আজ ব্রাজিল হারলেই শেষ বাঙালির বিশ্বকাপ উন্মাদনা
চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, দর্শক নন্দিত ও প্রবল জনপ্রিয় আর্জেন্টিনা, ধ্রুপদি ফুটবলের ধারক স্পেন-পর্তুগাল বিদায় নিয়েছে। ৮০ বছরের রেকর্ড ভেঙে জার্মানরা বাদ পড়েছে গ্রুপ পর্ব থেকেই। আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল আর স্পেনের বিদায় ঘণ্টা বাজলো রাউন্ড অফ সিক্সটিনে।
সম্ভাব্য ফেবারিটরা একের পর এক ছিটকে পড়ছে। অনেকেই বলছেন, ‘এটা অঘটনের বিশ্বকাপ’, ‘চমকের বিশ্বকাপ’। ফেবারিটদের আগে ভাগেই ছিটকে পড়ার আসর। সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে যে হাতে গোনা কটি দলের কথা ভাবা হয়েছিল, সেই তালিকা ক্রমেই ছোট হচ্ছে। ‘হট ফেবারিটের’ তকমা নিয়ে আসা দলগুলোর মধ্যে টিকে আছে কেবল ব্রাজিল। ব্রাজিল কি থাকবে? নাকি জার্মানি, আর্জেন্টিনা, স্পেন ও পর্তুগালের পথে হেঁটে বিদায় নেবে?
বিশ্ব ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র-তারাগুলোও খসে পড়ছে। সময়ের সেরা ফুটবলার ও দর্শক অনুরাগিদের প্রথম পছন্দ লিওনেল মেসি, ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চৌকশ খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর সৃষ্টি ও সৃজনশীলতায় অনন্য আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে। বড় তারাগুলোর মধ্যে জ্বলছেন শুধু নেইমার। এ ব্রাজিলিয়ান তারকা কি নৈপুন্যের দ্যুতিতে আরও মাঠ মাতাতে পারবেন, নাকি আজ রাতেই নিভে যাবে নেইমার নামক ‘ফুটবল প্রদীপ’? নানা কৌতূহলি প্রশ্ন সবার মনে। রাজ্যের জল্পনা-কল্পনা চারিদিকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আনুপাতিক হারে কম হলেও বাংলাদেশে জার্মানি ও ইতালির (এবারের বিশ্বকাপে নেই তারপরও) ভক্ত ও সমর্থক আছে। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবল নিয়মিত দেখা বর্তমান প্রজন্মর কেউ কেউ স্পেন, পর্তুগাল ও ফ্রান্সকেও সাপোর্ট করেন।
কিন্তু বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমি ও অনুরাগিদের বড় তথা মূল অংশর প্রিয় দল আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। কোটি কোটি ফুটবল পাগল বাঙালি আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলকেই নিজের দল ভাবেন। এদেশের ফুটবল ভক্তর প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগই ওই দুই দলের অন্তঃপ্রাণ বা অন্ধ সমর্থক। তাদের কাছে বিশ্বকাপ মানেই আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। তাই তো বিশ্বকাপ শুরুর দুই মাস আগে থেকেই ওই দুই দেশের পতাকায় ছেয়ে গেছে দেশ।
রাস্তায় রাস্তায় পতাকা বিক্রির হিড়িক। বাড়ি, অফিসের ছাদ আর গাছের ‘মগডাল ’ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায় সয়লাব। চার বছর পর পর বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশের মানুষ মূলতঃ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সেই দুই দলের মধ্যে আবার বর্তমান প্রজন্মর প্রথম পছন্দ সাদা-আকাশি জার্সির আর্জেন্টিনা।
কিশোর, যুবা, তরুণ ও মাঝ বয়সী ফুটবল অনুরাগির প্রায় ৬০ শতাংশ মেসির আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। ফুটবল সম্রাট পেলের খেলা সরাসরি না দেখলেও ৭০ ও ৮০ ‘র দশকে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমি ও অনুরাগিদের প্রায় ৭৫ ভাগ ছিল ব্রাজিল সাপোর্টার। ১৯৫৮ , ১৯৬২ ও ১৯৭০ ‘র বিশ্বকাপ বিজয়ী ব্রাজিলের চিরায়ত ছন্দময় ফুটবলের ঢেউ এসে লেগেছিল বাংলাদেশেও। তাই এক সময় এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রিয় দল ছিল ব্রাজিল। কিন্তু ম্যারাডোনার জাদুকরি উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট।
সক্রেটিস ও জিকোরা ৮২ এবং ৮৬‘তে পর পর দুবার ব্যর্থ হন। আর ওই সময়েই উল্কার বেগে আবির্ভাব ডিয়াগো ম্যারাডোনার। ৮৬‘তে ব্রাজিল, ফ্রান্সকে পিছনে ফেলে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ বিজয় এবং ম্যারাডোনার অসাধারণ ফুটবল শৈলিতে মুগ্ধ ও সম্মোহিত বাঙালি। এরপর লিওনেল মেসির নৈপুন্যও এদেশের ফুটবলপ্রেমিদের মন কেড়ে নিয়েছে। তাই বাংলাদেশে এখন আর্জেন্টাইন সাপোর্টারই বেশি।
রাস্তা-ঘাটে, অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রেস্তোরাঁ আর পাড়া ও গলির আড্ডায় মেসি ভক্তর আধিক্য। মানে আর্জেন্টিনার ভক্তসংখ্যা চোখে পড়ে বেশি।
সেই দল বিশ্বকাপে নেই। রাউন্ড অফ সিক্সটিন থেকে বিদায় নিয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগির বড় অংশর বিশ্বকাপ উন্মাদনা বেশ কমে গেছে। তাদের কাছে এবারের বিশ্বকাপের আকর্ষণও হয়ে পড়েছে ফিকে। বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি ফুটবল প্রেমির বিশ্বকাপ উৎসাহেই ভাটা পড়েছে।
তবে প্রায় ৪০ শতাংশ ফুটবল ভক্তর প্রাণের দল ব্রাজিল এখনো দৌড়ে টিকে আছে। হলুদ জার্সির ব্রাজিল শিরোপা লড়াইয়ে টিকে থাকবে কি-না, তা আজ রাতেই জানা যাবে। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে সোমবার রাতে মেক্সিকোর মুখোমুখি ব্রাজিল।
নেইমারের দল জিতে গেলে বাঙালির বিশ্বকাপ উত্তেজনা উত্তেজনা, রোমাঞ্চ থাকবে। আর ব্রাজিল হারার অর্থ বাংলাদেশে বিশ্বকাপের আকর্ষণ প্রায় ফিকে হয়ে যাওয়া। মানে আকর্ষণ প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকা।
ফুটবল আর আবেগ খুব কাছাকাছি। আর বাঙালিও আবেগপ্রবণ জাতি। তাই ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির সখ্য, প্রেম দীর্ঘ দিনের। তাই প্রিয় দলের খেলা টানে এদেশের ফুটবল প্রেমিদের। তারা কাজকর্ম ফেলে টিভির সামনে বসে পড়েন খেলা দেখতে।
সেই ১৪ জুন বিশ্বকাপ শুরুর পর সন্ধ্যা ও রাতে সারা দেশে রাস্তা ঘাটে কোলাহল কমেছে অনেক। যত কথা ফুটবল নিয়ে। আর্জেন্টিনা বিদায় নেবার পর সে ফুটবল নিয়ে কথাবার্তা কমেছে।
এখন সবার দৃষ্টি আসলে ব্রাজিলের দিকে। আগের বার জার্মানির কাছে সেমির যুদ্ধে বিধ্বস্ত (৭-১ গোলের ন্যাক্কারজনক হার ) ব্রাজিল সমর্থকরা এবার একবুক আশা নিয়ে বসে আছেন। তাদের মনে স্বপ্ন। অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, এবার কিছু একটা হবে। আর আর্জেন্টিনা, জার্মান ও স্পেন, পর্তুগালের সমর্থকরা প্রিয় দলের বিদায়ে হতাশ। সেই সাথে ব্রাজিলের পরিণতি দেখতেও মুখিয়ে।
তারা মনে মনে চাচ্ছেন ব্রাজিলও আমাদের প্রিয় দলের পথে হেঁটে বিদায় নিক। তাহলে ‘মাইনাসে মাইনাসে প্লাস’ হয়ে যাবে। মানে ভাবটা এমন-আর্জেন্টিনাও পারেনি। ব্রাজিলও পারবে না।
অন্যদিকে ব্রাজিল সমর্থকদের ভাবনা ভিন্ন। তাদের আশা, এবার নেইমারের হাতে উঠবে বিশ্বকাপ। মেসি-রোনালদো পারেননি, তাতে কি নেইমার পারবেন, এমন আশায় উন্মুখ অগণিত ব্রাজিল সমর্থক।
সমর্থকরা যেমনই ভাবুন না কেন, কঠিন সত্য হলো এবার জার্মানি মোটেই ভাল খেলেনি। আর্জেন্টিনা, স্পেন আর পর্তুগালের খেলাও ঠিক ‘চ্যাম্পিয়নদের’ মত হয়নি।
ব্রাজিল এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নদের মতো খেলেছে, তাও নয়। তারপরও সব বড় বড় বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞদের মত, ঐ চার দলের তুলনায় ব্রাজিল গোছানো ও সুবিন্যস্ত দল। তাদের ফাঁক-ফোকর কম।
এখন দেখা যাক, কী হয়। জার্মানি, আর্জেন্টিনা, স্পেন ও পর্তুগালের পথ ধরে সেরা আটের লড়াই শুরুর আগেই বিদায় নেবে ব্রাজিলও? নাকি মেক্সিকোর বাধা টপকে হেক্সার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে নেইমারদের দল?
এআরবি/এমএমআর/আরআইপি