নেইমারের অভিনয় নাকি কোচ তিতের কৌশল?
তাকে নিয়ে নানা কথা। দুঃখজনক হলেও কঠিন সত্য এই যে, তাকে মানে নেইমারকে নিয়ে এখন বাংলাদেশে নানা কথা। যার বেশিরভাগই তীর্যক, ব্যাঙ্গাত্মক। যার পরতে পরতে বিদ্রুপ ও শ্লেষ মেশানো। সবাই নন। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নেইমারকে রীতিমত খলনায়ক, অভিনেতা, কৌতুকাভিনেতা, ভাঁড় নামে ডাকতে শুরু করছেন।
তার বিপক্ষে অভিযোগ, তিনি মাঠে খেলার চেয়ে অভিনয়ে ব্যস্ত বেশি। এটা সত্য যে, নেইমার ফাউলের শিকার হলে একটু বেশিই ছটফট করেন। কাতরাতে থাকেন। মাটিতে গড়াগড়িও করেন বেশি। এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত। এমন নয়, বিশ্ব ফুটবলে আগে কখনো এমন কাউকে দেখা যায়নি। সাধারনতঃ যারা বেশি ফাউলের শিকার হন, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা যাদের একটু বাড়তি নজরদারিতে রাখেন, কড়া ট্যাকেল করেন- তারাই মাটিতে পড়েন বেশি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্রাজিলের সাথে যাদেরই খেলা হচ্ছে, সব দলের অন্যতম বড় গেম প্ল্যানই থাকছে যে কোন মূল্যে নেইমারকে আটকানো। তাকে অচল বা ‘অফ’ করে দেয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলে যত বড় বড় তারকা আছেন, তাদের সবার মধ্যে নেইমার মাঠে একটু বেশি ছুটোছুটি করেন। তার খেলার ধরনটাই তেমন। যেহেতু মেসি ও রোনালদোর মত পায়ে সুক্ষ্ম কারুকাজ তার কম।
ওই দুজন প্রায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কম দৌড়ে দু’তিনজনের মধ্য থেকে ড্রিবল, ডজ আর শরীরের ঝাঁকুনিতে বেরিয়ে যেতে যতটা দক্ষ, নেইমার ততটা নন। তাকে তাই দৌড়ের ওপর নির্ভর করতে হয় বেশি। তিনি জানেন, মেসি ও রোনালদোর তুলনায় আমার পায়ের কারুকাজ, বলের নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা, ড্রিবলিং, কম জায়গায় প্রতিপক্ষের একাধিক প্লেয়ারকে কাটানোর সামর্থ্যও কম।
তাই নেইমার বলকে এক জায়গায় স্থির রেখে পায়ের কারুকাজে প্রতিপক্ষ মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের কাটানো বা ফাঁকি দেয়ার চেয়ে দৌড়ের ওপর যা কিছু করার চেষ্টা করেন। দৌড় ঝাঁপ- ছুটোছুটি বেশি করেন বলেই নেইমারকে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ কড়া মার্কিংয়ে রাখে। রাফ ট্যাকলও করে বেশি।
এ কারণেই নিজের সেরা ফর্মে না থেকেও এবারের বিশ্বকাপে অন্য সব বড় তারকার চেয়ে বেশি ফাউলের শিকার হয়েছেন নেইমার। বিবিসি স্পোর্টসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, এবারের বিশ্বকাপে নেইমার গত চার ম্যাচে (মেক্সিকোর ম্যাচসহ) ২৩ বার ফাউলের শিকার হয়েছেন। যা সর্বাধিক।
এখন আপনারাই ভাবুন, যিনি সর্বাধিক ফাউলের শিকার, তিনি বেশিবার মাটিতে পড়বেন- সেটাইতো স্বাভাবিক। যেহেতু তার খেলার ধরনটাই বাড়তি রানিংয়ের ওপর, তাই ফাউলের শিকার হয়ে তার মাটিতে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও যে বেশি- এটাও কিন্তু খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সে সব ফুটবলীয় বোধ, উপলব্ধি আর টেকনিক্যাল বিষয়ে চিন্তা না করে এমন একজন ফুটবলারকে অবলীলায় ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে, বিশ্রি ভাষায় তার সমালোচনায় ব্যস্ত কেউ কেউ। তাকে অভিনেতা, জোকার বলতেও দ্বিধা নেই।
নেইমার যদি কোন মানের ফুটবলার না হতেন, কিছু না পারতেন, দলে তার কোন ইমপ্যাক্ট না থাকতো কিংবা তার কোন ব্যক্তিগত অ্যাচিভমেন্ট না থাকতো- তাহলে এমন কথাবার্তা হতো সমর্থনযোগ্য।
কিন্তু তাতো নয়। নেইমার কি আর যে সে ফুটবলার? সন্দেহাতীতভাবেই এ মুহূর্তে লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল পারফরমার, বড় তারকা। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, মুন্সিয়ানা, বল নিয়ন্ত্রণ, ড্রিবলিং, ডজিং, প্লে মেকিং সৃষ্টি ও সৃজনশীলতা এবং চলতি বল, সেট পিস থেকে গোল করার দক্ষতাটা মেসি ও রোনালদোর চেয়ে কম নেইমারের।
তারপরও চপলতা ও ক্ষিপ্রতা এবং বেশিরভাগ সময় বাঁ প্রান্ত দিয়ে তার ছুটোছেুটি, প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগকে ব্যতিব্যস্ত রাখা এবং চকিতে জায়গা তৈলি করে গোলের সুযোগ তৈরি করার পাশাপাশি যে কোন দুরহ কোণ থেকে শট নেয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে নেইমারের। তাই তো মেসি আর রোনালদোর চেয়ে তার বর্তমান বাজার মূল্য বেশি।
বার্সেলোনা থেকে রেকর্ড ২২২ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে নেইমারকে দলে ভিড়িয়েছে ফরাসি ক্লাব পিএসজি। যার প্রতি সপ্তাহের আয় বা বেতন মেসি রোনালদোর চেয়ে বেশি। নেইমারের সাপ্তাহিক বেতন প্রায় সাড়ে সাত লাখ ডলার। মেসি এক সপ্তাহে বার্সেলোনা থেকে পান ৬ লাখ ৬৬ হাজার ডলার। আর রিয়াল মাদ্রিদ প্রতি সপ্তাহে রোনালদোকে দেয় ৩ লাখ ৯৫ হাজার ডলারের মত।
কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল দর্শক, সমর্থকদের একাংশ তাকে নিয়েই ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপে ব্যস্ত। যারা ফুটবলার-পারফরমার নেইমারের মেধা, প্রজ্ঞা না জেনে, না বুঝে শুধু সমালোচনার জন্য সমালোচনা করছেন, তার মাঠে পড়ে কাতরানো, মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া দেখে বিকৃত আনন্দ পাচ্ছেন, কাষ্ট হাসি হাসছেন- তারা কি জানেন পায়ের ইনজুরি কাটিয়ে বিশ্বকাপে মাঠে নেমে নিজের সেরা খেলা না খেলেও এখন পর্যন্ত নেইমারই অন্যতম সফল পারফরমার? অন্তত মেসি-রোনালদোর চেয়ে সেরা।
এবারের আসরে সবচেয়ে বেশি ২৩টি ফাউলের শিকার হয়েছেন নেইমার। যা আর কাউকে করা হয়নি। তার মানে সর্বাধিক ফাউলের শিকার নেইমার। গোল করার উৎস রচনায়ও নেইমারের নাম সবার ওপরে। চার ম্যাচে ১৬টি গোলের উৎসচ রচে দিয়েছেন নেইমার। আর গোল লক্ষ্য করে সবচেয়ে বেশি ২৩টি শট নেয়ার ক্ষেত্রেও নেইমার সবার ওপরে।
তিনি এখন পর্যন্ত গোল লক্ষ্য করে ২৩টি শট নিয়েছেন। যার ১২টির লক্ষ্য ঠিক ছিল। আর এবারের বিশ্বকাপে কোস্টারিকা আর মেক্সিকোর বিপক্ষে একটিসহ মোট দুই গোল করে ফেলেছেন নেইমার। দুই বিশ্বকাপ পুরো হবার আগে এরই মধ্যে তার গোল সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬টি। তারকা খ্যাতিতে তার ওপরে থাকা মেসি আর রোনালদোরও যা নেই। এখন পর্যন্ত চার বিশ্বকাপে মেসির গোল ছয়টি। আর রোনালদো করেছেন সাত গোল।
শুধু ভাব ধরে, অভিনয় ও ভাঁড়ামি করে কখনো মাঠের হিরো হওয়া যায় না। তার প্রমাণ নেইমার। ২৪ ঘণ্টা আগে মেক্সিকোর বিপক্ষে ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিনে’ ব্রাজিলের জয়ের নায়কও এ ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। প্রথমে দলকে এগিয়ে দেয়া আর পরে বাঁ দিকে থেকে বক্সে ঢুকে দ্বিতীয় গোলের উৎস রচনাকারিও নেইমার।
এমন এক কার্যকর পারফরমারের যথাযথ মূল্যায়ন না করে তাকে অভিনেতা, ভাঁড় বলার আগে অবশ্যই চিন্তা করা উচিৎ। আর শেষ কথা, ফুটবল এখন আর শিল্প, নান্দনিকতা, দর্শক বিনোদন নয়। সবার আগে ফুটবল মূলতঃ খেলা। যেখানে শেষ কথা হলো গোল এবং জয়। বর্তমান ফুটবল এবং আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী। যেখানে জয়ই শেষ কথা।
সব দল এবং খেলোয়াড়ের মুল লক্ষ্য হলো জেতা। জিততে একেক দল, একেক কোচ একেকরকম কৌশল আঁটেন। একেক ফর্মেশনে খেলেন; কিন্তু মূল লক্ষ্য এক ও অভিন্ন- গোল করা। গোল না খাওয়া এবং বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়া। এখন খালি চোখে যেটা নেইমারের অভিনয় মনে হচ্ছে, সেটা যে তার ও ব্রাজিল কোচ তিতেরই কোন কৌশল নয়- তাইবা কি করে বলা?
ছোট খাট কিংবা মাঝারী ফাউলের শিকার হয়ে অনেক ফুটবলারই অল্প সময় পর উঠে দাঁড়ান। নেইমার সেই জায়গায় একটু বেশি সময় মাটিতে পড়ে থাকছেন, সেটা সাদা চোখে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। হয়ত তাই নিয়েই কথা-বার্তা বেশি হচ্ছে। তবে সেটা এমনি এমনি নাও হতে পারে।
এখন ফুটবল অনেক বেশি গাণিতিক ও সুক্ষ্ম হিসেব-নিকেশের খেলা। এখানে কোচের লক্ষ্য-পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা ও কৌশলই মূল। নেইমার কেন, মেসি-রোনালদোর ব্যক্তিগত ইচ্ছা, লক্ষ্য-পরিকল্পনা, বোধ-উপলব্ধি আর দর্শনের কোন মূল্য নেই। কোচ যা ভাল মনে করবেন, তাই শুনতে হয় এবং হচ্ছে।
যে ফর্মেশনে খেলতে বলবেন- সেভাবেই খেলতে হয়। হচ্ছে। এখানে কোন ফুটবলারের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য নেই। তিনি যত বড় মাপের ফুটবলারই হোন কেন, মডার্ন ফুটবলে কোচই শেষ কথা। সেখানে ফাউলের শিকার হলে ছটফট করা আর মাঠে বেীশ সময় পড়ে থাকা এবং ফাউল হলেই গলা কাটা মুরগির মত ছটফট করতে থাকার কথা নয়।
কাজেই নেইমার যা করছেন, তা অবশ্যই কোচ তিতের জানা। তার সায় না থাকলে যা কিছুতেই করা সম্ভব হতো না। এমনও হতে পারে, এটাও ব্রাজিল কোচের একটা অন্যরকম কৌশল। নেইমার সবে ইনজুরি থেকে উঠেছেন। এখনো শতভাগ ফিট নন। দম ও এনার্জিতে ঘাটতি থাকতে পারে। ফাউলের শিকার হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকটা খানিক এনার্জি নেয়ার জন্য হতে পারে।
এছাড়া ফাউলের শিকার হয়ে মাটিতে একটু বেশি গড়াগড়ি করলে, কাতরালে রেফারির আনুকুল্য না হলেও বাড়তি মনোযোগ ও মৃদু সহানুভুতি মেলে। যাতে করে রেফারি প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার বা খেলোয়াড়দের হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করে দেন। তাতে পরবর্তীতে তাকে রাফ ট্যাকল করার সম্ভাবনা কমে যাবে। এছাড়া নেইমারের মাটিতে গড়াগড়িকে কেন্দ্র করে খেলা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকছে, তাতে তাৎক্ষনিক নির্দেশনা দেয়ার সুযোগও থাকছে কোচের। তারচেয়ে বড় কথা, খেলার গতিও ক্ষণিকের জন্য কমে যাচ্ছে।
কোচ তিতে আর নেইমার যে এসব ভেবে-চিন্তেই করছেন না- তাই বা কি করে বলা যায়?
এআরবি/আইএইচএস/এমএস