২০০৬ : ইতালির জার্মানি জয়
ফিফার বিশ্বায়নের নীতির কারণে ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে ঘুরতে শুরু করেছিল বিশ্বকাপের আসর। ২০০২ জাপান-কোরিয়ার পর আবার বিশ্বকাপ ফিরে এল ইউরোপে। এবার ১৮তম সংস্করণ অনুষ্ঠিত হলো জার্মানিতে। ১৯৭৪ সালের পর আবার জার্মানি বিশ্বকাপ আয়োজন করা দায়িত্ব পেলো। আগেরবার ছিল শুধু পশ্চিম জার্মানি। এবার একত্রিত জার্মানিই আয়োজক। ফ্রান্সকে হারিয়ে চতুর্থবারেরমত বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নিল ইতালি। ব্রাজিলের চেয়ে একটি কম, ৪টি শিরোপা জিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে গেলো আজ্জুরিরা।
ফুটবল ইতিহাসে যে ক’জন গ্রেট ফুটবলারের আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম জিনেদিন জিদান। ২০০২ বিশ্বকাপে সেনেগালের সঙ্গে হোঁচট খাওয়ার পর একটি দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ শেষ করেছিল ফ্রান্স। পরের বিশ্বকাপেই জিদানের অসাধারণ ফুটবলশৈলীর কল্যাণে ফাইনালে উঠে আসে ১৯৯৮ চ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু টাইব্রেকার নামক ভাগ্য পরীক্ষায় ইতালির কাছে হেরে শিরোপাবঞ্চিত থাকতে হয়েছে ফ্রান্সকে।
বার্লিনের অলিম্পিয়াস্টেডিওনে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ইতালির শিরোপা জয়ের চেয়ে বড় হয়ে গিয়েছিল জিদানের সেই বিখ্যাত হেড বাটের ঘটনা। নির্ধারিত ৯০ মিনিট ১-১ গোলে সমতায় থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় খেলা; কিন্তু ১০৯ মিনিটেই ঘটে গেল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনাটি।
ইতালিয়ান ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জির বাজে কথায় প্রভাবিত হয়ে জিদান তার বুকে মাথা দিয়ে গুঁতো মারেন। মাতেরাজ্জি সঙ্গে সঙ্গেই চিৎপটাং। পড়ে যান মাঠে। রেফারি হোরাসিও এলিজোন্ডো লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বহিষ্কার করে দেন জিদানকে। এ ঘটনার ফলেই চতুর্থ শিরোপার দুয়ার খুলে যায় ইতালির সামনে।
ওই বিশ্বকাপে সাতটি নতুন দেশ অংশ নেয়। আফ্রিকার চারটি- অ্যাঙ্গোলা, আইভরি কোস্ট, ঘানা ও টোগো; ইউরোপের দুটি- চেক রিপাবলিক ও ইউক্রেন। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো। আফ্রিকান দুই সেরা দল ক্যামেরুন এবং নাইজেরিয়া ওই বিশ্বকাপে ঠাঁই’ই করে নিতে পারেনি। ১৯৮টি দেশ অংশ নেয় বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে। যুগোস্লাভিয়া ভেঙে সার্বিয়া মন্টেনেগ্রো এবারই প্রথম অংশ নেয় বিশ্বকাপে। জার্মানি বিশ্বকাপে ফাইনালেই শুধু টিভিতে খেলা দেখে ৭১৫.১ মিলিয়ন দর্শক। আর টুর্নামেন্টজুড়ে টিভিতে খেলা দেখে ২৬০ কোটি ৯০ লাখ দর্শক।
এ বিশ্বকাপে ফিরে এসেছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের স্মৃতি। সক্রেটিস, জিকো, ক্যারেকাদের ব্রাজিল আর মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্স সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল। সক্রেটিস, জিকোদের পেনাল্টি শট মিসে টাইব্রেকারে হেরে যায় ব্রাজিল। ওই দিন পেনাল্টি শট মিস করেছিলেন মিশেল প্লাতিনিও।
২০০৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও রোনালদিনহো, রোনালদো, কাকা, কাফুর ব্রাজিলকে একা হারিয়ে দিলেন জিনেদিন জিদান। জিদানের সেই অসাধারণ পারফরম্যান্স এখনও চোখে লেগে আছে ফুটবলপ্রেমীদের।
দ্বিতীয় রাউন্ডে ঘানার বিরুদ্ধে গোল করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে গার্ড মুলারের ১৪ গোলের রেকর্ড ভেঙে সর্বাধিক ১৫ গোলের রেকর্ড গড়েন রোনালদো। ওই ম্যাচেই আদ্রিয়ানো গোল করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে ব্রাজিলের ২০০তম গোল পূর্ণ করেন। ওই বিশ্বকাপেই সবচেয়ে বেশি ৩৬০টি হলুদ কার্ড আর ২৮টি লাল কার্ডের ব্যবহার হয়।
রাশিয়ান রেফারি ভ্যালেন্টিন ইভানভ পর্তুগাল-হল্যান্ড ম্যচেই ৪টি লাল কার্ড আর ১৬টি হলুদ কার্ডের ব্যবহার করেন। সুইজারল্যান্ড কোনো গোল হজম না করেই ঠাঁই করে নেয় দ্বিতীয় রাউন্ডে। তবে ইউক্রেনের কাছে পেনাল্টিতে হেরে বিদায় নেয়।
জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা আগের বিশ্বকাপের মতো ওই বিশ্বকাপেও পাঁচটি গোল করে জিতে নেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের কাছে গোলশূন্য ড্র হওয়ার পর পেনাল্টিতে শিরোপা স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় ইংল্যান্ডের। আগের বিশ্বকাপের মতো তেমন বড় কোনো অঘটন ঘটেনি ওই বিশ্বকাপে।
ফেভারিটরাই প্রভাব বিস্তার করে খেলে। ফাইনালে ফ্রান্স আর ইতালির খেলায় ৭ মিনিটেই পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। কিন্তু ১৯ মিনিটে সেটি শোধ করে দেন মাতেরাজ্জি। এরপর অতিরিক্ত সময় এবং টাইব্রেকার। ডেভিড ত্রেজেগের টাইব্রেকার গোল মিসের কারণেই শিরোপা চলে যায় ইতালিতে।
আইএইচএস/আরআইপি