‘দ্বিতীয় রাউন্ড’ কি এবারও দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকবে মেক্সিকোর!
‘বলুন তো, গোটা বিশ্বের শত কোটির বেশি মানুষ এখন কি ভাবছে? দুনিয়াজোড়া কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমির মনে এখন কোন প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে?’ বোদ্ধা, বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। পাড়ার, গলির অবুঝ কিশোর, মোড়ের পান দোকানদার আর অজো পাড়া গায়ের রিকশাচালকও বলে দেবেন , ‘আরে ভাই, সবার চিন্তায় এখন বিশ্বকাপ ফুটবল। ব্রাজিল-মেক্সিকো ম্যাচ।’
সন্দেহতীতভাবে এ মুহূর্তে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে, রাশিয়ার সামারার দিকে। যে শহরে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর উত্তর আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত ফুটবল শক্তি মেক্সিকোর মুখোমুখি হবে ফুটবলের ধ্রুপদি ও নান্দনিক ফুটবলের ধারক-বাহক ব্রাজিল। জল্পনা-কল্পনার ফানুস আকাশে-বাতাসে। আজ কি হবে? অঘটন ও চমকের বিশ্বকাপে তুলনামূলক কম শক্তিগুলোর দাপটের মাঝেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে ব্রাজিল?
নাকি জার্মানি, আর্জেন্টিনা, স্পেন ও পর্তুগালের মতো বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাবে নেইমার, কৌতিনহোদের! স্পেনের মতো তুলনামূলক কম শক্তির রাশিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙে যাবে ব্রাজিলিয়ানদের? নানা হিসাব-নিকাশ। সমীকরণ, পাল্টা সমীকরণ চলছে।
ব্রাজিলের প্লাস পয়েন্ট কি? দুর্বল জায়গাই বা কোথায়? মেক্সিকোর সত্যিকার সামর্থ্য কতটা? মেক্সিকানরা কি ব্রাজিলের সাজানো-গোছানো ও পরিকল্পিত ফুটবলকে অবিন্যস্ত করে সাফল্যের নিড় সাজাতে পারবে?
যদি পারে, তাহলে রচিত হবে এক নতুন ইতিহাস। ৩২ বছর পর আবার সেরা আটে জায়গা হবে মেক্সিকোর। ১৯৮৬ সালে ঘরের মাঠে শেষবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা মেক্সিকানরাও কি ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে নতুন ইতিহাস গড়তে পারবে? নাকি ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিন’ আবারো তাদের দুঃখ হয়েই থাকবে?
হোয়াংহো নদী যদি চীনের দুঃখ হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্বকাপে মেক্সিকোর দুঃখ অনিবার্যভাবেই ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিন।’ মেক্সিকানদের কাছে এই ষোলো দলের লড়াই যেন ‘দুঃস্বপ্ন।’
ইতিহাস জানাচ্ছে সেই ১৯৯৪ থেকে ২০১৪- দুই যুগে হওয়া ছয়-ছয়টি বিশ্বকাপে প্রতিবার ঠিক এই জায়গা, মানে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে এসে ছিটকে পড়েছে মেক্সিকো। অথচ বাছাই পর্বে দাপটের সঙ্গে খেলে সর্বশেষ ছয় বিশ্বকাপের মূল পর্বে প্রতিবারই অংশ নিয়েছে উত্তর আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত ফুটবল শক্তিটি; কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এই দ্বিতীয় পর্বে এসেই আটকা পড়ছে তারা।
৯৪, ৯৮, ২০০২, ২০০৬ , ২০১০ ও ২০১৪- প্রতিবার গ্রুপ পর্বের প্রাচীর টপকে এই রাউন্ড অফ সিক্সটিনে এসে আটকে পড়া এবং সেখান থেকেই বার বার বিদায় নিয়েছে মেক্সিকানরা।
এবার নিয়ে ১৬বার বিশ্বকাপ খেলতে আসা মেক্সিকো কিন্তু উত্তর আমেরিকার সু প্রতিষ্ঠিত ফুটবল শক্তি। বিশ্বকাপের আয়োজক-স্বাগতিকও। দিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ হিসেবে পরিচিত ১৯৮৬’র আসর বসেছিল মেক্সিকোয়; কিন্তু একবারের জন্য সেমিফাইনালে পৌঁছাতে পারেনি এ সবুজ জার্সির দলটি। ফাইনাল বহুদুরে , সেমির যুদ্ধেই অংশ নেয়া সম্ভব হয়নি।
সেরা অর্জন ও সর্বোচ্চ প্রাপ্তি; কোয়ার্টারফাইনাল। সেটাও মোটে দুবার। প্রথমবার ১৯৭০ সালে। তাও নিজেদের মাটিতে। আর দ্বিতীয় তথা শেষবারও ঘরের মাঠে ১৯৮৬তে সেরা আটে ছিল মেক্সিকো। ১৯৭০ সালে সেরা আটের লড়াইয়ে ইতালির কাছে ৪-১ গোলে হেরে সেমিতে খেলার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আর ১৯৮৬ সালে দেশের মাটিতে বুলগেরিয়াকে সেরা ষোলোয় ২-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে জার্মানদের সাথে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
তবে নির্ধারিত ৯০ আর অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সহ ১২০ মিনিট জার্মানদের সাথে সমানতালে লড়েছে মেক্সিকানরা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই গোলশূন্য থাকলে টাইব্রেকারে ফল নিষ্পত্তি ঘটে। পেনাল্টি শ্যুট আউটে ৪-১ গোলে হার মেনে বিশ্বকাপ শেষ করে মেক্সিকো।
মোটকথা দলটি প্রায় প্রতিবার এই ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিনেই’ এসে আটকে আছে। সেই না পারার জায়গায় এবার তাদের প্রতিপক্ষ ব্রাজিল। দেখা যাক, মেক্সিকানরা এবার সে বাধা অতিক্রম করতে পারে কিনা?
ওদিকে ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, ব্রাজিল এর আগে মাত্র দু’বার ঠিক এই জায়গায় বিশ্বকাপ শেষ করেছে। এই সেরা ষোলো দলের লড়াইয়ে ব্রাজিলিয়ানদের প্রথম হার ১৯৮২ সালে। তখন অবশ্য এই পর্বটা নক আউট ছিল না। ওই সময় প্রথম পর্ব মানে গ্রুপের খেলা শেষে আবার আরও একটি গ্রুপ পর্বের লড়াই হতো। সেখানে অংশ নিত তিনটি করে দল।
১৯৮২ সালে সেই দ্বিতীয় গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে হারিয়েও দ্বিতীয় ম্যাচে পাওলো রোসির অবিস্মরণীয় নৈপুণ্যের কাছে ৩-২ গোলে হার মানা ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তবে এখনকার মত প্রথাগত ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিনে’ ব্রাজিল শেষবার থেমে গিয়েছিল ১৯৯০ সালে। গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচে শতভাগ সাফল্য দেখানো ব্রাজিল সুইডেনকে ২-১, কোস্টারিকা ১-০ আর স্কটল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার কাছে ১-০ গোলে হার মানে ব্রাজিল।
২৪ জুন ইতালির তুরিনের দেলে আলপি স্টেডিয়ামে ৬১ হাজার ৩৮১ জন দর্শকের সামনে শেষ বাঁশি বাজার ৯ মিনিট আগে ব্রাজিল ভক্তদের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেন আর্জেনটাইন স্ট্রাইকার ক্লদিও ক্যানিজিয়া। ব্রাজিল গোলরক্ষক তাফারেলকে কাটিয়ে ফাঁকা পোস্টে বাঁ-পায়ের শটে ক্যানিজিয়া বলকে জালে পাঠান।
তবে গোলটির উৎস রচে দেন ম্যারাডোনা। মাঠের মাঝখানের বৃত্তের ভিতরে বল পেয়ে প্রথমে পায়ের কাজে একাধিক ব্রাজিল মিডফিল্ডারকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যান ম্যারাডোনা। পায়ের কাজ ও শরীরের ঝাঁকুনির সাথে যোগ হয় চিতা বাঘের ক্ষিপ্রতা। মাঝে একাধিক ব্রাজিলিয়ানের চেষ্টা ব্যর্থ হয় ম্যারাডোনার প্রচন্ড গতির কাছে।
চার ব্রাজিলিয়ানের মাঝ থেকে বল নিয়ে ঠিক ব্রাজিল বক্সের বাইরে খানিক ডান দিক ঘেঁষে ডান পায়ে কিছুটা বাঁকানো থ্রু ঠেলে দেন ম্যারাডোনা। তার সেই বাঁকানো বল ব্রাজিলের দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের নাগালের বাইরে দিয়ে চলে যায় ছুটে আসা ক্যানিজিয়ার কাছে। অল্প দু’পা এগিয়ে সেই বল পায়ে নিয়ে আগুয়ান ব্রাজিল গোলকিপার তাফারেলকে কাটিয়ে কিছুটা বাঁদিক ঘেঁষে বক্সে ঢুকে প্লেসিং করেন ক্যানিজিয়া।
বিশ্বজোড়া কোটি ব্রাজিল সমর্থকের বুকে ‘শেলের’ মত বিধে সেই বল পৌঁছে যায় জালে। ইতিহাস জানাচ্ছে, সেই শেষবার সেরা ষোলো দলের লড়াই থেকে ছিটকে পড়েছিল ব্রাজিল। তারপর এক যুগে টানা বিশ্বকাপের ১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০২’র ফাইনাল খেললো ব্রাজিলিয়ানরা।
২০০৬ এবং ২০১০ (ফ্রান্সের কাছে ১ -০ গোলে হার) আর ২০১০ সালে (নেদারল্যান্ডসের কাছে ১-২ গোলে পরাজয়) সালে পরপর দুবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সেমির যুদ্ধে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে শোচনীয়ভাবে হেরে বিদায় নেয় সেলেসাওরা।
সবাই ২০১৪ সালের ওই ম্যাচে ব্রাজিলিয়ানদের ন্যাক্কারজনক পারফরমেন্স, চরমভাবে পর্যদুস্ত হওয়া, আর করুন পরিণতির কথাই বেশি মনে রেখেছেন। অনেকের হয়ত মনেই নেই ২০১৪ সালেও মেক্সিকোর সাথে বিশ্বকাপের মাঠে দেখা হয়েছিল ব্রাজিলের।
নিজ মাটিতে গ্রুপ পর্বের ওই ম্যাচে ব্রাজিল হারাতে পারেনি মেক্সিকোকে। ঘরের মাঠে গ্রুপ পর্বে ইউরোপের ক্রোয়েশিয়াকে ৩-১ আর আফ্রিকার কামেরুনকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিলেও উত্তর আমেরিকার লড়াকু দল মেক্সিকোর জালে বল পাঠাতে পারেননি ব্রাজিলিয়ানরা। খেলাটি গোলশূন্য ড্র’থেকে যায়।
চার বছর পর এবার আর গ্রুপ ম্যাচে নয়, নক আউট পর্বে দেখা সেই দু’দলের। চার বছর আগে ৯০ মিনিটের লড়াই গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয়েছিল। তবে এবার যেহেতু নকআউট স্টেজে। তাই এবার আর ড্র হবার সুযোগ নেই। নির্ধারিত ৯০ আর অতিরিক্ত ৩০ সহ ১২০ মিনিটের লড়াই ড্র থাকলেও জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবেই। তখন হয়ত টাইব্রেকারে ফল নিষ্পত্তি ঘটবে। দেখা যাক কি হয় এবার!
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি