সৌম্যর সেঞ্চুরি: ফর্মে ফেরা নাকি হঠাৎ আলোর ঝলকানি?

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৩:২৫ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৩

একটি মাত্র ওয়ানডের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৫’র বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এতটুকু ভড়কে না গিয়ে সেবার বুকভরা সাহস নিয়ে ইনিংসের সূচনা করতেন। কিংবা তিন নম্বরে নেমে নতুন বলে উইকেটের সামনে ও দু’দিকে চালিয়ে ৬ নম্বর ম্যাচে প্রথম হাফ সেঞ্চুরির হাঁকিয়েছিলেন সৌম্য সরকার। ওই ম্যাচেই তিনি জানান দিয়েছিলেন, আমিও হাত খুলে খেলতে পারি।

২০১৫’র বিশ্বকাপের পর খুব দ্রুত সৌম্যর সামর্থ্যের স্ফুরণ ঘটে। ১০ নম্বর ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেন। তাও পাকিস্তানের বিপক্ষে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চার ও ছক্কার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে ৮৮ ও ৯০ রানের একজোড়া ম্যাচ জেতানো ইনিংস উপহার দিয়ে রীতিমত আক্রমণাত্মক ওপেনারের স্বীকিৃতি পেয়ে যান সৌম্য।

কিন্তু সে ধারা ধরে রাখতে পারেননি বেশিদিন। হঠাৎ কেমন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেন এ মারকুটে ওপেনার। দিনের পর দিন তার ব্যাট একদম নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রান খরা নেমে আসে তার ব্যাটে। বার বার সুযোগ পেয়েও রান না পেয়ে সাজঘরে ফিরেছেন। যে কারণে তখনই সংশয জাগে। অন্ধ সৌম্য ভক্তরাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন, মনে হয় তার ক্যারিয়ারের সূর্য‘ডুবু ডুবু’।

বিশ্বকাপের আগে থেকেই ওপেনার সংকটে ছিল বাংলাদেশ। নাইম শেখ, এনামুল হক বিজয়, তানজিদ হাসান তামিমের পাশাপাশি মেকশিফট ওপেনার হিসেবে মিরাজকেও ট্রাই করা হয়েছিলো। কিন্তু কেউই শেষ পর্যন্ত নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।

এর মধ্যে চলে আসে নিউজিল্যান্ড সফর। প্রধান চালিকাশক্তি সাকিব ইনজুরির কারণে খেলতে পারছেন না। তাকে রিপ্লেস করতে পারেন, এমন কাউকে খুঁজতে গিয়ে আবার সৌম্য সরকারকে বিবেচনায় আনেন নির্বাচকরা।

ওদিকে রিয়াদও ফিট না। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি পিচটাও সৌম্যর ফ্রি স্ট্রোক খেলায় সহায়ক হবে- এসব ভেবেই নিউজিল্যান্ডে সৌম্যকে নেয়ার সিদ্ধান্ত; কিন্তু ডানেডিনে প্রথম ওয়ানডেতে চরম ব্যর্থ সৌম্য সবাইকে হতাশ করেন। ব্যাট হাতে শুন্য রানে আউট হলেন। বল হাতে ৬ ওভারের কোটায় ওভার পিছু ১০ রানের বেশি (৬৩) দিয়ে থাকেন উইকেটশূন্য। আবার ক্যাচও ফেলে দেন। সব মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সৌম্য রীতিমত খলনায়ক বনে যান।

তাকে কেন নেয়া হলো? তা নিয়ে নানা কথা-বার্তা ও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন কোচ হাথুরু এবং নির্বাচকরা। অবশেষে ২০ ডিসেম্বর, বুধবার নেলসনে হাসলো সৌম্যর ব্যাট।

টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, মিচেল সান্তনার, ইশ সোধি ও ফিলিপস ছাড়া বুধবার নেলসনের ওভাল শেপের (সামনে বড়, দুদিকে ছোট) মাঠে রান উৎসবে মেতে উঠলেন সৌম্য সরকার। ১৫১ বলে খেলে ফেললেন ১৬৯ রানের বিশাল ইনিংস। লিটন দাসেন ১৭৬ রানের পর একদিনের ক্রিকেটে যা বাংলাদেশের ব্যাটারদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর।

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে হিসেব করলে ৫ বছর ২ মাস পর সেঞ্চুরির দেখা পেলেন সৌম্য। ২০১৮ সালে ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ শতকটি (৯৬ বলে ১১৭) হাঁকিয়েছিলেন এ বাঁহাতি ওপেনার। এরপর ২৯ ম্যাচের ২৬ ইনিংস আর তিন অংকে পৌছাতে পারেননি। অবশেষে বুধবার ২৭ নম্বর ইনিংসে এসে ক্যারিয়ার সেরা নকটি খেললেন সৌম্য।

মাঝের সময়ে ব্যাট না হাসায়, সৌম্যর ক্যারিয়ারটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। তিনি যে হাত খুলে মারতে পারেন এবং নিজের দিনে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের যে কোন ব্যাটারের চেয়ে খুনে মেজাজে প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে সীমানার ওপারে পাঠাতে খুব পারদর্শী- তার হাতে ড্রাইভ, কাট, ফ্লিক, পুল ও স্লগ সুইপ সব শটই আছে। তিনি এক-দুই পা বেরিয়ে লং অফ, লং অন আর মিডউইকেটের ওপর দিয়ে তুলে বিশাল ছক্কা হাঁকাতে পারেন অবলীলায়, সে সব কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন অনেকে।

আজ নেলসনে ২২ বাউন্ডারি আর ২ ছক্কা হাঁকিয়ে সেই সোনালী দিন ফিরিয়ে এনেছেন সৌম্য। মাঝে দীর্ঘদিন খারাপ খেলার পরও শুরুতে ভাল খেলার কারণে এখনো তার সামনে আছে একটি রেকর্ড গড়ার হাতছানি। বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম ইনিংস ব্যাট করে ওয়ানডেতে ২০০০ রানের মালিক হতে পারেন সৌম্য।

তার আগে লিটন দাস আর শাহরিয়ার নাফীস ৬৫ ম্যাচে সমান ইনিংস খেলে ২০০০ রান পূর্ণ করেছেন। বুধবারের বিগ হান্ড্রেডে সৌম্য পৌঁছে গেছেন ২০০০ রানের দোরগেড়ায়। আর মাত্র ৬৩ রান হলেই ওয়ানডেতে ২ হাজার রান পূর্ণ হবে তার। শাহরিয়ার নাফীস আর লিটন দাসের (৬৫ ম্যাচ ৬৫ ইনিংস) চেয়ে ৪ ইনিংস কম (৬১) ব্যাটিং করা সৌম্যর সংগ্রহ ১৯৩৭। আগামী দুই থেকে তিন ইনিংসের মধ্যে বাকি ৬৩ রান করে ফেললে তিনিই বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম ইনিংসে ২০০০ রান সংগ্রহকারী হয়ে যাবেন।

পাশাপাশি আরও একটি তথ্য দিয়ে দেই, সেটাও অবাক করার মত। এতদিন অফফর্মে থাকার পরও সৌম্যর ওয়ানডে স্ট্রাইকরেট বাংলদেশের ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অন্তত ৬০-৬৫ ওয়ানডে খেলা ব্যাটারদের মধ্যে সৌম্যর স্ট্রাইকরেট ৯৮.১৭।

সেখানে তামিম (৭৮.৫২), মুশফিক (৭৯.৫৬), সাকিব (৮২.৮৪), মাহমুদউল্লাহ (৭৬.৮৫), আশরাফুল (৭০.১১), লিটন দাস (৮৬.৭৮), ইমরুল কায়েস (৭১.১০), হাবিবুল বাশার (৬০.৪৫) ও শাহরিয়ার নাফীস (৬৯.৪৯) ও আফতাব আহমেদ (৮৩.০৪) সবাই সৌম্যর পিছনে।
স্ট্রাইকরেটই বলে দিচ্ছে, সৌম্যই তাদের মধ্যে নাম্বার ওয়ান বিগ হিটার। সেই ক্লিন ও বিগ হিটার সৌম্যকেই যে দরকার বাংলাদেশের। তাহলে দীর্ঘ দিনের ওপেনিং সংকট, সমস্যা কেটে যাবে। ব্যাটিং শুরুর পরপরই যেভাবে হুড়মুড় করে লাইনআপ ভেঙ্গে পড়ে, সেটাও রোধ হবে।

এই এক সেঞ্চুরি দিয়ে সৌম্য কি আবার সেই আগের রূপে ফিরতে পারবেন? নাকি হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে আবার দপ করে নিবে যাবেন? এখনই সে রায় দেয়া সম্ভব নয়।

এআরবি/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।