‘সবাই পা দিয়ে বল খেললে আমি কেন হাত দিয়ে খেলবো?’
নারায়নগঞ্জ শহরের পাইকপাড়া জিমখানা মাঠের পাশেই নিচু আরেকটি মাঠে একদল কিশোর বল খেলায় মেতে উঠতো প্রতিদিন বিকেলে। ফুটবল কেনার সাধ্য ছিল না তাদের। টেনিস বলেই চালিয়ে নিতো ফুটবলের কাজ। সেই খেলায় এক পাশের গোলপোস্টে দাঁড়াতেন সবার মধ্যে ছোট একজন। তার নাম চুন্নু, আশরাফ উদ্দিন আহমদে চুন্নু। যাকে এখনো সবাই দেশের সেরা লেফট উইঙ্গার হিসেবে জানেন।
গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে টেনিস বল ধরা! দুঃসাধ্য এক কাজই। সেই দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করতেন চুন্নু। একবার তো এক ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হয়ে ৬ আনা দামের টাওয়েল পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
ফুটবলে জীবনের প্রথম পুরস্কার গোলরক্ষক হিসেবে। তার তো এক সময়ে দেশের সেরা গোলরক্ষকই হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু না। আশরাফ উদ্দিন আহমদে চুন্নু ফুটবলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন লেফট উইঙ্গার হিসেবে। অথচ তিনি বাঁ-পা দিয়ে ফুটবলে শটই নিতে পারতেন না।
খেলতেন গোলপোস্টে, বাম পা চলতোই না। তাহলে সেই দিনের সেই কিশোর বড় হয়ে কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বাম পায়ের মাস্টার হিসেবে? গল্পটা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুর কাছেই শোনা যাক।
‘নারায়নগঞ্জের পাইকপাড়ায় সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই ছিল ফুটবলের ঐতিহ্য। এখান থেকে অনেক ফুটবলার কলকাতায় গিয়ে খেলেছেন। বিশেষভাবে আলাউদ্দিন খানের নামতো বলতেই হয়। তিনি আমার ফুটবলের গুরু। তার প্রসঙ্গে পরে আসছি। আমি তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। ফুটবল কেনার সাধ্য ছিল না বলে আমরা পোলাপানরা টেনিস বলেই ফুটবল খেলতাম। আমি খেলতাম গোলরক্ষক হিসেবে। গোলপোস্টে খেলে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও পেয়েছি। তখন ভ্যানে ৬ আনা দামের অনেক জিনিস বিক্রি হতো। সেই ভ্যান থেকে কেনা একটি টাওয়েল পুরস্কার পেয়েছিলাম।
যখন ক্লাশ সেভেন-এইটে পড়ি তখন একটু বড়দের সাথে খেলি। বিকেলে ২৫-৩০ জন হয়ে যেতো। দুইভাগ করে খেললে সবাই সুযোগ পেতো না। আমি সবার ছোট বলে আমাকে বলা হতো গোলপোস্টে দাঁড়াতে। আমি খেলতাম। গোলরক্ষক হিসেবে ভালো খেললেও কখনো এই পজিশনে আমার ভালো লাগতো না। আমি দাঁড়িয়ে থাকি আর সবাই খেলে। সবাই পা দিয়ে খেলে আমি কি হাত দিয়েই খেলবো? একদিন বললাম, আমি গোলরক্ষক হিসেবে খেলবো না, ওপরে খেলবো। বড়রা বলে- না তুমি গোলপোস্টেই খেলবা। আমি তখন পরিস্কার বললাম, ওপরে খেলতে না নিলে আমি খেলবোই না। সবাই বললো- ঠিক আছে তোর খেলার দরকার নেই।
প্রতিদিন আমি মাঠে যাই। কিন্তু ওরা আমাকে নেয় না। আমি মাঠের পাশে বসে খেলা দেখি। আমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ওপরে না হলে খেলবোই না। সপ্তাহখানেক পর এক বিকেলে ২২ জন হচ্ছিল না। ওই দিন আমাকে ওপরে খেলার সুযোগ দিলো। ওপরে ভালোই খেললাম।
এভাবে যেদিন খেলোয়াড় কম থাকে ওপরে খেলি। বেশি হলে খেলি না। বসে থাকি। আমার জিদ একটাই ছিল- গোলপোস্টে আর দাঁড়াবো না। একদিন টেনিস বলে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হলো। আমি ওপরে খেলে হ্যাটট্রিক করলাম। সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলাম। পুরস্কার হিসেবে একটি কাপ পেয়েছিলাম। খেলার পর সবাই খাওয়া-দাওয়া করবে, সবাই আনন্দ করবে। কিন্তু আমি কাপ পাওয়ার পরই এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাই। মাঠ থেকে এক কিলোমিটারের মতো দুরে আমাদের বাড়ি। আমি এতটাই আনন্দিত হয়েছিলাম যে, এক দৌড়ে বাড়ি এসে মায়ের হাতে কাপটি দিয়েছিলাম।
আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। তখন জিমখানা মাঠে আলাউদ্দিন খান ৫০/৬০ জনকে ফুটবল ট্রেনিং দিতেন। তাদেরকে ৮/১০ টা দলে ভাগ করে তিনি খেলাতেন। আমি একদিন তার কাছে গেলাম। ট্রেনিংয়ের আগ্রহ প্রকাশ করলাম। নাম পরিচয় জানতে চাইলেন। বলার পর চিনলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন কোন পজিশনে খেলি। বললাম ওপরে। তিনি আমাকে সুযোগ দিলেন। বললেন- তোমাকে একটা পজিশনে দিচ্ছি। তুমি এখানে খেলো। পজিশন ছিল লেফট আউট। বললাম- আমিতো বাম পায়ে বলই মারতে পারি না। বাম পা তো আমার চলেই না। খেলবো কিভাবে? আমার মনে আছে, আলাউদ্দিন খান ধমক দিয়ে বলেছিলেন ‘যা বলি তাই করো।’
কয়েকদিন পর একটি বল দিয়ে আমাকে বললো, ‘তোমাদের বাড়িতে দেয়াল থাকলে সেখানে বল পুশ করবে। বললাম আমাদের তো টিনের ঘর। তখন তিনি বললেন রাস্তায় যে দেয়াল আছে সেখানে শুধু বাম পা দিয়ে বল পুশ করবে। যদি ডান পা ব্যবহার করো আর আমি দেখি তাহলে তোমার ডান পা কেটে ফেলবো। আমি ওভাবেই বাম পায়ের মাস্টারপিস হয়ে গেলাম!
আমি যখন জাতীয় দলে খেলি তখন একদিন আলাউদ্দিন খান আমাকে বলছিলেন, মনে আছে তোমাকে আমি বাম পায়ের খেলার জন্য বলেছিলাম। কেন বলেছিলাম জানো? কারণ বাম পায়ের খেলোয়াড় কম থাকে। যারা বাম পায়ে বলটা বেশি রপ্ত করতে পারে তারা ভালো ফুটবলার হয়। আমি তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দেশের সেরা লেফট উইঙ্গার হয়েছিলাম। জাতীয় দলে টানা ১০ বছর খেলেছি।’
অনেকেই বলেন আশরাফ উদ্দিন চুন্নুর মতো লেফট উইঙ্গার আর জন্ম হয়নি বাংলাদেশে। নিজের পর কি বাম পায়ের ভালো উইঙ্গার দেখেছেন চুন্নু? ‘আমার পরে জসিমউদ্দিন জোসি ও মামুন বাবুরা লেফট উইংয়ে ভালো খেলেছেন’- চুন্নু বলছিলেন নিজের উত্তরসূরিদের কথা
নিজের সোনালী দিনের কথা বলতে গেলে আশরাফ উদ্দিন আহমদে চুন্নু কখনোই আলাউদ্দিন খানের অবদানের কথা বলতে ভোলেন না ‘আমার বাবা-মা’র কল্যাণে আমি পৃথিবীতে এসেছি। তবে আমাকে ফুটবলার হিসেবে জন্ম দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খান।
আপনার ফুটবল থেকে প্রথম আয়ের কথা মনে আছে? আশরাফ উদ্দিন চুন্নু হেসে বললেন, ‘দুই টাকা।’ কিভাবে একটু শুনি। চুন্নু বলেন, ‘১৯৬৯ সালের কথা। আমি জয় গোবিন্দ হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ি। ইন্টারস্কুল টুর্নামেন্টর ফাইনাল। ভালো খেলেছিলাম। ম্যাচের পর গেম টিচার আমাকে ২ টাকা দিয়েছিলেন। আমি ওই দুই টাকায় মিষ্টি কিনে বাসায় নিয়েছিলাম। সবাইকে বলেছিলাম- ফুটবল খেলার টাকা দিয়ে মিষ্টি এনেছি। সে স্মৃতি ভোলার নয়।’
আশরাফ উদ্দিন আহমদে চুন্নুকে বলা হতো ফুটবলের নিপুণ শিল্পী। ফুটবল মাঠে তার বাম পায়ের কারুকাজে মুগ্ধ হতেন দর্শকরা। অ্যাটাকিং লেফট উইঙ্গার হিসেবে চুন্নুর তুলনা চন্নুই ছিলেন।
১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুর জন্ম। ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবে, ১৯৭৪ সালে প্রথম বিভাগের দল রহমতগঞ্জের হয়ে ঢাকার ফুটবল শুরু চুন্নুর। ১৯৭৫ সাল থেকে আবাহনী হয়ে যায় তার স্থায়ী ঠিকানা। আবাহনীর জার্সিতে দীর্ঘ ১৪ বছর ফুটবল দিয়ে দর্শকদের মন মাতিয়েছেন তিনি। আবাহনীর পাঁচবার লিগ ও চারবার ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য তিনি। ১৯৭৯ সালে তিনি ছিলেন দলটির অধিনায়ক।
স্ট্রাইকার পজিশনে না খেললেও গোল করার নেশা ছিল তার। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক করা ফুটবলার তিনি। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে চুন্নু নেপালের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। আশরাফ উদ্দিন আহমদে চুন্নু জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৬ সালে।
আরআই/আইএইচএস/