করা যায়।

সাবেক ফুটবলার এবং ইয়োহান ক্রুইফের বন্ধু জাউমা লোপিস বলেন, ‘২০১০ সালে লা মাসিয়ার ৩ জন ফুটবলারই ফিফা ব্যালন ডি’অরের শীর্ষে ছিল। ফুটবল ইতিহাসে এমনটা আর ঘটবে না। তখন লা মাসিয়া ছিল এমন জায়গায় যেখানের কমপক্ষে ৭ জন ফুটবলার মূল একাদশে সুযোগ পেতো এবং যার ফলাফল দেখি লেভান্তের বিপক্ষে ২০১১ সালে।’

তাহলে কেন এমনটা আর ঘটবে না। বার্সেলোনা কী এমন ভুল করেছে এখানে? উত্তর হলো, বার্সেলোনা লা মাসিয়ার অর্থটা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। আসল তত্ত্ব এসেছিল ক্রুইফ, রিনাস মিশেল, লাইরেয়ানো রুইজ এবং জোসেফ লুইজ নুনেজের কাছ থেকে। তারপর লুইস ফন হাল এবং পরবর্তীতে পেপ গার্দিওলা লা মাসিয়ার রক্ষণাবেক্ষণ করেছিলেন।

‘তাদের কাছে স্পেনের সেরা খেলোয়াড়রা ছিল। তাছাড়া তাদের দলে মেসির মত খেলোয়াড় ছিল। এটা সাধারণ মানুষ খুব সহজেই বুঝতে পারবে যে খেলোয়াড় তৈরি হয় প্রথম দলে তাদের নিজেদের জায়গা পাওয়ার জন্য’- বলছিলেন লোপিস।

দৈনিক পত্রিকা ‘এল পাইস’ এর সাংবাদিক জর্দি কুইজানো বার্সার হোম এবং এওয়ে ম্যাচের রিপোর্ট করেন। তার মতে কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে বার্সার বিচ্যুতি ঘটে। তাছাড়া বার্সার নতুন স্টেডিয়াম বানাতেও প্রচুর অর্থ খরচ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বার্সেলোনা তাদের মডেল হারিয়ে ফেলেছে। কারণ যারা দায়িত্বে আছে তাদের পূর্ব উত্তরসূরিদের মত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই।’

তাহলে ক্লাব কীভাবে চলছে! কুইজানো দ্রুতই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলেন, ‘বার্সা কোনমতে লা মাসিয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং কিছু উন্নতি হচ্ছে। তারা ইঙ্গিত দিয়েছে আগের দর্শন ফিরিয়ে আনার কিন্তু আমার তাদের কথা নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে। দর্শন আনার বদলে তারা না জানি এটাকে আরও ডুবিয়ে ফেলে।’

‘অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই ইপিএলের ক্লাবগুলোর থেকে মোটা অংকের চুক্তিতে প্রস্তাব গ্রহণ করছে। যা তরুণ ফুটবলারদের বার্সা দিতে পারছে না। এই মন্দাই মূলত বার্সাকে আরও ভোগাচ্ছে’- কুইজানো যোগ করেন।

কাতালানদের বিশ্বের ভেতর সবচেয়ে বেশি বেতন দিতে হয় খেলোয়াড়দের। যেটা তাদের ২০১৮ সালের বিপর্যয়ের প্রায় ৭০%। যার কারণে তারা আগের মত খেলোয়াড় বানাতে পারছে না। মেসির বেতন অনেক বেশি হওয়ায় সেটা ক্লাবের উপর আলাদা চাপ দিচ্ছে।

মেসি অবশ্যই পৃথিবীর অন্যতম সেরা ফুটবলার এবং বার্সেলোনার ইতিহাসের সেরা ফুটবলার যে কি না বার্সার যুব দল থেকে উঠে এসেছে। কিন্তু মেসি এমনটাও বলেছেন যে, আগে তিনি যেভাবে দলকে টেনে নিয়ে যেতে পারতেন, এখন সেটা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ২০১৮ সালে মেসি বলেছিলেন, ‘আমরা একাডেমির সঙ্গে যে কথা দিয়েছি, সেখান থেকে সরে আসছি। গুরুত্বপূর্ণ তরুণ ফুটবলাররা চলে যাচ্ছে এবং এটা ক্লাবের জন্য অশনি সংকেত।’

jagonews24

লিওনেল মেসি, পিকে, ভালদেসরা যখন লা মাসিয়ায় ছিলেন

২০১৭ সালে লাস পালমাসের কোচ ছিলেন মানালো মারকুয়েজ। তিনি বলেন, ‘ক্লাবের দুর্দশার ভার কিছুটা সমর্থকদেরও নিতে হবে। বার্সেলোনা চেলসি নয়। অনেক সমর্থকরাই চেলসির আইডিয়াকে পছন্দ করে। তারা লিগে প্রথম হতে চায় শুধু, তরুণদের দিয়ে ৪র্থ হতে চায় না। আর্নেস্তো ভালভার্দে এটা জানত, এজন্যই তিনি তরুণদের সুযোগ কম দিতেন। সেতিয়েন আমার বন্ধু এবং ফুটবল সম্পর্কে তার বিস্তর জ্ঞান রয়েছে কিন্তু তাকে অবশ্যই লা লিগা কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করতে হবে।’

লকডাউনের আগে কিকে সেতিয়েনের শেষ ম্যাচ ছিল রিয়াল সোসিয়াদাদের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে বার্সা ১-০ গোলে ঘরের মাঠে জয়লাভ করে। ঐ ম্যাচে ৪ জন লা মাসিয়া গ্রাজুয়েট ছিলেন একাদশে। মেসি, পিকে, বুসকেটস এবং জর্দি আলবা- যাদের সবার বয়স ৩০ বছরের বেশি।

বার্সার বেঞ্চে কি সেরকম ট্যালেন্ট ছিল? যারা মূল দলে এদের বিকল্প হতে পারত? মোটেই না। বেঞ্চের সাত জনের ভেতর মাত্র ৩ জন ছিল লা মাসিয়া গ্রাজুয়েট; রিকি পুইগ, আনসু ফাতি ও এলেক্স কোলাদো। ফাতি চলতি মৌসুমে লা মাসিয়ার আসল গ্রাজুয়েটদের মত খেলে যাচ্ছে।

বার্সা বি দল স্পেনের তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে রয়েছে ২০১৮ সাল থেকে। যারা আগের সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছে। যদিও মার্কুয়েজ বিশ্বাস করেন তাদের নতুন কোচ সাবেক উইঙ্গার জাভি গার্সিয়া পিমেনতা ভালো কোচ। কিন্তু বর্তমান নীতির কারণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন।

মার্কুয়েজ বলেন, ‘সে এখানে দীর্ঘদিন ধরে আছে এবং অনেক সেরা খেলোয়াড়দের তৈরি করেছে। সে ২০১৮ সাল বার্সার উয়েফা ইয়ুথ লীগ জয়ী দলের কোচ ছিল। আমি তাকে একদিন বার্সার মূল দলের কোচ হিসেবে দেখতে চাই কিন্তু সে বর্তমানে তৃতীয় বিভাগের একটি দলের কোচ যেখানে সবার বয়স ২০ বা ২১। বেশিরভাগ তরুণ খেলোয়াড়কেই বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।’

স্পেনের আঞ্চলিক সেগুন্দা ডিভিশন বি তে ৮০টির মত দল অংশ নেয়। মূল দলের সঙ্গে এদের তফাৎ অনেক বেশি। বার্সার বি দল গত ১০ বছরের বেশিরভাগ সময় সেকেন্ড ডিভিশনে খেলেছে যা মূল দলের লিগ থেকে অনেক দূরের।

বার্সা বি দলের সাবেক অধিনায়ক আরনাও রিয়েরা বলেন, ‘আমি যখন দলটার সঙ্গে খেলতাম তখন দেখতাম তারা কতটা দ্রুতগতিসম্পন্ন দল। আমি একটা বার্সা বি দলের হয়ে খেলেছিলাম যেখান থেকে মেসি, ভালদেস, ইনিতিয়াস, ওলেগার, থিয়াগো মোত্তা এবং ফার্নান্দো নাভারোর মত খেলোয়াড়রা মূল দলে খেলেছে। সবার আশা হিল এটা ধারাবাহিকভাবে করার কিন্তু এটাও জানতাম যে খারাপগুলো আমাদের বিপরীতেই যাচ্ছে। এটা খুবই কষ্টকর যে কারোর জন্য। নিজেকে মূল দলে নিয়ে আসা যেখানে আপনাকে সপ্তাহে দুই দিন মানসিক অবসাদে ভুগতে হবে মানুষের সমালোচনা নিয়ে, যদি না আপনি সেরাটা দেন। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার নিজের বুদ্ধিমত্তাকে অনুধাবন না করাই ভালো। এতে ফুটবলের উপর নির্দিষ্ট করে নজর রাখা যায়।’

‘কিন্তু বার্সেলোনার দর্শন আগের মতই আছে। পাস এন্ড মুভ, বল দ্রুত রিকভার করা, দ্রুত অবস্থান নেয়া, দ্রুত পরিবর্তন করা। আমাদের কাছে যদি বল থাকে তাহলে আমরা দ্রুত গোলের কাছে চলে যাব, এমনটাই বলা হতো। অনুশীলনে খুব কমই ১১ বনাম ১১ খেলা হয়। সেখানে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে খেলা হয় যেটা দুই টাচের। আপনি আসলেই ভালো যদি আপনার বার্সার হয়ে খেলেন এবং আপনার মনের অজান্তেই তখন বলে উঠবে, আমি এই জার্সি পরেছি এবং আমরাই সেরা। কিন্তু আমি যখন ছিলাম তখনের থেকে এখন এই উন্নতির ধাপ স্থগিত হয়ে গেছে, খেলার ধরণেও এসেছে পরিবর্তন। বার্সা বি দল এখন প্রচুর শারীরিক ফুটবল খেলে তৃতীয় বিভাগে।’

কিন্তু এই পরিবর্তনটা কীভাবে এলো! ক্রুইফের বন্ধু লোপিসের মতে, মূলত সাবেক প্রেসিডেন্ট সান্দ্রো রোসেল এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট বার্তেমেউর উপর এটার দায় বর্তায়, ‘তারা লা মাসিয়ার দর্শনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে। তারা বার্সা বি দলের জন্য ৪৭ জন খেলোয়াড়কে চুক্তিবদ্ধ করিয়েছে কিন্তু তারা কেউই মূল দলের হয়ে খেলতে পারেনি। তারা মারাত্মকভাবে লা মাসিয়াকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।’

সান্দ্রো রোসেল অনেক অবৈধ কাজের সহযোগী ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বার্সেলোনা ফিফার নিয়ম ভঙ্গ করে ২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যে ১০ জন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়কে চুক্তি করিয়েছিল, যাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের কম। এজন্য বার্সাকে ১৪ মাসের ট্রান্সফার ব্যানও বহন করতে হয়। লোপিস বলেন, ‘তারাই আসল ধ্বংস করেছে। কোন নতুন খেলোয়াড়ই আসেনি বরং কিছু উদীয়মান তরুণ তুর্কি ক্লাব ছেড়ে চলে গেছে।’

এরকম এক তরুণ দক্ষিণ কোরিয়ার আক্রমণভাগের ফুটবলার হলেন লি সিউং-উ। যাকে বলে হয় ‘কোরিয়ান মেসি’। বেলজিয়ান প্রথম বিভাগের ক্লাব সিন্ট ত্রুইদেনের হয়ে ২০১৯-২০ মৌসুম খেলছেন বর্তমানে ২২ বছর বয়সী এই ফুটবলার। বার্সেলোনা মাত্র ১.৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে ২০১৭ সালে ইতালিয়ান ক্লাব ভেরোনার কাছে বিক্রি করে দেয় সঙ্গে ছিল না কোন বাই-ব্যাক ক্লজও।

এছাড়া কিছু খেলোয়াড় মূল দল থেকেও চলে গেছে । যাদের মধ্যে পেড্রো ৩০ মিলিয়ন ইউরো, থিয়াগো আলকান্তারা ২৫ মিলিয়ন ইউরো, জেরার্ড দেইলোফেউ ১৩ মিলিয়ন ইউরোতে ক্লাব ছাড়েন। তারা যেসব ক্লাবে গিয়েছেন পরবর্তীতে সেখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

প্রায় ১৫ বছর পার হতে চললো, বার্সেলোনায় মেসির মত কেউ আসেনি। এখন বড় প্রশ্ন বার্সার তরুণ ফুটবলাররা কি ২০২০ সালে সুযোগ পাবে মূল দলে! ডাচ কিংবদন্তি চার্লস গুয়ারদিয়া, যিনি ক্রুইয়েফিস্তাতে বিশ্বাসী তার মতে আসবে না সেই সময়। চার্লস গুয়ারদিয়ার মতে, ‘লা মাসিয়া এখন ব্যবসায়িক কেন্দ্র। যদি বৈশ্বিক মহামারীর কথা চিন্তা করেন তাহলে বুঝবেন লা মাসিয়া কতটা দরকারি। কারণ আপনি এখন খেলোয়াড় আগের মূল্যে চুক্তিবদ্ধ করাতে পারবেন না। কিন্তু এই বোর্ড এটাতে বিশ্বাসী নয়। বহু খেলোয়াড় বিক্রি করা হচ্ছে এবং তার খুব কম শতাংশই সংরক্ষিত রয়েছে।’

বার্সেলোনাই কেবল এমনটা করছে তা নয়, ম্যানচেস্টার সিটিও বার্সেলোনার পথে হাঁটছে। প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটি বহু তরুণ ফুটবলারকে দলে নিয়েছিল কিন্তু জর্দান সানচোর মত ফুটবলার যদি ক্লাব ছেড়ে দেয় তাহলে কীভাবে হবে? সিটি মানু গার্সিয়া, ডগলাস লুইজ এবং এরন মুইকে বিক্রি করে ভালোই টাকা আয় করেছে। তাদের মতবাদ অনুযায়ী ইয়ুথ সিস্টেমই লাভজনক।

বার্সেলোনার লা মাসিয়ানদের মূল দলে জায়গা না হওয়া ব্যাপারে লা লিগার একজন পরিচালক বলেন, এটা হচ্ছে আয়াক্সের মডেল। ‘এটা ব্যবসা এবং লা মাসিয়া নামটিই যথেষ্ট মার্কেটিংয়ের জন্য। এই নামটা বিশ্বের সকল তরুণ ফুটবলারদের জন্য এক উদ্দীপনাময় নাম, কিন্তু ক্লাবের এজেন্টরা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে দিতেই আগ্রহী।’

বার্সেলোনা থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট খেলোয়াড়দের বাইরের যেকোন বড় ক্লাব বেছে নিতে সাহায্য করছে। বার্সেলোনা হতবাক হয়ে যায় যখন সেস্ক ফ্যাব্রিগাস আর্সেনাল এবং জেরার্ড পিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তরুণ বয়সে বাছাই করে, যেটা এখনও চলমান রয়েছে অন্যানদের ভেতর।

লোপিস বলেন, ‘কিছু লোভী এজেন্ট রয়েছে যারাই এটাকে মূলত বেশি ক্ষতি করছে। তরুণ বয়সে খেলোয়াড়দের বাবা-মার কাছ থেকে চুক্তিতে খেলোয়াড়দের নিয়ে এবং কথা দিয়ে আনে যে তাকে দিয়ে অনেক টাকা লাভ হবে।’

বার্সেলোনা খেলোয়াড়দের ১৪ বছর বয়সে না কিনে তারা কিনছে ২৪ বছর বয়সে, এই কাজটা দিনের পর দিন করে যাচ্ছে। বার্সেলোনার সেরা প্রজন্মটি ছিল ক্লাস অফ ’৮৭। প্লানশেরিয়া, ভালিয়েন্তে, পিকে, ফ্যাব্রিগাস, ক্লাউসি, রিয়েরা, গিরিবেত, ভাযকুয়েজ, মেসি। ক্লাস অফ ’৯১ ও একদম খারাপ নয়। থিয়াগো আলকান্তারা, মোনতয়া, বারত্রা, রচিনা, পাচেচো, তেয়ো। তাদের অসাধারণ কিছু ফুটবলার ছিল কিন্তু এখন নেই বললেই চলে।

ফিফার বিধিনিষেধ বার্সাকে শেষ করে দিয়েছে; অন্যান্য ক্লাবগুলো বেশি টাকার প্রস্তাব দিচ্ছে। পাশাপাশি তাদের প্রথম দলে পেপ গার্দিওলার মত কোচ দরকার যিনি কিনা তরুণদের সুযোগ দেন। বার্সা লা মাসিয়ায় অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছে কিন্তু তারা তরুণদের জন্য বেশি টাকা খরচ করতে অনিচ্ছুক। তারা মনে করে এটাই সঠিক উপায়।’

বড় ক্লাবগুলো তাদের তরুণ খেলোয়াড়দের একে অন্যের সঙ্গে অদলবদল করে। জুভেন্টাস ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে পল পগবাকে চুক্তি করায় পাশাপাশি তারা ২০১৯ সালে ম্যাসন গ্রিনউডকেও চেয়েছিল; যার পরিবারকে এত টাকার প্রস্তাব দিয়েছে যে তাদের সবকিছুই রীতিমত পাল্টে যেত। স্যার এলেক্স ফার্গুসনের বিদায়ের পর ইউনাইটেডের ইয়ুথ সিস্টেমে ভাটা পড়েছিল। তারা চেলসি এবং ম্যান সিটির মত বিগ বাজেটের দলগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছিল না। কিন্তু এখন তারা গত ৫ বছরের থেকে পাঁচগুণ টাকা ব্যয় করছে তরুণদের গঠন করার পেছনে। রেড ডেভিলদের সঠিক হিসাবটা জানা নেই কিন্তু মোনাকো থেকে মাত্র ১ মিলিয়ন পাউন্ডে হানিবল মেবরিকে ২০১৯ সালে তারা চুক্তি করায়, যার ২০১৯ সালে বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯.৩ মিলিয়ন পাউন্ড।

প্রেসিডেন্ট বার্তেমেউ কিংবা প্রেসিডেন্ট পেপ সেগুরার অধীনে বার্সেলোনা হানিবলের মত কম টাকায় কোন খেলোয়াড়কেই চুক্তিবদ্ধ করায়নি। সম্প্রতি তারা উল্টো তাদের স্প্যানিশ তরুণ আন্তর্জাতিক ফুটবলারদের হারিয়েছে। যেমন আদ্রিয়ান বার্নাবে (১৮) ম্যানচেস্টার সিটি, সার্জিও গোমেস (১৯) বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, পাবলো মোরেনো (১৭) জুভেন্টাস, জর্দি এমবোউলা (২১) মোনাকো, আবেল রুইজ (২০) ব্রাগা, কার্লেস পেরেজ (২২) রোমা, এবং রবার্তো নাভারো (১৭) বর্তমানে সোসিয়াদাদে খেলছেন।

সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিদায় ছিল ২০১৭ সালে স্প্যানিশ রক্ষণভাগের খেলোয়াড় এরিক গার্সিয়ার ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগদান। আরও পীড়াদায়ক হচ্ছে এই গার্সিয়ার এজেন্ট হচ্ছেন বার্সেলোনার কিংবদন্তি ফুটবলার কার্লস পুয়োল। এখানের প্রায় সবাই কাতালান ফুটবলার। তারা ১৬ বছর বয়সে বার্সাতে ১৫ হাজার ইউরোর প্রস্তাব পেতো কিন্তু সেখানে ম্যান সিটির মত ক্লাব ২ লাখ ৫০ হাজার ইউরো প্রস্তাব দিতে পারে। বার্সেলোনা হয়তো স্বচ্ছল একটি ক্লাব হতে পারে কিন্তু তাদের দেশের অন্যান্য সার্বভৌম সম্পদশালীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারার মত সক্ষমতা নেই।

কুইজানো বলেন, ‘কিছু খেলোয়াড় এখনও আসছে কিন্তু সংখ্যায় একদমই নগণ্য। আনসু ফাতি বর্তমান সময়ের অন্যতম একজন যিনি এই মৌসুমে ভালো খেলছেন। কার্লস পেরেজ তেমন সুযোগই পাননি যেমনটা পাননি লোনে রিয়াল বেটিসে যোগ দেয়া কার্লেস এলেনা। আর্নেস্তো ভালভার্দে তাদের থেকে অভিজ্ঞদের সুযোগ দিতেন বেশি।’

এসব ঘটনা কোনভাবেই সমর্থন দেয় না যে বার্সেলোনার সিদ্ধান্তগুলো ভালো ছিল। লেফট ব্যাক মার্ক চুচুরেলা এই মৌসুমে ক্যাম্প ন্যুতে গেতাফের হয়ে অসাধারণ খেলেছিলেন। অথচ বার্সা তাকে ২০১৯ সালে মাত্র ৬ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করে দেয় এবং ডমিনিকান লেফট ব্যাক জুনিয়র ফিরপোকে বেটিস থেকে ১৮ মিলিয়ন দিয়ে চুক্তি করায়। এটা কি আসলেই সমর্থন যোগ্য? ফিরপো এই মৌসুমের অনিয়মিত একজন খেলোয়াড়। কিন্তু এটার থেকে বার্সেলোনার আরেকটি খেলোয়াড় বিক্রির সিদ্ধান্ত প্রকাশ করবে তারা কতটা অসচ্চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে।

ফরোয়ার্ড রুইজ জানুয়ারি মাসে লোনে যোগ দেন ব্রাগাতে। ব্রাগা চাইলে তাকে ৮ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কিনে নিতে পারবে যেখানে বার্সার বাই ব্যাক ক্লজ হচ্ছে ৪০ মিলিয়ন ইউরো, সেটাও দুই বছরের ভেতর। উইঙ্গার পেরেজ ২০১৯-২০ মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে ৭টি লিগ ম্যাচে খেলেছিলেন এবং বেটিসের বিপক্ষে ৫-২ গোলের জয়ে ম্যাচে গোলও ছিল তার; তাকে লোনে দেওয়া হয়েছে রোমার কাছে এবং রোমা চাইলে মাত্র ১১ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে নিজেদের করে নিতে পারবে।

ইউরোপা লিগের ম্যাচে গেন্টের বিপক্ষে পেরেজ গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আমি জানিনা আসলে বার্সাতে কী হয়েছিল। তারা আমাকে যৌক্তিক কোন কারণ ব্যাখ্যা করেনি এবং ট্রান্সফার উইনডো বন্ধ হওয়ার মাত্র ১০ দিন আগে তারা জানায় আমি ক্লাব ছাড়ছি। তাদের তরুণদের প্রতি ভরসা নেই। এটা আমাকে বেশ আহত করেছে। আমার স্বপ্ন ছিল বার্সাতে ক্যারিয়ার শেষ করার কিন্তু সেটাতে বিচ্যুতি এলো। তারা লা মাসিয়া নিয়ে অনেক কথা বলে কিন্তু কাজে ঘটায় তার বিপরীত।’

বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউন শুরু হওয়ার পর বার্সেলোনা ঘোষণা দিয়েছিল সাময়িকভাবে বেতন থেকে কিছু টাকা কেটে নেয়া হবে। কিন্তু আসল থাবাটা গিয়ে পড়বে লা মাসিয়ার ওপর যেখানে তারা টাকা যোগাতে তরুণদের বিক্রি করে দিতে কার্পণ্য করবে না।

তাদের তরুণ দলের কোচ বর্তমান সময়ে ভালো টাকা আয় করছেন। বাৎসরিক ৪৫ হাজার ইউরো উপার্জন করছেন তিনি এবং কাজ করছেন ১২-১৯ বছর বয়সী ফুটবলারদের নিয়ে। কিন্ত তাদের স্কাউটসরা সারা স্পেনে প্রতি সপ্তাহে খেলোয়াড় নজর দেওয়ার মাধ্যমে মাত্র ৮ হাজার ইউরো পেয়ে থাকেন বছরে। অতীতের বার্সার তরুণ দলের কোচের তাদের বৈশিষ্ট্যের ছাপ রেখে যাচ্ছেন উপসাগরীয় দেশ, চীন এবং জাপানে বিভিন্ন জায়গার কোচ হয়ে বার্সেলোনার মডেলকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে।

এটাও বার্সেলোনার ফুটবলের আরেকটা ব্যবসা। অনেক নামীদামী ক্লাব ৫০টা একাডেমি চালিয়ে তরুণ খেলোয়াড়দের বাৎসরিক ৩ হাজার ইউরোর বিনিময়ে অনুশীলন করিয়ে থাকেন বার্সেলোনার মডেল অনুসরণ করে।

বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন হবে ২০২১ সালে। এ সময়টার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করেছেন। লোপিস বলেন, ‘নতুন প্রেসিডেন্টের অবশ্যই প্রথম কাজ হবে লা মাসিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করা। করোনাভাইরাস এবং অর্থনৈতিক মন্দার ভেতরে বার্সেলোনাকে ভবিষ্যত পরিকল্পনা সাজাতে হবে তরুণদের গড়ার মাধ্যমেই। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। একবছর আগে বার্সার মেথডোলজির পরিচালক হিসেবে ছিলেন হোয়ান ভিলা, যিনি অনেক খেলোয়াড়কে বার্সেলোনায় নিয়ে এসেছেন গত ৪ বছরে। ভিলা ২০১৮ সালে চুক্তি শেষ করার পর বার্সা ছেড়ে দেন। এখনই সময় লা মাসিয়াকে ঢেলে সাজানো।’

কাতালানদের নতুন শুরু এখনই হওয়া উচিত। স্পেনের সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর বার্সেলোনার ইয়ুথ একাডেমিকে আবারও নতুন আঙ্গিকে সাজানো উচিত। পুরাতন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা উচিত। একবার ক্রুইফ বলেছিলেন, ‘নিজস্ব স্টাইল অর্জন করার মত বড় অর্জন অন্য কোন কিছুতে নেই’।

আরআর/এসএএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।