এখন শুধু বাঁচতে চান ফুটবলার সুজন

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৯:২৯ এএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মো. জিন্নাত আলী ২০ বছর ধরে ফুটপাতে কখনো ফল, কখনো সিদ্ধ ডিম বিক্রি করেন। বয়স ৬০ বছরে পড়েছে। এখনো চলছে রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে তার সংসার চালানোর সংগ্রাম। লালবাগের পোস্তায় একটি ভাড়া বাসায় বাস করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।

লালবাগ কেল্লার মোড়ে নিয়মিতই চোখে পড়বে টুকরিতে সাজিয়ে তাকে ফল বা সিদ্ধ ডিম বিক্রি করতে। বৃদ্ধ বয়সে এসে চোখে সরষে ফুল দেখছেন চার সন্তানের জনক জিন্নাত। ফল আর ডিমের টুকরির চেয়ে তার মাথার উপর এখন বড় বোঝা ফুটবলার ছেলে শাহজাহান আহমেদ সুজন। কিডনি রোগে আক্রান্ত এই ছেলের চিকিৎসা আর সংসারের ঘানি টানতে রীতিমতো হয়রান বৃদ্ধ জিন্নাত।

সুজনদের চার ভাই/বোনের সংসারে বোনই ছোট। বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই চান মিয়া একটি গার্মেন্টসে সাপ্লাইয়ের কাজ করতেন। তাও এখন বন্ধ। হাজার দশেক টাকা আয় হতো, যা দিয়ে তাদের বাসা ভাড়াটা হয়ে যেতো। বাবার ফুটপাতে ফল-ডিম বিক্রি, ছোট ভাইয়ের মেয়েদের পোশাকের ছোট্ট একটা দোকান আর সুজনের ফুটবল খেলার টাকায় চলে যেতো তাদের সংসার। আয়গুলোর পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুজনদের পরিবারের এখন টিকে থাকাই দায়।

পাইওনিয়ার, তৃতীয় বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, প্রথম বিভাগ ও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ খেলার পর প্রিমিয়ার লিগেও অভিষেক হয়েছিল সুজনের। ফুটবল ক্যারিয়ারটা বেশ ভালোভাবেই গড়ে তোলার অপেক্ষায় ছিলেন সুজন। এই তো এক মৌসুম আগেই তাকে দেখা গেছে ১৫ নম্বর জার্সি গায়ে পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব রহমতগঞ্জের রাইটব্যাক দাপিয়ে খেলতে। ২০১৭ সালে খেলা শেষ করার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন সুজন। ওই বছরের জুলাইয়ে তার কিডনি রোগ ধরা পড়ে। যা ছিল গরীবের সংসারের সদস্যদের মাথার উপর বাজ পড়ার মতো খবর।

Sujon

রোগটা তার ধরা পড়ে দেরিতে। তাই চিকিৎসার শুরু থেকেই ডায়ালাইসিস। তিন মাস দেশে চিকিৎসার পর গিয়েছিলেন ভারতের চেন্নাইয়ে। সেখানকার ডাক্তার বলে দিয়েছেন কিডনি প্রতিস্থাপন করতে। খরচের সম্ভাব্য হিসেবেও দিয়েছে চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ- প্রয়োজন ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা।

কিডনি প্রতিস্থাপন তো পরের বিষয়, এখন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতেই হিমশিম খাচ্ছেন ২৭ বছরের এ যুবক। মাসে ৮ থেকে ১০ বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রতিবারের খরচ ১৫০০ টাকা। ধার-দেনা করে চিকিৎসা করছেন সুজন। এ করতে গিয়ে ছোট ভাইয়ের দোকানটিও ছেড়ে দেয়া লাগবে। এখন যে বাসায় ভাড়া থাকেন তারা সেটি ছেড়ে আরো কম টাকার বাসা খুঁজছে সুজনের পরিবার।

ফুটবল খেলার আশা আর নেই সুজনের। এখন তার কাছে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ। অনেকটা হাত পেতেই চিকিৎসা চালাচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা এ ফুটবলার। এইতো কয়েকদিন আগে আবাহনী ক্লাব গিয়েছিলেন। ক্লাবের ফুটবলাররা মিলে ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন সুজনের হাতে। বিজেএমসির ফুটবলাররা দিয়েছেন ৫ হাজার টাকা। ১৩ হাজার ৫ শত টাকা পেয়েছেন তার প্রিমিয়ারের ক্লাব রহমতগঞ্জের ফুটবলারদের কাছ থেকে।

চিকিৎসার সহায়তার জন্য বাফুফের কাছে আবেদন করার কথা ভাবছেন সুজন। সহায়তা চাইবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও। এজন্য সুজন কয়েকদিন ধরে দেখা করার চেষ্টা করছেন বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদের সঙ্গে। তার মাধ্যমেই সুজন সহায়তা চাইবেন প্রধানমন্ত্রীর।

সাবেক যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সুজন। তখন অবশ্য জয়ের মেয়াদের শেষ সময়। ‘আমি জয় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাকে একটি ফরম দিয়ে তা পূরণ করে সচিবালয়ে জমা দিতে বলেছিলেন। আমি জমা দিয়েছিলাম। ওই পর্যন্তই । কিছু আর হয়নি’- বলেন সুজন।

ফুটবল খেলে টুকটাক ভালই রোজগার হতো সুজনের। চ্যাম্পিয়নশিপের দল অগ্রনী ব্যাংকে খেলে পেয়েছিলেন ৬০ হাজার টাকা। ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন রহমতগঞ্জে খেলে। তখনই ছোট ভাইকে একটি দোকান করে দিয়েছিলেন সুজন। বাসার সামনে কেল্লার মোড় মার্কেটে সে দোকান ভাড়া মাসে ৬ হাজার টাকা। সেটাও ছাড়তে হবে এখন। কারণ, নতুন দোকান এখনো জমে উঠেনি। ভাড়া মেটানো মুশকিল।

‘এখন আমরা কেবল বাঁচতেই ইচ্ছে করে। ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে কীভাবে বাঁচবো? তাই আমি সবার সহযোগিতা চাই। প্রধানমন্ত্রী অনেক অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করেন। আমার বিশ্বাস তাঁর কাছে পৌছতে পারলে আমিও সহযোগিতা পাবো। আশা করি, আমাকে বাঁচাতে দয়ালু ব্যক্তিরা এগিয়ে আসবেন’- বলতে গিয়ে চোখের পানি ছাড়লেন সুজন। ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা একজন ফুটবলারের বাঁচার এই আকুতি বিবেককে নাড়া দেয়ার মতোই।

আরআই/এসএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।