১৯৭৮ : কেম্পেসের হাত ধরে প্রথম শিরোপা আর্জেন্টিনার

ইমাম হোসাইন সোহেল
ইমাম হোসাইন সোহেল ইমাম হোসাইন সোহেল
প্রকাশিত: ০৮:৫৩ পিএম, ২৪ মে ২০১৮

১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ থেকেই আয়োজক হওয়ার অন্যতম দাবিদার আর্জেন্টিনা। অংশ নিতে থাকে সবগুলো নিলামেই। এমনকি বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচন না করায় ১৯৩৮ সালের তৃতীয় আসরে অংশগ্রহণই করেনি তারা।

অবশেষে ৪৮ বছর পর, ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপের ১১তম আসরে এসে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের আয়োজক হওয়ার দায়িত্ব পায় আর্জেন্টিনা। শুধু আয়োজক হওয়াই নয়, স্বাগতিক হয়েই প্রথম শিরোপার স্বাদ পেল লাতিন আমেরিকার ফুটবল পাওয়ার হাউজ দেশটি। তবে আর্জেন্টিনার প্রথম শিরোপা জয়ের গায়ে লেগে রইল কয়েকটি কলঙ্কের দাগ।

বিশ্বকাপ শুরুর দুই বছর আগেই সামরিক অভ্যুত্থানে আর্জেন্টিনার ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। বিশ্বকাপের মাত্র এক বছর আগে মিডিয়ায় সংবাদ বের হয়, ৫৬১৮ ব্যক্তি নিখোঁজ। পরে জানা গেলো, বিরোধীদের গ্রেফতার করে নিয়ে কনেসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছেআর্জেন্টিনার সামরিক সরকার।

নোংরা যুদ্ধ ছাপিয়ে দিয়ে চরমভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘণ ঘটানোর কারণে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয় ইউরোপের বেশ কিছু দেশ। তবে শেষ পর্যন্ত সামরিক জান্তার কূটনীতির কারণে কোনো দেশই তাদের বিশ্বকাপ বয়কটের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি।

যদিও নেদারল্যান্ডসের ইয়োহান ক্রুয়েফ অংশ নেননি বিশ্বকাপে। কিডন্যাপের হুমকির কারণে ভয়ে স্ত্রীর কাছে বিশ্বকাপ খেলতে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি। জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারও অংশ নেননি এই বিশ্বকাপে।

1978-FIFA-World-Cup

তবুও ১৯৩৬ বার্লিণ অলিম্পিক এবং ১৯৩৪ ফিফা বিশ্বকাপে এডলফ হিটলার এবং বেনিতো মুসোলিনির মতো করেই বিশ্বকাপে রাজনৈতিকভাবে অবৈধ হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১৯৭৮ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে। অভিযোগ রয়েছে, আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তার কারণে অনেক অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করেছিল আর্জেন্টিনা।

ইংল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বাছাই পর্বও ডিঙাতে পারেনি। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর আবারও এই আসরে সুযোগ পেল ফ্রান্স, স্পেন এবং হাঙ্গেরি। ইরান আর তিউনিসিয়া প্রথমবারের মতো অংশ নেয় ১৯৭৮ বিশ্বকাপে। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা থেকে উরুগুয়েকে বাছাই পর্বে বিদায় করে দিয়েই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয় বলিভিয়া। ১৯৫৮ সালের পর প্রথম সুযোগ পায় অস্ট্রিয়া। আগের আসর মিস করার পর এই বিশ্বকাপে ফিরে আসে পেরু এবয় মেক্সিকো।

গ্রুপ পর্বেই বিশাল বিতর্কের জন্ম দেয় আর্জেন্টিনা। বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রতিটি ম্যাচের সূচি তারা ঠিক করে রাতের। এর সুবিধা নিয়ে প্রথম পর্ব পার হয় স্বাগতিকরা। কারণ, গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মাঠে নামার আগেই আর্জেন্টিনা জেনে গিয়েছিল গ্রুপের কোথায় দাঁড়িয়ে তারা।

এই বিতর্কের কারণে ফিফা পরের (১৯৮২) বিশ্বকাপ থেকেই এ নিয়ম পরিবর্তন করে দেয়। নিয়ম করা হয়, গ্রুপ পর্বে শেষ দুটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে একই সময়ে। যাতে, কে কোথায় দাঁড়িয়ে এ বিষয়টা আগে থেকে নির্ধারিত না থাকে এবং যাতে পাতানো খেলার কোনো ঘটনা না ঘটে।

১৯৭৮ বিশ্বকাপ ছিল ১৬ দলের সর্বশেষ বিশ্বকাফ। ১৯৮২ সাল থেকেই বিশ্বকাপের দল বাড়িয়ে করা হয় ২৪টি। ৭৮ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা আটটি দলকে ভাগ করা হয় দুই গ্রুপে। এরপর রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা। দুই গ্রুপের সেরা দুটি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ফাইনাল। দ্বিতীয় রাউন্ডে একই গ্রুপে মুখোমুখি হয় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হওয়ার ফলে আর্জেন্টিনার ফাইনালে উঠতে সমীকরণ দাঁড়ায়, শেষ ম্যাচে পেরুর বিরুদ্ধে তাদেরকে জয় পেতে হবে অন্তত ৪-০ গোলে।

কিন্তু ৪-০ নয়, আর্জেন্টিনা জয় পেলো ৬-০ গোলে। এই ম্যাচটি ঘিরেই মূলতঃ বিতর্ক মাথাছাড়া দিয়ে ওঠে। টেলিভিশন কমেন্টেটররা এটাকে পাতানো ম্যাচ বলেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। অভিযোগ ওঠে, আর্জেন্টিনার মিলিটারি সরকার পেরুর এই ব্যবধানে হারের পেছনে বিশাল ভুমিকা রাখেন।

1978-FIFA-World-Cup

ব্রাজিলিয়ান মিডিয়াগুলো তো হামলে পড়েন পেরুর ফুটবলার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করতে। কারণ, পেরুর ব্যাংক পরিচালনা করতো আর্জেন্টিনা সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং অভিযোগ রয়েছে, রাতারাতি পেরুর ফুটবলারদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। আবার পেরুর বামপন্থি নেতারা দাবি করেন, বিশ্বকাপে এই ম্যাচে হারের কারণে আর্জেন্টিনায় বন্দিথাকা ১৩জন বিদ্রোহীকে পেরুর হাতে তুলে দিয়েছিল আর্জেন্টাইন সরকার।

আরও একটি অভিযোগের পালে বেশ বাতাস লেগেছিল। পেরুর গোলরক্ষক রোমান কুইরোগার জন্ম আর্জেন্টিনায়। এ কারণে ওই ম্যাচটি নিয়ে সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। পেরু ফুটবল কর্তৃপক্ষকে আর্জেন্টাইনরা ৫০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছিল। তবে এ অভিযোগ ধোপে টেকেনি।

অন্যদিকে একটি ম্যাচও না হেরে ফাইনালে উঠতে পারল না ব্রাজিল। আবার বুয়েন্স আয়ার্স শহর থেকে দুরে রিভারপ্লেটের হোম ভেন্যু এস্টাডিও মনুমেন্টালে অনুষ্ঠিত ফাইনালে হারের পর পোস্ট ম্যাচেই যোগ দেয়নি রানার্সআপ নেদারল্যান্ডস।

তাদের অভিযোগ, ফাইনাল শুরুর আগেই স্বাগতিকরা নাকি তাদের কৌশলপত্র চুরি করেছিল। ব্রাজিল-সুইডেনের ম্যাচটাও রেফারি ক্লাইভ থমাসের কারণে বিতর্কিত হয়ে রইল। শেষ মিনিটে কর্নার কিক থেকে ভেসে আসা বলে হেড করে গোল করেছিলেন জিকো। কিন্তু গোলটি আর টিকলো না। কারণ, কর্ণার কিকের বলটি বাতাসে থাকতেই রেফারি খেলা সমাপ্তির বাঁশি বাজিয়ে দেন। যে কারণে ম্যাচটা শেষ হয় ১-১ গোলে।

1978-FIFA-World-Cup

এই বিশ্বকাপেই প্রথম টাইব্রেকারের নিয়ম চালু করা হয়। তবে এ নিয়মের প্রথম প্রয়োগ ঘটে ১৯৮২-এর স্পেন বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্স আর পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার ম্যাচে। প্রথম পর্বে ‘বি’ গ্রুপে পশ্চিম জার্মানিকে পেছনে ফেলে পোল্যান্ডই হয়ে যায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। মেক্সিকোকে ৩-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে জয় পাওয়ার রেকর্ড গড়ে তিউনিসিয়া।

‘এ’ গ্রুপে ইতালির কাছে ১-০ গোলে হেরেও আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় দল হিসেবে উঠে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। বিশ্বব্যাপী সেবারই প্রথম রঙিন টিভিতে খেলা দেখানো শুরু হয়। উরুগুয়ে-ফ্রান্স ম্যাচে ফ্রান্সের জার্সি সাদা-কালো হওয়ায় টিভি সম্প্রচারে অসুবিধা হয়। এ কারণে ফ্রান্স খেলে অ্যাটলেটিকো কিম্বারলির ক্লাব মার ডেল প্লাটার সবুজের ওপর সাদা স্ট্রিপ দেওয়া জার্সি পরে।

বিশ্বকাপে নিজ দেশের জার্সি না পরে খেলার এটাই একমাত্র ঘটনা। বিতর্কিতভাবে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে ফাইনালে আসার পর ক্যাম্পেসের জোড়া গোলেই ৩-১ গোলে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় আর্জেন্টাইনরা। পরপর দ্বিতীয়বার ফাইনালে এসেও শিরোপার স্বাদ পেল না ডাচরা।

এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ সিজার লুইস মেনোত্তিও কম সমালোচনার শিকার হননি। কারণ, চারদিক থেকে তুমুল চাপ সত্ত্বেও ১৭ বছরের দিয়েগো ম্যারাডোনাকে দলেই রাখেননি তিনি। মেনোত্তির যুক্তি ছিল, ম্যারাডোনা দারুণ প্রতিভাবান সত্যি; কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচের চাপ সামলে নেয়ার মত বয়স তখনও তার হয়নি।

আইএইচএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।