বন্দুকধারী দর্শক, পা ভেঙে বিয়ে বিলম্ব, অতঃপর নৌকায় প্রেম জোসীর

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৪:২২ পিএম, ১৮ এপ্রিল ২০২০

৯০ মিনিটের ম্যাচটা বেশি লম্বা মনে হচ্ছিল কাজী জসিম উদ্দিন আহমেদ জোসীর। বিকেলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ওয়ারী ক্লাবের বিরুদ্ধে ম্যাচটি শেষ করে সন্ধ্যার পর যে পাত্রী দেখতে যাবেন মোহামেডানের জোসী!

বিয়ের জন্য জীবনে প্রথম পাত্রী দেখতে যাবেন- অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিল তার মধ্যে; কিন্তু ম্যাচটিই যে শেষ করা হয়নি বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা এই লেফট উইঙ্গারের! ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ইনজুরিটা ওই ম্যাচেই। বাম পা ভেঙ্গে গেলে ১০ মাসের মতো চলে যেতে হলো মাঠের বাইরে। পাত্রী দেখতে যাওয়ার তো আর প্রশ্নই ওঠেনি। এটি ১৯৮৫ সালের ঘটনা। জোসী তখন ১৯ বছরের টসবগে যুবক।

বিজ্ঞাপন

পা ভাঙবে তো ভাঙ। তাই বলে পাত্রী দেখতে যাওয়ার দিনই? তো কিভাবে ভেঙেছিল জোসীর পা? সেই সাথে ভেঙেছিল সন্ধ্যায় পাত্রী দেখতে যাওয়ার স্বপ্নও?

Joshi

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩৫ বছর আগের স্মৃতির খাতা খুললেন জোসী, ‘বল নিয়ে তখন ওয়ারির বক্সের কাছে। আমার লক্ষ্য ছিল সালাম মুর্শেদীকে দিয়ে গোলটি করানো। তিনি একটু পেছনে ছিলেন; আমি অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় ওয়ারির শাহজাহান ভাই আমাকে এমনভাবে ট্যাকেল করলেন যে আমার পা-ই ভেঙ্গে গেলো। ওখান থেকে স্ট্রেচারে করে প্রথম মোহামেডান ক্লাবে (তখন ক্লাব ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের উত্তর পাশে) নিয়ে যাওয়া হয়।

আমাকে যখন বাইরে নিয়ে যায় তখন প্রায় দুই হাজার সমর্থক গ্যালারি থেকে বের হয়ে ক্লাবে চলে আসে। ক্লাবের সামনে থাকা যে গাড়িতে করে আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয় তার সামনে ছিল তিনটি গাড়ী রাখা। কোনো ড্রাইভার ছিল না সেখানে। সবাই খেলা দেখছিল। তো আমাকে ওঠানো গাড়ি কিভাবে বের হবে? আমার মনে আছে সমর্থকরা ধরে উঁচু করে তিনটি গাড়ী সরিয়ে আমাকে বহনকরা গাড়িটিকে বের হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সমর্থকদের সেই ভালোবাসা কখনো ভোলার নয়।’

সন্ধ্যার সেই পাত্রী কতদিন পর দেখেছিলেন? গল্পের পাতা উল্টালেন জোসী, ‘আমার এক ফুফাতো ভাইয়ের চাচাতো বোন আমার স্ত্রী। নাম সালেহা পারভীন মালা। আমার ফুফাতো ভাই’ই আমাকে মালার কথা বলেছিল। দুটি দুঃখ ছিল সেদিন, পা ভেঙ্গে ক্যারিয়ার হুমকির মুখে আর জীবনে প্রথম পাত্রী দেখতে যাবো তাও হলো না। ৯ মাস পায়ে প্লাস্টার ছিল। ক্লাবেই থাকতাম। ৯ মাস পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে হাঁটা-চলা শুরু করি। ক্লাবের কর্মকতারাই তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে আমাকে হাঁটার জন্য আনা-নেয়া করতেন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আস্তে আস্তে যখন পা ভালো হলো, তখন একদিন ঘুরতে গেলাম মতিঝিল ব্যাংক কলোনীতে। ওই কলোনীতেই থাকতো মালাদের পরিবার। ওর বাবাতো আমার সম্পর্কে চাচা হয়। তিনি দেখে ডাকলেন, বাসায় নিলেন। তখনই প্রথম পরিচয় হয় হবু স্ত্রীর সাথে। তারপর থেকে ওই বাসায় একটু আসা-যাওয়া চলতে থাকলো। ৮৮ সালের বন্যার আগে আমি একদিন হুট করেই মালাকে সরাসরি বললাম ‘বয়স তো হয়েছে। সরাসরিই বলি, তুমি রাজী থাকলে আমি বিয়ে করতে চাই। ওই দিন আর সেখান থেকে আসা হয়নি। রাতে থেকে সকালে ক্লাবে ফিরি। বাসা থেকে আসার সময় ‘ইয়েস কার্ড’ পেলাম। মালা জানিয়ে দিলো সে রাজী।

Joshi

‘ইয়েস কার্ড’ পাওয়ার পর আমাদের যোগাযোগ বাড়লো। প্রায়ই যেতাম সেখানে। বন্যায় শহরে পানি উঠলো। ব্যাংক কলোনীর মধ্যে দিয়েও নৌকা চলে। বিকেলে আমরা নৌকায় ঘুরতাম। তার ৭-৮ মাস পর পারিবারিকভাবে আমাদের আংটি পরানো হয়। বিয়ে হয় ১৯৯০ সালের ২৮ ডিসেম্বর। পা না ভাঙ্গলে হয়তো বিয়ে আরো আগেই হতো। এখন আমি আরামবাগে থাকি। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে কাজী জোবায়দা আহমেদকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলে কাজী সাজিদ আহমেদ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।’

বিজ্ঞাপন

শুরুতে বলছিলেন একবার মংলায় খেলতে গিয়ে না খেলেই ফিরে এসেছিলেন। কেন? ‘১৯৮০ সালের ঘটনা। আমার বয়স ১৬ বছর। মংলার স্মরণখোলা থানায় দুই চেয়ারম্যানের দলের মধ্যে খেলা ছিল। আমাকে নিয়ে যান সিনিয়র তালেব আলী ভাই। দুপুরে সেখানে চলে যাই। গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করি। বিকেলে মাঠে যাই। দেখি হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছে খোলা মাঠের চারপাশে। এর মধ্যে একদিকের গোলপোস্টের দুই পাশে এক চেয়ারম্যানের লোকজন প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বসা, অন্য দিকে আরেক চেয়ারম্যানের লোকজন। তাদের হাতেও বন্দুকসহ আরো অস্ত্রসস্ত্র। এরপর থানার ওসি পড়লেন বেকায়দায়, এ অবস্থায় খেলা শুরু করা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি খেলা বন্ধ করে দিলেন। আমরা শিবসা নদী পার হয়ে ফিরে এলাম’-ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের ঘটনা বলছিলেন জোসী।

ঘরোয়া ফুটবলে কাজী জসিম উদ্দিন জোসী খেলেছেন মোহামেডান, ব্রাদার্স ও অগ্রণী ব্যাংকে। এর মধ্যে বেশি সময় খেলেছেন ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের সাদা-কালো জার্সি গায়ে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে খেলে ১৯৮৮ সালে অগ্রণী ব্যাংক এবং তারপর দুই বছর ব্রাদার্সে খেলে আবার সাদা-কালো জার্সি তুলে নেন ৯১ সালে। খেলেন দুই বছর। জাতীয় দলে জোসীর অভিষেক ১৯৮২ সালে। খেলেন টানা ৫ বছর। ওই সময়ে দেশের অন্যতম সেরা লেফট উইঙ্গার ছিলেন খুলনার এ ফুটবলার।

Joshi

বিজ্ঞাপন

১৯৮৩ ও ৮৪ মোট চারবার মুখোমুখি হয়েছিল মোহামেডান-আবাহনী। আবাহনীর বিপক্ষে চার ম্যাচেই গোল করেছিলেন জোসী। এভাবে তিনি মোহামেডান সমর্থকদের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিলেন। জোসীকে আটকাতে ওই সময় আবাহনী তাদের রাইটব্যাক পজিশনে বারবার খেলোয়াড় পরিবর্তন করতো। কখনো দেওয়ান সফিউল আরেফীন টুটুল, কখনো অশোকা, কখনো পাকির আলী, কখনো গোলাম রব্বানী হেলাল, কখনো আবু ইউছুপ, মনি ও মোনেম মুন্নাকে কাজে লাগাতেন আবাহনীর কোচরা।

বাংলাদেশের ফুটবলে সেরা লেফট উইঙ্গার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু। তো চুন্নু আর জোসীর খেলার ধরনের পার্থক্য কি? দেখি জোসী কি বলেন, ‘চুন্নু ভাইয়ের খেলায় অন্যরকম একটা আর্ট ছিল। স্পট ড্রিবলিংয়ে অসাধারণ ছিলেন তিনি। আমি তার মতো এমন স্পট ড্রিবলার কখনো দেখিনি। আমার অভ্যাসটা ছিল বল নিয়ে দ্রুতগতিতে গোলাপোস্টের দিকে যাওয়া। পরবর্তীতে দেখেছিলাম জাহিদ হোসেন সেভাবে বল নিয়ে গোলপোস্টে যাওয়ার চেষ্টা করতেন।’

আরআই/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।