তৃপ্তি নিয়েই ফুটবল ছাড়ছেন বিপ্লব ভট্টাচার্য

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৬:১৫ পিএম, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

টানা দুই যুগ ফুটবল খেলে অবশেষে বুট-জার্সি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্য। বয়স ৩৮ বছর চলছে। এর মধ্যে ২৪ বছর খেলেছেন ফুটবল। এবারই বিপ্লবের শেষ মৌসুম।

শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র ছেড়ে বিপ্লবের সম্ভাব্য নতুন দল নোফেল স্পোর্টিং ক্লাব। সব কিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের নবাগত এই ক্লাবের জার্সি পড়েই ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলবেন ১৯৯৯ সালে সাফ গেমস ফুটবলে স্বর্ণজয়ী দলের গর্বিত এ সদস্য।

ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন টানা ২৪ বছর। জাতীয় দলে ১৬। বাংলাদেশের ফুটবলের সেরা দুই অর্জন সাফ গেমসে স্বর্ণ ও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়- দুই দলেরই সদস্য ছিলেন বিপ্লব। সোনার হরিণ হয়ে যাওয়া সাফ গেমসের স্বর্ণ বাংলাদেশকে প্রথম ধরা দেয় ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে। নেপালের বিরুদ্ধে ফাইনালে বিপ্লবের ছিল অসাধারণ নৈপূণ্য।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা যে কয়জন গোলরক্ষকের নাম সামনে আসে বিপ্লব তাদের মধ্যে অন্যতম। অথচ এই বিপ্লব ফুটবল শুরু করেছিলের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে। তবে তা কৈশরে, নিজ জেলায়। ঢাকার ফুটবলে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন গোলরক্ষক হিসেবেই। যদিও মাঝেমধ্যে স্ট্রাইকার হিসেবেও দেখা গেছে বিপ্লবকে। জাতীয় লিগে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে আবাহনীর বিরুদ্ধেও বিপ্লবকে দেখা গেছে স্ট্রাইকারের ভূমিকায়।

ঢাকার ফুটবলে বিপ্লবের আত্মপ্রকাশ ১৯৯৩ সালে পাইওনিয়ারের ক্লাব দিপালী যুব সংঘের জার্সি গায়ে। আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা, ব্রাদার্স, শেখ রাসেল, ফরাশগঞ্জে খেলেছেন দীর্ঘ ক্যারিয়ারে। তবে বিপ্লবের ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন আবাহনীতে।

১৯৯৩ সালে তৃতীয় বিভাগের দল দিপালী যুব সংঘে থাকাকালীন আবাহনীর ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন। প্রায় ১ হাজার ফুটবলার থেকে আবাহনী যে ৫ জনকে বেছে নিয়েছিল তার একজন ছিলেন বিপ্লব।

১৯৯৪ সালে আবাহনী দলের তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে বিপ্লবকে রাখে লিগের জন্য। তবে খেলার সুযোগ হয়েছিল ফেডারেশন কাপের একটি মাত্র ম্যাচ। '৯৫ সালে ক্লাবের এক নম্বর গোলরক্ষক সাইদুর রহমান অসুস্থ হওয়ায় বিপ্লবকে প্রথম একাদশে রাখেন আবাহনীর তৎকালীন কোচ ছিলেন আবদুল গাফফার।

সেই শুরু। তারপর আর পেছনে তাকাননি বিপ্লব। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে বুক চিতিয়ে খেলেছেন গোলপোস্টের নিচে। ১৯৯৬ সালে জার্মান কোচ অটো ফিস্টারের হাত ধরে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৬ দলে সুযোগ পান বিপ্লব। পরের বছর জাতীয় দলে অভিষেক হয় সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ১০ মিনিটে পেনাল্টি ঠেকিয়ে সবার নজর কেড়েছিলেন বিপ্লব।

কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলেরও এক উজ্জ্বল নাম বিপ্লব। ১৯৯৭ সালে প্রথম সাফ ফুটবলে খেলেছেন। টানা ৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে অনন্য রেকর্ডও গড়েন বাংলাদেশের এ গোলরক্ষক। ২০১৩ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপই বিপ্লবের জাতীয় দলের হয়ে শেষ খেলা।

জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখলেও ক্লাব ফুটবলে ঠিকই খেলে যান বিপ্লব। গত মৌসুমে খেলেছেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রে। ব্লুজদের হয়ে ২০১২-১৩ মৌসুমে ট্রেবলজয়ী দলের সদস্যও ছিলেন বিপ্লব ভট্টাচার্য।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক স্মৃতি, অনেক ঘটনা আছে বিপ্লবের। ক্যারিয়ার শেষ করতে যাচ্ছেন তৃপ্তি নিয়ে। সেরা এ গোলরক্ষক ‘কোনো অত ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ হিসেবে উপরে রাখলেন ৯৯ সালের সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনাল ‘আলফাজ ম্যাচের শুরুর দিকে গোল করেছিল। পরে আমাকে পোস্টে নেপালি ঝড় সামলিয়েছিলাম। ওই ম্যাচটি আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয়।’

আরেকটি ম্যাচের কথাও স্মরণে আনলেন বিপ্লব, ‘২০০২ সালে বুসান এশিয়ান গেমসে চীনের বিরুদ্ধে আমরা ১২/১৪ গোলে হারলেও অবাক হওয়ার ছিল না। বুঝতেই পারছেন কী ঝড় গিয়েছিল আমাদের উপর দিয়ে।’

ব্যক্তি জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা বিপ্লব। ১৩ বছরের ছেলে কৃষ ধানমন্ডির স্কলার্স স্কুলের সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র। মেয়ে স্পর্শ‘র বয়স দেড় বছর।

খেলা ছেড়ে দিলেও ফুটবলে থাকতে চান বিপ্লব। নজরটা কোচিংয়ে। ইতিমধ্যে ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স শেষ করেছেন। এপ্রিলে করবেন গোলকিপিংয়ের লেভেল-১ কোর্স। ওই কোর্স শেষ করলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ এমন কী জাতীয় দলের কোচিং স্টাফে যোগ দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন বিপ্লব। ‘আমার খুব ইচ্ছে গোলরক্ষকদের নিয়ে কাজ করার। গোলরক্ষক কোচিং নিয়ে কোনো প্রজেক্ট হলে আমি কাজ করবো’- বলছিলেন বিপ্লব।

ফুটবল তাকে অনেক দিয়েছে উল্লেখ করে বিপ্লব বলেন,‘ফুটবল খেলে যা পেয়েছি অন্য কোনো পেশায় সেটা পেতাম না। দেশের মানুষ আমাকে চিনেন- এর চেয়ে বেশি গর্বের কী হতে পারে? টাকা-পয়সা কোনো বিষয় নয়। ফুটবল আমাকে যা দিয়েছে তা অমূল্য। লম্বা ক্যারিয়ারে অনেক কিছুই থাকতে পারে। তবে আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। ফুটবল ছাড়ছি আমি পূর্ণ তৃপ্তি নিয়েই।’

যার হাত ধরে ফুটবলে এসেছিলেন বিপ্লব তা বলতেও ভুললেন না। তার গুরু লাকসামের তাবারুকুল্লাহ কায়েস। তিনিই বিপ্লবকে জোর করে ফুটবল মাঠে নিয়ে যেতেন। লাকসামের পাইলট স্কুল মাঠে তাবারুকুল্লাহ’র জার্সি ধোয়ার মধ্যে দিয়েই ফুটবলে পরিচিত হয়েছিলেন বিপ্লব। ক্যারিয়ারের ইতি টানার আগে কৈশরের সেই ফুটবলগুরুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেন বিপ্লব ভট্টাচার্য।

আরআই/এসএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।