দুই যুগ পরও ভুলের রাজ্যেই বসবাস
শেষ দায়টা ক্রিকেটারদের ওপরই চাপালেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। টাইগার হেড কোচ মনে করেন, আসলে মানসিকতায় নয়, সমস্যা প্রয়োগে।
ম্যাচের শেষ দিন সকালে প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান মুমিনুল হক আর অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর যথাক্রমে সুইপ ও রিভার্স সুইপ খেলে আউট হওয়াটাকেও তার কাছে আত্মঘাতী শট মনে হয় না। এ লঙ্কান কোচের উপলব্ধি ও অনুভব, যদি কোনো ব্যাটার মনে করে সে সুইপ ও রিভার্স খেলে রান করবে, তাহলে সমস্যা কোথায়?
বলার অপেক্ষা রাখে না, গতকাল সোমবার কানপুর টেস্টের চতুর্থ দিন ভারতীয় অফস্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বলে সুইপ খেলেই বেশ কিছু স্কোরিং শটের দেখা পেয়েছেন বাঁহাতি মুমিনুল হক।
তাই আজ মঙ্গলবার অশ্বিনকে সুইপ করতে যাওয়ায় ভুল কিছু দেখছেন না টাইগার কোচ। হাথুরু মনে করছেন, প্রথম ইনিংসে এই সুইপ খেলে যদি অশ্বিনের লাইন খানিক নষ্ট করে দিয়ে সেঞ্চুরি পাওয়া যায়, তবে শেষ দিন সুইপ করতে যাওয়া আত্মঘাতী হবে কেন?
আসলেই কি তাই? আজ মঙ্গলবার টেস্টের শেষ দিন কি অফস্পিনার অশ্বিনের বলে সুইপ খেলেই রান করা খুব জরুরি ছিল মুমিনুলের? কিংবা বাঁহাতি রবীন্দ্র জাদেজার দ্বিতীয় বলে রিভার্স সুইপ না হাঁকালেই কি চলতো না অধিনায়ক শান্তর?
ধরা যাক, ওই দুটি শটই পারফেক্ট হতো, বাংলাদেশ আর দুটি বাউন্ডারি পেত। তাতে স্কোরবোর্ডে ৮ রান যোগ হতো। তাহলে কী হতো? বাংলাদেশ জিতে যেত?
আজ বাংলাদেশের ব্যাটারদের কাজ ছিল, ধৈর্য ধরে বলের মেধা ও গুণ বিচার করে যতটা সময় সম্ভব উইকেটে থাকা। সারা দিন ব্যাট করতে পারলে কৃতিত্বের সাথে ড্র করা যেত।
চা বিরতির ঘণ্টাখানেক পর অবধি উইকেটে কাটিয়ে দিতে পারলেও হয়তো হারতে হতো না। তখন ভারতের সামনে যে টার্গেট দাঁড়াতো, সেটা এক ঘণ্টায় করে ফেলা হয়তো সম্ভব হতো না। কারন বাংলাদেশ আজ ৫ ঘণ্টা ব্যাট করতে পারলে ২০০ থেকে ২২০ রান করতো। তাতে করে ৫২ রানের ঘাটতি কাটিয়ে লিড দাঁড়াতো ১৭০ রানের ওপরে। শেষ ঘণ্টায় ১৪-১৫ ওভারে ওই রান করা কঠিন। তাতেই শুধু ম্যাচ বাঁচানোর সম্ভাবনা থাকতো।
কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটারদের ব্যাটিং দেখে একবারও মনে হয়নি, তারা কেউ ধৈর্য ধরে লম্বা সময় নিয়ে উইকেটে থাকার চেষ্টা করেছেন। ম্যাচের পরিবেশ, পরিস্থিতি, উইকেট আর ভারতের বোলারদের বোলিং- কোনোটার দিকেই কারো নজর ছিল না।
তা থাকলে কি সকালে খেলা শুরুর অল্প কয়েক মিনিট পর দুই দুজন সুইপ ও রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে উইকেট বিসর্জন দেন? লেগ স্লিপে একজন ফিল্ডার ওঁৎ পেতে আছেন, ভুলের ফাঁদে ফেলতেই লোকেশ রাহুলকে দাঁড় করানো হয়েছে সেখানে। তা দেখেও কেন কী কারনে মুমিনুল অফস্পিনার অশ্বিনকে সুইপ করতে গেলেন?
বাঁহাতি স্পিনার জাদেজা বোলিং শুরু করতেই তাকে তেড়েফুড়ে রিভার্স সুইপ করে বাউন্ডারি হাঁকানোর চেষ্টাইবা কেন শান্তর? সারা দিন সে প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিটি বাংলাদেশ সমর্থকের মনে। ওই দুটি অপ্রয়োজনীয় শটই বলে দিয়েছে, বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের কোনো সঠিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ছিল না।
থাকবে কী করে? টিম বাংলাদেশ ম্যানেজমেন্টেরও পরিকল্পনায় ছিল না কোন দূরদর্শিতা। স্বাগতিক ভারত তাদের একাদশে কোনো রদবদল না করে ৩ পেসারের সাথে ২ স্পিনার নিয়েই মাঠে নামলো। আর বাংলাদেশ ম্যানেজমেন্ট একাদশ সাজালো দুটি রদবদল করে, তিন পেসারের বদলে ২ পেসার আর ৩ স্পিনার নিয়ে।
দল থেকে বাদ দেওয়া হলো পাকিস্তানের মাটিতে ভালো বল করা এবং চেন্নাইতে সমীহ জাগানো নাহিদ রানা আর তাসকিন আহমেদকে। নেওয়া হলো পেসার খালেদ আহমেদকে, যিনি পাকিস্তান সফরে ২ টেস্টের এক ম্যাচেও খেলেননি।
চেন্নাই টেস্টেও খালেদের সময় কেটেছে পানি টেনে আর ড্রেসিং রুমে বসে। ভারতের সাথে ভারতের মাটিতে টেস্ট খেলার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতিই হয়তো ছিল না খালেদের। সেটা তার বোলিং দেখেই বোঝা গেছে।
বাড়তি গতি, সুইং তো বহুদূরে; লাইন-লেন্থই ঠিক ছিল না। ভারতীয় ব্যাটারদের মারের তোরে লাইন লেন্থ হারিয়ে বসা খালেদ ভড়কে গিয়ে নিশ্চিত রানআউটও মিস করেছেন। আর সীমানার কাছে ফিল্ডিংয়ের সময় তার দুই পায়ের ফাঁক গলে বাউন্ডারিও হয়েছে।
ভারতীয়রা স্পিনে দক্ষ সবার জানা। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল, জসশ্বী জয়সওয়াল, শুভমান গিলদের মত ওয়ার্ল্ডক্লাস আর ওভার ট্যালেন্টেড ব্যাটারদের বিপক্ষে ৩ স্পিনার নিয়ে নামার চড়া মাশুলও গুনতে হলো। বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলামও হালে পানি পাননি। বেদম মার খেয়েছেন।
আর মাঠে নেমে ব্যাটাররা হেঁটেছেন ভুল পথে। তাদের অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশনটাই ছিল ভুল। তারা ভারতের বোলারদের বলের মেধা গুণ বিচার করে গাণিতিক ব্যাটিংয়ের চেষ্টা না করে নিজের মত করে খেলতে গেছেন।
এটা টেস্ট ম্যাচ, বৃষ্টিতে যত সময়ই নষ্ট হোক না কেন, আমাদের দেখে খেলতে হবে। যতটা বেশি সময় পারা যায় উইকেটে কাটাতে হবে। বুমরাহ সময়ের সেরা ফাস্টবোলার। আর অশ্বিন ও জাদেজা বিশ্বের সেরা ২ স্পিনার। তাদের খেলতে হলে দরকার নিখুঁত টেকনিক, পারফেক্ট স্কিল, সর্বোচ্চ মনোযোগ-মনোসংযোগ। তার বালাই ছিলনা বেশির ভাগ ব্যাটারের।
প্রথম ইনিংসে মুমিনুল ঠিক সেই পথে হেঁটে সফল হন। সেঞ্চুরির দেখা পান। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রায় একই পথে হেঁটে অনেকদুর এগিয়ে গিয়েছিলেন ওপেনার সাদমানও। কিন্তু হাফসেঞ্চুরির পর যেন তারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। আকাশ দীপের অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বলকে অযথা তাড়া করে গালিতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরলেন।
বোঝাই গেল, ভারতের বিপক্ষে পঞ্চাশেই খুশি এ তরুণ। যেখানে তিনি একদিক আগলে আছেন এবং পঞ্চাশের ঘরে পা-ও রেখেছেন। তারপর তার অমন বেপরোয়া শট খেলার কী দরকার ছিল? সাদমান কি এ প্রশ্নর জবাব দিতে পারবেন?
আসলে বোঝা গেল, ভারতের বিশ্বমানের বোলিংয়ের বিপক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে উইকেটে থাকা এবং লম্বা ইনিংস খেলার জন্য মাইন্ডসেট দরকার, সেটা নেই এ বাঁহাতি তরুণের। তাই পঞ্চাশে গিয়ে অমন লাগামহীন আউট হওয়া।
সাকিব আল হাসান দলের সেরা ক্রিকেটার। সফলতম পারফরমার। তার টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রদীপ নিভু নিভু। হয়তবা এটাই তার শেষ ইনিংসও হতে পারে। তিনিও রবীন্দ্র জাদেজার বুদ্ধি খাটিয়ে একটু আস্তে করা ডেলিভারিতে বোকা বনলেন। আগে থেকেই মারবো বলে ঠিক করে রেখে শেষ পর্যন্ত শট চেক দিতে গিয়েও পারলেন না, রিটার্ন ক্যাচ হলো।
জাদেজার অপর শিকার হলেন লিটন দাস। তিনিও আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন অফস্টাম্পেরর বাইরে পেলেই ব্যাট পেতে দেব। একটু লাফিয়ে ওঠা ডেলিভারি লিটনের ব্যাটের ওপরে গেলে চলে গেল কিপার রিশাভ পান্তের গ্লাভসে।
তার মানে কি দাঁড়ালো? একাদশ সাজানোয় ভুল, ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশনে বড় ধরনের ত্রুটি-দুয়েই সর্বনাশ। এত দিন পরও সেই ভুলের রাজ্যে বসবাস। আর কতকাল চলবে এ অবস্থা? এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যে প্রত্যয়-আত্মনিবেদন দরকার, সেটা আর কবে আসবে বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে? উত্তরটা যেন জানা নেই কারো।
এআরবি/এমএমআর/এমএস