পুরুষ ফুটবলারদের কোচ হয়ে ইতিহাসের পাতায় মিরোনা

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৮:৪৪ এএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

শেখ আবদুল গনির তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তৃতীয় মিরোনা খাতুন। ছোটখাটো গড়নের মিরোনা খেলাধুলায় অভিষেক হয়েছিল অ্যাথলেটিকসে। দেশের নারী ফুটবলেও অতি পরিচিত মুখ। ৪ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার মিরোনা ছিলেন জাতীয় দলের ডিফেন্সের অতন্ত্র প্রহরী।

২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল-টানা ৯ বছর জাতীয় দলে সেবা দিয়েছেন বাগেরহাটের মেয়ে মিরোনা। এখনতো দেশের ফুটবলের ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন কোচ হিসেবে। খেলা ছাড়লেও ফুটবলকে আঁকড়ে থাকার নেশায় বেছে নেন কোচিং পেশা।

২০১৩ সালে ‘সি’ লাইসেন্স ও ২০১৮ সালে ‘বি’ লাইসেন্স কোর্স সম্পন্ন করা মিরোনা ক্যারিয়ারে প্রথম দায়িত্ব নিয়েছেন পুরুষ ফুটবল দলের। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের (বিসিএল) নতুন দল ঢাকা সিটি এফসির প্রধান কোচ হিসেবে ইতিমধ্যে অভিষেক হয়েছে ২৬ বছরের এ যুবতীর।

মিরোনা খাতুনই দেশের প্রথম নারী যিনি কোচ হয়েছেন পুরুষ ফুটবল দলের। অ্যাথলেট হিসেবে ২০১৪ সালে চুক্তিভিত্তিক যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে। তার পারফরম্যান্স দেখে পরের বছরই নৌ-বাহিনী কর্তৃপক্ষ স্থায়ী করে মিরোনার চাকরি।

বড় কোচ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কোচিং লাইসেন্সের প্রথম দুই ধাপ পার করলেও কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি তার অভিষেক হবে ইতিহাস গড়ার মধ্যে দিয়ে। নারী হয়ে পুরুষ ফুটবল দলের কোচ-এ সুযোগটা হঠাৎ করেই এসেছে মিরোনার সামনে। সিটি এফসির কোচ আবু নোমান নান্নু ‘সি’ লাইসেন্সধারী।

কিন্তু চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের নিয়ম অনুযায়ী প্রধান কোচকে হতে হবে অবশ্যই ‘বি’ লাইসেন্সধারী। তাইতো এই ক্লাবের প্রধান কোচ হওয়ার প্রস্তাবটা পেয়ে যান মিরোনা। গত ডিসেম্বরে এই ক্লাবের কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক এ ডিফেন্ডার।

জাতীয় দলে ফুটবল খেলেছেন। খেলেছেন ঘরোয়া ফুটবলে বিভিন্ন ক্লাবে। এমন কী দেশের বাইরে লিগ খেলার অভিজ্ঞতাও আছে তার। ২০১৪ সালে মালদ্বীপের ঘরোয়া ফুটবলে বাংলাদেশের ৩ নারী ফুটবল অংশ নিয়েছিলেন। স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন, গোলরক্ষক সাবিনার সঙ্গে মিরোনাও খেলে এসেছিলেন মালদ্বীপের ঘরোয়া ফুটবলে।

এসব ইতিহাস পেছনে ফেলে মিরোনা তৈরী করেছেন নতুন ইতিহাস-বাংলাদেশে পুরুষ ফুটবল দলের প্রথম নারী কোচ। এখানেই থেমে থাকতে চাননা মিরোনা। দাঁড়াতে চান আরো বড় লিগের ডাগআউটে। ঢাকা সিটি এফসি প্রিমিয়ার লিগে ওঠার লক্ষ্য নিয়েই দল গড়েছে। যদিও লিগের দলবদল শুরু হওয়ার মাত্র এক মাস আগে বাফুফে ক্লাবটিকে খেলার অনুমতি দিয়েছে। তাই অন্য ক্লাবগুলোর দল গোছানোর পর মাঠে নামতে হয়েছে তাদের। যে কারণে, প্রত্যাশা অনুযায়ী দল তারা করতে পারেনি।

প্রথম কোনো দলের প্রধান কোচ। তার ওপর আবার ছেলেদের। কোন সমস্যা অনুভব করছেন মিরোনা? ‘কোনো সমস্যা নেই। ফুটবলতো ফুটবলই। সে পুরুষদের হোক আর মেয়েদের। আমি যখন অনুশীলন করাই তখন মনে করি ফুটবলারদের অনুশীলন করাচ্ছি। তারা ছেলে নাকি মেয়ে তা মাথায় নেই না। আমার বিশ্বাস একজন ফুটবলারের সামনে তার কোচও পুরুষ কি নারী সেটা বিষয় না। সব খেলোয়াড়কেই সম্মান দিতে হবে কোচকে। তাহলেই শিখতে পারবে’-বলছিলেন মিরোনা খাতুন।

খেলোয়াড় হিসেবে এসএ গেমস, অলিম্পিক বাছাই, এশিয়ান বাছাই খেলেছেন। ফুটবলার হিসেবে দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়ানো মিরোনা কোচ হিসেবেও নিজেকে নিতে চান অনন্য উচ্চতায়। মিরোনা সেটা পারবে বলেই দৃঢ় বিশ্বাস ঢাকা সিটি এফসির সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুদ্দোজা খান তুহিনের। ফুটবলে নতুন এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিলে। সাধারণ সম্পাদক অবশ্য একজন ব্যবসায়ী।

মিরোনা প্রসঙ্গ উঠতে মঙ্গলবার মো. শামসুদ্দোজা খান তুহিন বলেন, ‘মিরোনা খুবই মেধা সম্পন্ন এক মেয়ে। তার কোচিং করানোর স্টাইল আধুনিক। আমাদের যখন ‘বি’ লাইসেন্সধারী একজন কোচ দরকার হলো তখন তাকে পছন্দ করি। কারণ, সে নৌবাহনীতে থাকায় আমাদের অনেকেরই মিরোনা সম্পর্কে ধারণা ছিল। এক কথায় আমি বলবো-মিরোনা খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে।’

ঢাকা সিটি এএফসির কোচের দায়িত্ব নেয়ার আগে ভারতের একটি রাজ্য দল থেকেও প্রস্তাব পেয়েছিলেন মিরোনা। বিপিএড (শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক) থাকায় সে সুযোগটা নিতে পারেননি। সেটা যেন মিরোনার জন্য শাপেবরই হয়েছে। ভারতের ওই রাজ্য দলের দায়িত্ব নিলে মিরোনার যে এ যাত্রায় পুরুষ দলের প্রধান কোচ হয়ে ইতিহাস গড়া হতো না।

নারী হয়ে পুরুষ ফুটবলারদের কোচিং। এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। মিরোনা সেই চ্যালেঞ্জটা ভালোভাবেই নিয়েছেন। অনুশীলন করাতেও তার ভালো লাগছে। ‘আমি চ্যালেঞ্জিং এ দায়িত্বটাকে বেশ উপভোগ করছি। ঢাকা সিটি এফসি দলে অনেক ভালো মানের ফুটবলার আছেন। আশা করি, এ দলটিকে প্রিমিয়ারে তুলতে পারবো। আর তাহলে তো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের কোচ হিসেবে কাজ করতে পারবো’- কথাগুলো বলতে গিয়ে নিজের আরো বড় স্বপ্নের জালবোনার গল্প শোনালেন ইতিহাস গড়া মিরোনা।

জাতীয় দলের নিয়মিত ফুটবলারের পাশাপাশি অ্যাথলেটিকসেও মিরোনার ছিল গৌরবময় উপস্থিতি। সেখানেও কাটিয়েছেন সোনালী সময়। আর অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাক মাতিয়েছেন বিজেএমসি ও নৌবাহিনীর হয়ে। দূরপাল্লার দৌড়ে ৮০০, ১৫০০ ও ৩০০০ মিটারে জাতীয় আসরে সোনা জিতেছেন ১৩টি। ফুটবল মাঠ আর অ্যাথলেটিক ট্র্যাকের পর এবার কোচ হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চান মিরোনা খাতুন।

আরআই/এসএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।