মিশেল প্লাতিনি: এক জীবন্ত কিংবদন্তির উত্থান-পতন
মিশেল প্লাতিনি কখনো ভাবেননি তিনি জীবন্ত ভূত হয়ে থাকবেন। যখন ২০২২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ কাতারকে বাছাই করার জন্য ২ মিলিয়ন ডলারের যে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছিল তখনও নির্বিকার ছিলেন প্লাতিনি।
তিনি যখন চলে যান তখন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমি মিশেল প্লাতিনি- সবাই আমাকে চেনে। মানুষ আমার দিকে এখন ভিন্নভাবে তাকাচ্ছে।’ এই অপমান যে কারোর পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে, বিশেষ করে যে সচরাচর এমন দুর্দশা বা খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় না।
এটা দ্বিগুণ কঠিন এমন একজনের জন্য যার কি না খেলোয়াড় হিসেবে সবকিছুই ছিল এমনকি সে যদি কিছু নাও জিতে থাকে। প্লাতিনির ব্যাপারে পেলে একবার বলেছিলেন, ‘সেই একমাত্র ফ্রেঞ্চ ফুটবলার যে কি না যেকোন সময়ের ব্রাজিলিয়ান দলে নির্দ্বিধায় সুযোগ পেতে পারে।’
প্লাতিনির বাবা আলদো ছিলেন একজন অপেশাদার ফুটবলার। তিনি ফ্রেঞ্চ ক্লাব ন্যান্সির দীর্ঘদিনের পরিচালক ছিলেন। প্লাতিনিকে ফুটবলের প্রতি ঝোঁকটা বাড়িয়েছেন বাবা আলদোই। একবার যুবক বয়সে প্লাতিনি আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর খেলা দেখতে গিয়ে তার এক নজরকাড়া পাস দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সে কীভাবে জানল যে ঐ খেলোয়াড়টা ওখানেই থাকবে?’ আলদো তখন কিছু বললো না। প্লাতিনি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘আহা! মনে হয় সে আগে থেকেই দেখেছিল।’
১৭ বছর বয়সী প্লাতিনির পেশাদার ফুটবলে আসার স্বপ্নটা প্রায় ফিকে হয়ে যেতে বসেছিল। মেটজের হয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের পরীক্ষার দেওয়ার সময় অজ্ঞান হয়ে যান প্লাতিনি। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার হার্টের দুর্বলতা ধরা পড়ে।
কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার ন্যান্সিতে ফিরে আসেন, যেখানে তার বাবা কাজ করত। বাবাই তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেন। প্লাতিনির পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ৩ মে, ১৯৭৩ সালে নিমসের বিপক্ষে। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ১৭ গোল করে ক্লাবকে লিগ ওয়ানে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সবাই যেখানে ফুটবলের প্রতি উদ্যম নিয়ে ঝুঁকে সেখানে প্লাতিনির কাছে ফুটবলকে ডালভাত মনে হতে লাগল।
ষাটের দশকে প্লাতিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন স্কুল থেকে দ্রুত ফিরে দুপুরের খাবার সেরে ৩০ মিনিট অতিরিক্ত সময় অনুশীলন করতেন। ন্যান্সিতে থাকাকালীন ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি ফ্রি কিকের অনুশীলন করতেন তার গোলরক্ষক বন্ধু জ্যান মিশেল মৌতিয়েরের সাথে।
ফুটবলে টাইমিংটা অনেক বড় কিছু। সত্তরের দশকের প্লাতিনি ফ্রেঞ্চ ফুটবলের উত্থান দেখতে শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে ফ্রেঞ্চ ক্লাব সেন্ট এতিয়েনে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে খেলে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। দুই বছর পর বাস্তিয়া পুরো ইউরোপকে তাক লাগিয়ে দেয় এবং তাদের নিজেদেরকেও। ১৯৭৮ সালের ইউরোপা কাপের ফাইনালে তারা খেলে পিএসভির বিপক্ষে। যদিও তারা ৪-৩ গোলের ব্যবধানে হেরে যায়। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয় ফ্রান্স যা ছিল ১৯৬৬ সালের পর প্রথম।
১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব থেকে বিদায়ের পর প্লাতিনির নিন্দা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ করে এওয়ে সমর্থকদের মধ্যে। এওয়ে সমর্থকদের দুয়োধ্বনি প্লাতিনির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াল। এক ম্যাচে তিনি খুব খারাপভাবে গোড়ালির ইনজুরিতে পড়েন। ন্যান্সিতে অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার পর ঐ মৌসুমেই ক্লাব ছাড়েন প্লাতিনি।
পরের মৌসুমেই সেইন্ট এতিয়েন ক্লাবের হয়ে লিগ শিরোপা জয় করেন। ফ্রেঞ্চ ফুটবলকে ইউরোপের উচ্চ শিখরে নেয়ার কাজটা তখনই শুরু করেন প্লাতিনি। তার এই সাফল্য নজর কাড়ে ইউরোপিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাসের। ১৯৮২ সালে প্লাতিনির বয়স যখন ২৭ বছর তখন তাকে নিজেদের দলে টানতে চুক্তির প্রস্তাব দেয় জুভেন্টাস। প্লাতিনিও তাদের ফিরিয়ে দেননি। ২৭ বছর বয়স একজন ফুটবলারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়।
জুভেন্টাসে যোগ দেওয়ার আগে স্পেনে হওয়া ১৯৮২ বিশ্বকাপটি আসে। প্রথম ম্যাচে মাঝারি মানের ইংল্যান্ড দলের কাছে হেরে বসে ফ্রান্স, ৩-১ গোলের ব্যবধানে। যদিও পরের দুই ম্যাচে তারা ভালো খেলে পরের রাউন্ডে ওঠে। সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও ম্যাচটিতে তারা শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে হেরে বসে।
তাদের এই হারার পেছনে অন্যতম অবদান ছিল ম্যাচের ডাচ রেফারি চার্লস কর্ভারের। সেই ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির গোলরক্ষক হারাল্ড শুমাখারকে লাল কার্ড দেখাননি রেফারি। ফ্রান্সের ডিফেন্ডার প্যাট্রিক ব্যাটিসটনের দাঁত ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি পাঁজরের হাড়ও ভেঙে ফেলে পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়রা। কমপক্ষে আধঘন্টা প্রায় অচেতন হয়ে ছিল সে, তবুও রেফারি বিপক্ষে দলের খেলোয়াড়কে কোন কার্ড দেখায়নি। প্লাতিনি এবং এলাইন গিরেসেকেও অনেকবার ফাউল করা হয় সেই ম্যাচে।
১৭ বছর পর প্লাতিনিকে সেই ম্যাচের কথা জিজ্ঞেস করতেই প্লাতিনি বলেন, ‘আমি কী করতে পারতাম? যখন আমি ইউরোপে গোল করতাম তখন আমি রাজা, যখন আমি হারতাম তখন আমি শয়তান। কোনটা সত্যি আসলে?’
সেভিয়াতে হওয়া পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে সেই ম্যাচ নিয়ে প্লাতিনি বলেন, ‘আমরা ফ্রান্স ফুটবলকে তখন এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছিলাম যেখান থেকে বলতে পারে সবাই, হ্যাঁ! তুমি আসলেই অন্যতম সেরা। আমরা ম্যাচ শুরুর আগে বুঝিনি। যখন আমরা সেমিফাইনাল হারলাম তখন বুঝলাম যে আমরা ভালো একটি ফুটবল দল হয়ে উঠেছি এবং আমরা নিজেদেরকে নিজেরা বুঝালাম যে আমরা এখন দুই বছর পর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য প্রস্তুত।’
ফ্রান্সে হওয়া ১৯৮৪ সালের ইউরো কাপে প্লাতিনি পাঁচ ম্যাচে করেছিলেন ৯ গোল। দুটি হেড, দুটি ফ্রি কিক, একটি পেনাল্টি এবং চারটি গোল করেছিলেন ওপেন প্লেতে। প্লাতিনি ১৯৮৪ সালে ইয়োহান ক্রুইফের ১৯৭৪ কিংবা ডিয়েগো ম্যারাডোনার ১৯৮৬ সালের মতই অসাধারণ ছিলেন। শুধু গোলই নয়, তার বুদ্ধিমত্তা, তার উদ্যম, তার একাগ্রতা, দলকে এক সূত্রে গাঁথার মত দক্ষতাও সেবার দেখা গিয়েছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেটের মত। ইতালিয়ান কিংবদন্তি প্লে-মেকার জিয়ান্নি রিভেরা বলেছিলেন, ‘প্লাতিনি তার শরীরী ভাষা দিয়ে সব বুদ্ধিমত্তা এবং ১০ নাম্বার জার্সি গায়ে দেওয়ার উপযুক্ততা প্রকাশ করত।’
১৯৭৬ সাল থেকে ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ ছিলেন মিশেল হিদালগো। আক্রমণাত্মক ফুটবলের পূজারি হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন। ইউরো কাপের আগে তিনি চারজন ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডারকে দলে নিলেন। লুইস ফার্নান্দেজ, ইয়ান তিয়ানা, গিরেসে এবং প্লাতিনি।
হিদালগো প্লাতিনিকেন্দ্রিক দল না বানিয়ে এটাকিং মিডফিল্ডারদের দিয়ে সব আক্রমণ পরিচালনাকেই যোগ্য মনে করলেন। যেখানে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবেও থাকবে একজন এটাকিং মিডফিল্ডার প্লাতিনি। ফ্রান্সের ইউরো কাপের সেই স্কোয়াডে একমাত্র প্লাতিনিই ছিলেন ভিন্ন দেশের ক্লাবে খেলা ফুটবলার। বাকি সবাই ফ্রান্সেরই বিভিন্ন ক্লাবে খেলতেন তখন।
১৯৮২ বিশ্বকাপ প্লাতিনি কুঁচকির ইনজুরি নিয়ে খেলেছেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ খেলেছেন স্নায়ুবিক ইনজুরি নিয়ে। তার মাধ্যমেই ফ্রান্স পায় ১৯৮৪ সালে ইউরোপিয়ান জয়ের স্বাদ। প্রথমবারের মত কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিতিয়ে তিনিও জয়লাভ করেন টানা দ্বিতীয়বারের মত ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার।
১৯৮৭ সালে ঔপন্যাসিক মারগুয়রিতে দুরাস মজা করে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘প্লাতিনির পুরো ক্যারিয়ারকে এক ম্যাচের বলা যায়। যদি সেটা সঠিক সময়ে, সঠিক টেলিভেশনের সামনে, সঠিক ম্যাচ হয়।’
ইউরো ১৯৮৪ কাপে দুইটি হ্যাটট্রিক ছিল প্লাতিনির। প্রথমটি আসে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ৫-০ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে এবং অন্যটি আসে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে। তখনও তাকে ফুটবলের ‘রাজা’ বলা হয়নি।
জুভেন্টাসে তার ক্যারিয়ার ইনজুরিতেই বেশি ছিল। তবুও টানা তিন মৌসুম জুভেন্টাস তথা ইতালিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন প্লাতিনি এবং কোনবারই তিনি স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেননি, ছিলেন মিডফিল্ডার। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে ১৬ গোল, ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে ২০ গোল, ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে ১৮ গোল করেন তিনি।
ফুটবলের নক্ষত্রদের দিয়ে ভরা জুভেন্টাস দলে প্লাতিনির সতীর্থ ছিলেন রবার্তো বেত্তেগা, বিগ্নিউ বোনিয়েক, পাওলো রসি, গায়েতানো শিরেয়া, মার্কো তারদেল্লি এবং দিনো জফ। তবু প্লাতিনি জুভেন্টাসে নিজের সেরাটা খেলেও ক্লাবটির বদমেজাজী মালিক জিয়ানি আগ্নেল্লির মন জয় করতে পারেননি। একবার ড্রেসিং রুমের ভেতরে প্লাতিনিকে ধূমপান করা অবস্থায় ধরে ফেলেন কোচ হাঞ্চো। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান।
প্লাতিনির ফুটবলশৈলি পুরোপুরি ধরা দিয়েছিল কোপা ইতালিয়ার গ্রুপ পর্বে পেসকারার বিপক্ষে ম্যাচে। ১৯৮২ সালের আগস্টের ২২ তারিখে হয়েছিল সেই ম্যাচটি। ২৭ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার পেসকারার মিডফিল্ড অর্ধ থেকে বল নিয়ে চারজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে সেখানে বলে ২-৩টি টাচ করে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়ান।
তার ক্যারিয়ারের আরেকটি মুকুট যোগ হয় জুভেন্টাসের হয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের মাধ্যমে। ১৯৮৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলের বিপক্ষে একটি গোলও করেছিলেন প্লাতিনি। কিন্তু তার এই গৌরবের প্রচারণা ভেস্তে যায় হেইসেল ট্রাজেডিতে ৩৯ জন মানুষের মৃত্যুতে। প্লাতিনি পেনাল্টি থেকে একটি গোল করেছিলেন। এটা সত্যি কথা যে, এখনকার সময়ের কতজন মানুষ জানে এমন কিংবদন্তি ফুটবলারের ব্যাপারে। যদিও প্লাতিনিই নিজেকে খুব কম প্রচার করতে পছন্দ করতেন।
প্লাতিনি একজন অসাধারণ ফুটবল শিল্পী এবং ভয়ঙ্কর দুর্ভাগা। ন্যান্সিতে থাকাকালীন একবার সতীর্থের সঙ্গে কার্ড খেলার মাঝেই খেলা বন্ধ করে সবকিছু বাইরে ফেলে দেন। তার আচরণ বেশ পছন্দ হয়েছিল জুভেন্টাস মিডফিল্ডার মাউরো কামোরানেসির। তিনি বলেন, ‘সে একটা দৈত্য। সে খুব চতুর, মাঠে সত্যিকারের দৈত্য। এমনকি তার খারাপ সময়েও সে নিজেকে ছাড়িয়ে যেত এটাই তার সহজাত বৈশিষ্ট্য।’
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালের স্টেডিয়ামে হওয়া দুর্ঘটনা যেটা ‘হেইসেল ট্রাজিডি’ নামে পরিচিত সেটি প্রতিনিয়ত প্লাতিনিকে তাড়া করে বেড়াতো। ১৯৮৭ সালে গোড়ালির ইনজুরি তাকে বেশ ভোগাচ্ছিল। মাত্র ৩২ বছর বয়সেই ফুটবলকে বিদায় জানান প্লাতিনি। তার মহত্ব ছিল অবিসংবাদিত। যুবক বয়সের জিনেদিন জিদান সবসময় চাইতেন প্লাতিনির মত ফুটবলার হতে। তার এমন হঠাৎ বিদায় ফুটবল অঙ্গনের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।
প্রথমদিকে প্লাতিনি বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলেন। ভিন্ন পরিচয়ে প্লাতিনি ফ্রেঞ্চ ফুটবলে আসেন। এবার কোচ হয়ে দলকে গোছান। তার চপলতায় ফ্রান্স খুঁজে পায় এরিক কান্টোনার মত ফুটবলারকে। ১৯৯৮ সালের বিশ্বজয়ী ফ্রান্স ফুটবল দলকেও গোছাতে সাহায্য করেন। পরবর্তী তিনি ফিফার কার্যনির্বাহী কমিটিতে যোগ দেন ২০০২ সালে।
প্লাতিনি তার বন্ধু সেপ ব্লাটারকে বলেছিলেন যে, তার ইচ্ছা উয়েফার সভাপতি হওয়া। যদিও ব্লাটার সেটাকে কতটা গায়ে নিয়েছিল সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। কিন্তু ২০০৭ সালে এই সুইস ফুটবল রাজনৈতিক উয়েফার প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনের সময় ছক কষতে থাকেন কীভাবে তৎকালীন উয়েফা প্রেসিডেন্ট লেনার্ট জোহানসনকে সিংহাসনচ্যুত করা যায়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত উয়েফার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জোহানসন।
১৯৯৮ সালে জোহানসন ব্লাটারের বিপক্ষে ফিফা সভাপতি হওয়ার জন্য লড়াইয়ে নামেন। কিন্তু ব্লাটারের কাছে তিনি ১১১-৮০ ভোটে হেরে যান। যদিও সেই ভোটে কারচুপির খবর ছড়িয়ে ছিল ব্যাপকভাবেই। অনেকে এও বলেছেন যে ব্লাটার ৫০ হাজার ডলার দিয়ে ভোট কিনেছেন।
২০০৭ উয়েফা নির্বাচনের সময় জোহানসন ঘোষণা দেন তিনি আবারও নির্বাচনে লড়বেন। জোহানসনের বয়স তখন ৮০ ছুঁইছুঁই। জোহানসন এবং প্লাতিনি দুজনকে নিয়েই উয়েফার লোকদের ভেতর একটা ভীতি কাজ করতো। এখানে ব্লাটার মুখে মুখে জোহানসনকে সমর্থন দেন, অন্যদিকে প্লাতিনিকে নির্বাচনে দাঁড় করান।
উয়েফার হেড অফিস নিয়নে এটা নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছিল যে যদি প্লাতিনি উয়েফার প্রেসিডেন্ট পদে আসেন তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে, সে উয়েফাকে ধ্বংস করে দিবে। একবার ফ্রেঞ্চ বেকেনবাওয়ার তো ‘স্টপ প্লাতিনি’ লেখা প্লাকার্ডও ঝুলিয়েছিলেন। কিন্তু সবকিছুর মূলে ছিল ব্লাটারের অঙ্গীকার। শেষপর্যন্ত জোহানসন প্লাতিনির কাছে ২৭-২৩ ভোটে হেরে যান।
ঠিক কোন জায়গা থেকে প্লাতিনি ক্ষমতার বলে দুর্নীতিপরায়ন হতে থাকেন সেটা বলা মুশকিল। ঔপন্যাসিক জন আপদাইক একবার বলেছিলেন, ‘Celebrity is a mask that eats into the face.’ ১৯৮৭ সালে প্লাতিনি একবার ‘লে স্পোর্ট’ ম্যাগাজিনকে বলেছিল, ‘আমি খুব কম ভুল করি। আমি কাজ করি সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে।’
লন্ডনের সোহো হোটেলে ২০০৭ সালে প্লাতিনি খুব সুন্দরভাবে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলেছিলেন যে, তাকে আর্সেনাল এবং টটেনহ্যাম হটস্পার্সও দলে ভেড়াতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি মনে করেছিলেন যে এখানে ম্যাচ বেশি খেলা হয় তাই এখানে না আসাটাই ভালো। কিন্তু প্লাতিনির এমন উক্তির পরেও তার বন্দনা থেমে থাকেনি ইংলিশ গণমাধ্যমে। তাকে ফুটবলে নতুন নেপোলিয়ন পর্যন্ত বলা হয়েছিল।
প্লাতিনির কিছু চিন্তা আসলেই ভালো ছিল। সে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিতে চাচ্ছিল যে, আরও বেশি নিজ দেশের খেলোয়াড়দের ক্লাবের শুরুর একাদশে সুযোগ দেয়া। সে উয়েফাকে সমানভাবেই লুট করতে চেয়েছিল বিশেষ করে তাদের জন্য যারা তাকে অপদার্থ ভেবেছিল।
প্লাতিনি ভাবতেন ভিডিও এসিস্ট্যান্ট রেফারি রাখাটা খেলার গতিপ্রবাহকে বিঘ্ন ঘটাবে। খেলার ভেতর যে চিন্তা-মগ্নতা থাকে সেটাকে মেরে ফেলবে। যদিও প্লাতিনি টাচলাইন রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেটি অতটা প্রভাব ফেলতে পারেনি ম্যাচে। প্লাতিনির ফিনান্সিয়াল ফেয়ার প্লে'র নিয়ম অনেকের ভালো লাগতেও পারে নাও পারে, এমনকি তার সমালোচক ডেইলি মেইলের লেখক মার্টি সামুয়েলও চাচ্ছিলেন প্লাতিনি খেলার অর্থনীতির দিকটাকে শ্রেণি বিভাজনের ভেতর নিয়ে আসুক।
প্লাতিনি এমন মানুষ ছিলেন না যিনি সবকিছু গড়গড় করে বলে দিবেন। উয়েফার আমলাতান্ত্রিকতায় তিনি ফুরিনোকে সঙ্গে নিয়ে কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। কিন্তু এফএফপিকে নিয়ে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। একজন সহায়তাকারী বলেছিলেন, ‘মানুষ ভাবে তার মাথাতে যাই সে তাই করতে পছন্দ করে যেমনটা ব্লাটার করতে ভালোবাসে। কিন্তু একটা এফএফপিতে শত শত কাগজ তাকে দেখতে হয় সেটাকে বিবেচনা করতে সমসাময়িক কার্যের ভিত্তিতে।’
হয়তো সে অনিশ্চিত একজন মানুষ। একজন উয়েফা সহায়তাকারী রাগে নিজের পদ ছেড়ে পদত্যাগ করেছিল। তার মতে, ‘আপনি যদি একই জিনিস তার সামনে বিভিন্ন দিনে উপস্থাপন করে যদি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া পান তাহলে সেখানে কাজ করা মুশকিল।’
প্লাতিনি অনেক বেশি সংবেদনশীল একজন মানুষ। যখন আর্সেন ওয়েঙ্গার ভিএআর এর পক্ষে সাফাই গাইলেন তখন প্লাতিনি তাকে বললেন যে সে ‘ব্যবসায়িক মনোভাব’ নিয়ে এখানে এসেছে এবং যখন ছোট ক্লাব বড় ক্লাবকে হারাবে এটার সহায়তা নিয়ে তখন পছন্দ করবে না সে।
প্লাতিনির পরিবর্তে জিয়ান্নি ইনফান্তিনো উয়েফার প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য দাবিদার ছিলেন কিন্তু প্লাতিনি পুরো উয়েফাতে রাজত্ব করছিলেন। কাতারে হওয়া বিশ্বকাপে তার সমর্থনের ব্যাপারে ডালপালা বাড়ছিল।
এরই মাঝে তিনি ২০১১ সালে উয়েফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন দ্বিতীয় মেয়াদে। মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ ঘোষণা হওয়ার ৯ দিন আগে ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সার্কোজির বাসভবন এলিসি প্রাসাদে প্লাতিনি এবং কাতারের ক্রাউন প্রিন্স শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে নিয়ে এক ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চলে।
প্লাতিনিকে সার্কোজি আদেশ করেন কাতারকে সমর্থন দিতে, এতে করে ফ্রান্সের ব্যবসা অনেক ভাল চলবে। নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ব্লাটারকে অনুনয় করে ফিনানশিয়াল টাইমস পত্রিকায় বলেন, ‘আমি আর তোমার সাথে থাকছি না। কারণ প্রেসিডেন্ট আমাকে আদেশ করেছে, আমাকে অবশ্যই ফ্রান্সের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কাতারকে সমর্থন দিতে হবে।’
ব্লাটার এটা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন, তারই আশ্রিত ব্যক্তি তার সঙ্গে বেইমানি করছে। কারণ ২০২২ বিশ্বকাপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও বিড করেছিল। প্লাতিনি তাকে বললেন, সে তার চিন্তা পাল্টিয়েছে এবং বিশ্বকে নতুন একটি জায়গায় বিশ্বকাপ আয়োজন করার অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতে চায়। আপনি তাকে বিশ্বাস করেন বা না করেন বিশ্বকাপ আয়োজনের সেই ভোট অনুষ্ঠানই প্লাতিনির জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
বেশিরভাগ ফুটবল পরিচালক অন্যমনস্ক হয়ে যেসব নিয়ম তৈরি করে সেগুলো তাদের দ্বারাই আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকে। এফবিআইর কাতারের জয়ী হওয়া নিয়ে তদন্ত করাটাই এটার মূল অনুঘটক। পরবর্তী ৫ বছরের ভেতর ব্লাটার তার পদ থেকে সরে আসেন এবং ইনফান্তিনো দায়িত্ব নেন।
তদন্তকারী দলের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহার না করার জন্য বেকেনবাওয়ারকে বহিষ্কার করা হয় এবং প্লাতিনি তার নিজের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ব্লাটারের অধীনে ২ মিলিয়ন ডলারের ব্যাকডেটেড বেতন নিয়েছেন। অথচ সেই বছরেই প্লাতিনির ফিফার প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার কথা ছিল কিন্তু তিনি পারেননি।
প্লাতিনি এবং ব্লাটার দুজনকেই নিষিদ্ধ করা হয় ফুটবল থেকে। কোর্ট অফ আর্বিট্রেশন ফর স্পোর্টস তাদের সাজার মেয়াদ কিছুটা কমান কিন্তু বিচারক তাদের ভূমিকার ভৎসনা করতেও পিছপা হননি। এখনও প্লাতিনি বিশ্বাস করেন তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, ব্লাটারের জায়গায় বসার আগে।
২০১৫ সালে প্লাতিনিকে ফ্রেঞ্চ পুলিশ কাতার বিশ্বকাপের বিডিং নিয়ে অনেক প্রশ্ন করে। তা নিয়ে আবার ব্রিটিশ ম্যাগাজিনগুলো নানান রমরমা খবর ছাপিয়েছিল। প্লাতিনি নিউইয়র্ক টাইমসে শেষবারের মত বলেছিলেন, ‘যখন আপনি সকালে ঘুম থেকে ওঠেন এবং আপনি জানেন না আপনার কাজ আপনাকে আগামী ৫০ বছর কোথায় আপনাকে নিয়ে যাবে, এর কারণ হল আপনার কোন নির্দিষ্ট স্থান নেই। কারণ আপনি ফুটবল থেকে বহিষ্কৃত, আপনি উয়েফা থেকে নির্বাসিত, আপনার কোন কাজ নেই এখানে তাহলে আমি কী করব?’
প্লাতিনি এবং তার আইনজীবী দুজনেই আশা প্রকাশ করেছেন একদিন প্লাতিনি আবারও ফুটবলে ফিরবেন। সেই ফুটবলের প্রথম আমলা নয় যে বিশ্বকাপের কোন স্বাগতিক দেশকে সমর্থন দিয়েছে। তার আগেও এমন বহুজন করেছে। নিজের চোখে সে কখনও অন্যের মত না। হয়তো সে একটা জায়গায় এটাকে রেখে গেছে কিন্তু বিশ্ব এখন ফুটবলের প্রশাসনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখবে।
ফুটবলের যেকোন জেনারেশনদের মধ্যে অন্যতম সেরা ফুটবলার মিশেল প্লাতিনির যেকোন ফুটবল ম্যাচ দেখতে বসলেই তার মাথায় চলে আসবে তার এই নির্বাসিত জীবনের কথা। এক জলজ্যান্ত ভুতুড়ে জীবনের কথা।
আরআর/এসএএস/জেআইএম