হবু স্ত্রীর চ্যালেঞ্জে হ্যাটট্রিক, ইজতেমায় বিয়ে ফুটবলার আসলামের
সন্ধ্যায় ওয়ারির বিপক্ষে লিগের ম্যাচ। স্টেডিয়ামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। আবাহনী ক্লাবে হাজির মোনা মারজান। আসলামের সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার সময়ে মোনা মারজান শুধু বলে গেলেন, ‘পারলে হ্যাটট্রিক করিও আজ।’ আসলামের কাছে চ্যালেঞ্জটা ‘মাছকে সাঁতার কাটতে বলার মতোই ছিল।’ ওয়ারিকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল আবাহনী, আসলামের তিন গোল। এটি ১৯৮৬ সালের ঘটনা।
মোনা মারজানকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক। তিনি তখন শেখ মোহাম্মদ আসলামের চাচাতো বোন, প্রেমিকা ও হবু স্ত্রী। এর চার বছর পর এই চাচাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। বিয়েটাও ছিল যেন একটা চমক। তাদের বিয়েট হয়েছিল টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে। তবে সে গল্পে পরে আসছি।
চাচাতো বোনের সঙ্গে কিভাবে প্রেমে জড়ালেন ওই সময়ের তুখোড় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার আসলাম? কে আগে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছিলেন? জেনে নিই শেখ মোহামম্মদ আসলামের কাছ থেকেই।
‘আমার বাবা শেখ আলী আহমেদের চাচাতো ভাই শেখ নুরুদ্দিনের মেয়ে মোনা মারজান। আমার ওই চাচা এক সময় ভালো ফুটবল খেলতেন। চাচা কাস্টমসে চাকরি করতেন। খুলনা থেকে চট্টগ্রাম চলে যান। তিনি চাকরি কন্টিনিউ করেননি। ব্যবসা শুরু করেন। মোনা আমার চেয়ে বেশ ছোট ছিল। ওদের বাসায় আমার যাতায়াত ছিল; কিন্তু আমি জানতাম না মোনা আমাকে পছন্দ করে। শুধু পছন্দ নয়, আমার বিশাল ভক্ত সে, আমাকে ভালোবাসে- এসব আমি কিছুই জানতাম না।’
কিভাবে, কখন জানা হলো? পরের ঘটনা বলছিলেন আসলাম, ‘১৯৮৬ সালের দিকে মোনাই আমাকে প্রথম বলে তার ভালোলাগা ও ভালোবাসার কথা। সে যে আমার বিশাল ফ্যান তাও জানলাম তখন। তারপর বিষয়টা দুই পরিবারের আলোচনার মধ্যে চলে যায়। আমাদের প্রেমও চলতে থাকে। ১৯৯০ সালে বিয়ের কিছুদিন আগে চাচা, মানে মোনার বাবা আমার আব্বা-আম্মা এবং আমাকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কথা বলেন। আমাদের বিয়েতে মোনার আব্বার আন্তরিকতাই বেশি ছিল।’
বেশ কয়েক বছর প্রেম। তারপর পারিবারিকভাবেই বিয়ে। তো বিয়েটা বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে কেন হলো? মোনা মারজানের কাছেই জেনে নিই এই অংশটুকু।
‘ওই সময় বিশ্ব ইজতেমার বড় হুজুর মওলানা আজীজ ছিলেন আমাদের খুলনার। বাবার সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের বিয়ের কথাটা ওই হুজুরকে জানাতে গিয়েছিলেন আব্বা। তখন হুজুর বলেছিলেন, ঠিক আছে। তাহলে বিয়েটা এমন এক জায়গায় হোক যে সবার মনে থাকবে। ইজতেমায় হবে ওদের বিয়ে। তখন আব্বাও বলেছিলেন হুজরকে, তাহলেআপনি নিজে বিয়ে পড়াবেন ওদের।’
পরক্ষণে মোনা মারজান বলেন, ‘বড় হুজুর সাধারণত বিয়ে পড়াতেন না; কিন্তু তিনি আমাদের বিয়ে পড়িয়েছিলেন। ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৯০ সাল। হুজুর সবাইকে ইজতেমায় ডেকে আমাদের বিয়ে পড়ান। আমি তখন ছিলাম চট্টগ্রামে। আমার আব্বা, তার দুই চাচা, আসলাম ও তার আব্বা টঙ্গী ইজতেমায় গিয়েছিলেন। হুজুর টেলিফোনে আমার সম্মতি নিয়েছিলেন। ফোনেই আমি কবুল বলেছিলাম। বিয়ের পর ওখানে সবাইকে খুরমা খেজুর খাইয়েছিলেন। বিয়ের তিনদিন পর আসলাম চলে যান চীনে এশিয়ান গেমসে খেলতে। তখন আমি ঢাকা এসে ওকে বিদায় দিলাম। বিয়ের তিনদিন পর প্রথম দেখা হয় আমাদের।’
বিয়ের অনুষ্ঠান কি হয়েছিল আর? ‘না হয়নি। চীন থেকে আসলাম ফিরেছিলেন ২০ সেপ্টেম্বরের পর। সম্ভবত ২১ থেকে ২৫ এর যে কোনো দিন। মনে নেই। আসলাম ফিরলেই অনুষ্ঠান করার কথা ভেবে রেখেছিলেন সবাই; কিন্তু আসলাম চীন থাকাকালীনই ওর মা (আমার শ্বাশুড়ি) অসুস্থ হয়ে হাসাপালে ভর্তি হলেন। আসলামকে সেটা চীনে জানানো হয়নি। ঢাকায় ফিরে শুনতে পায়। বিয়ের অনুষ্ঠান পরে আর করাই হয়নি’- বলছিলেন মোনা মারজান।
মোনা মারজান কি করেন? একটু পরিচয় করিয়ে দেই। তিনি এখন ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজী)। ২০০০ সাল থেকে আছে দেশের অন্যতম বড় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাশ করে বিসিএস করেছিলেন। পুলিশের এএসপি পদে সুযোগও পেয়েছিলেন; কিন্তু পুলিশে যোগ না দিয়ে বেছে নিয়েছেন শিক্ষতার মহান পেশাকে।
শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও মোনা মারজান দম্পতির দুই সন্তান। বড় মেয়ে শেখ মানি মারজানকে বিয়ে দিয়েছেন কিছুদিন আগে। ছোট মেয়ে শেখ মাহি মারজান এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন।
বিয়ের আগে ভাবী কি মাঠে আসতেন আপনার খেলা দেখতে? ‘না। সে মাঠে এসে খেলা দেখতো না। টিভিতে দেখালেই তখন দেখতো। আর ওই যে ১৯৮৬ সালে ওয়ারির বিপক্ষে লিগ ম্যাচের আগে আবাহনী ক্লাবে একবার এসে আমাকে হ্যাটট্রিক করার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গিয়েছিল আর কি?’-বলছিলেন আসলাম।
চ্যালেঞ্জেই কি হ্যাটট্রিক করেছিলেন ওই ম্যাচে? হেসে আসলামের জবাব, ‘ও হ্যাটট্রিক করতে বলেছিল। আমি করেছি। হয়তো ঝড়ে বক মরার মতো ব্যাপারটা আর কি।’
শেখ মোহাম্মদ আসলামের ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে বলার নেই। তারপরও সংক্ষেপে চোখ বুলানো যাক। আসলামকে বলা হতো গোল বুভুক্ষু। ঢাকার মাঠে এমন গোলক্ষুধা ছিল না আর কোনো স্ট্রাইকারের। শেখ মোহাম্মদ আসলামের জন্ম খুলনায় ১৯৫৮ সালের ১ মার্চ। ১৯৭৪ সালে খুলনা দ্বিতীয় বিভাগ লিগে টাউন ক্লাবের হয়ে তার ফুটবলযাত্রা শুরু। পরের বছর খেলেন ওয়াপদায়। ১৯৭৬ সালে ওয়াপদায় খেলার সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৭ সালে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে নাম লেখান তিনি।
তিন বছর ভিক্টোরিয়ায় খেলার পর ১৯৮০ সালে যোগ দেন বিজেএমসিতে। ১৯৮১ সালে ছিলেন বিজেএমসির অধিনায়ক। ১৯৮৩ সালে মোহামেডানে যোগ দেন। পরের বছর আবাহনীতে। টানা চার বছর লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সাল- প্রতিটি লিগে হ্যাটট্রিক করার বিরল কৃতিত্ব আছে আসলামের। ১০৩টি গোল করে লিগে কাজী মো. সালাউদ্দিনের শতাধিক গোল করার রেকর্ড ভেঙ্গেছিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ফুটবলেও দাপটের সঙ্গে খেলেছেন আসলাম। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল দিয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অভিষেক হয়েছিল তার। ক্যারিয়ারে ২৮ টি আন্তর্জাতিক গোল করেছেন। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ২০০০ সালে।
আরআই/আইএইচএস/