ম্যাক্সওয়েলকে মাঠেই সুস্থ করে তুলে ‘নায়ক’ নিক জোনস
যারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেন, তাদের কাছে পরিচিত নাম ‘বিদ্যাপতি’। মিথিলার রাজসভার কবি ছিলেন তিনি। তার একটি বিশেষ প্রতিভা হলো তিনি বাংলা ভাষায় একটি কবিতাও না লিখে বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি হয়ে আছেন যুগযুগান্তর ধরে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ২০১ রানের অপরাজিত থাকার ইনিংসেও একজন বিদ্যাপতি ছিলেন। নাম তার নিক জোনস।
নিক জোনস কোনো বল করেননি, ব্যাটিংয়েও নামেননি। কিন্তু এই ফিজিওথেরাপিস্টের কল্যাণেই গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের পায়ে বারবার ইনজুরি হওয়ার পরেও তিনি উঠে দাঁড়িয়ে খেলতে পেরেছেন। শুধু খেলেনইনি, করেছেন বিশ্ব জয়।
গত দুই বছর ধরেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের ফিজিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নিক জোনস। দলের প্রয়োজনে একজন ফিজিওথেরাপিস্টও যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেননি সেটিরই এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন তিনি।
ম্যাক্সওয়েল যখন ক্রিজে যান, তখনই অজি মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা সতর্ক করে দিয়েছেন নিক জোনসকে। কেননা, ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ম্যাক্সওয়েল পুরো দশ ওভার বল করে আবার ক্রিজে যাচ্ছেন।
ম্যাক্সওয়েলের পায়ের পেশীতে টান অনুভব হয় ৩০ ওভারের সময় যখন তিনি টানা তিনবার করে ডাবল এবং পরবর্তীতে এক রান নেন। বারবারই তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন। কখনো হ্যামস্ট্রিং, কখনো পায়ের পাতা। এ যেন ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা’ এমন অবস্থা।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিক জোনস বলেন, ‘ওই সময়ে আমরা হারের ব্যবধান কমানোর লড়াই করছিল। ম্যাক্সওয়েলের মতো ইনজুরি এর আগে অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গেই ঘটতে দেখেছি। আপনি এই অবস্থায় যত দৌড়াবেন, ততই আপনার পেশীতে টান লাগবে দ্রুতগতিতে। আমি বেশ কয়েকবার মাঠে ঢুকেছি এবং তাকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করি। সবকিছুকে স্তিমিত করার চেষ্টা করি। তার হার্ট রেটকে অনেক বেড়ে ছিল, যা কমানোর চেষ্টা করি।’
মাঠে মোট তিনবার ম্যাক্সওয়েলের ব্যথায় তাকে ছুটে আসতে দেখা গেছে। নিক জোনস বলেন, ‘আমরা ম্যাক্সওয়েলের সাথে এর আগেও এমন হতে দেখেছি। আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, সে যদি কিছুটা স্তিমিত হয়ে ক্রিজে দাঁড়িয়ে খেলতে পারে তাহলে ব্যথা কমে গিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে পারবে।’
মাঠেই একবার শট খেলতে গিয়ে লুটিয়ে পড়েন ম্যাক্সওয়েল। দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি তার জীবনটা চলে যায়! নিক সেই মুহূর্তের কথা মনে করে বলেন, ‘সে একটা শট খেলতে গিয়ে পড়ে যায়, মনে হচ্ছিল তাকে কেউ গুলি করেছে এবং একটা মৃত মানুষ মাটিতে শুয়ে আছে। আমি দ্রুতই মাঠে ঢুকি। তার ডান পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা হচ্ছিল পাশাপাশি অন্যান্য জায়গার পেশীতেও অনেক টান লাগছিল তার। সে তখন বলতেছিল, আমি শেষ, আমি আর পারবো না চালিয়ে যেতে। আমাকে ক্রিজ ছেড়ে চলে যেতে হবে অবসর নিয়ে।’
প্যাট কামিন্সও তাকে পরামর্শ দিচ্ছিল অবসর নিয়ে বাইরে গিয়ে কিছু সেবাশুশ্রূষা নিয়ে আবার মাঠে ফিরে আসতে।
নিক সেই মুহূর্ত মনে করে বলেন, ‘এমন অবস্থায় অনেকেই পড়তে পারে। কিন্তু তখন যদি কাউকে উঠিয়ে নেয়া হয় তাহলে খেলার ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে, যেখানে আপনি ইতোমধ্যে পিছিয়ে আছেন। প্রতিপক্ষ পূর্ণ শক্তি নিয়ে আবার ফিরে আসবে।’
নিক তখন ম্যাক্সওয়েলকে পরামর্শ দিলেন, ‘তুমি পড়ে যাচ্ছো, পায়ে ব্যথা পাচ্ছো। কিন্তু তোমার হাতের জোর তো কমেনি। যদি দৌড়ানো কমিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে খেলতে পারো, তাহলে অনেকক্ষণ ব্যাটিং করতে পারে। এটাই তোমার জন্য উত্তম হবে।’
নিক জোনসের সেই টোটকাতেই হয়তো বদলে গিয়েছিল ম্যাক্সওয়েলের চিন্তাচেতনা। এরপরই ম্যাক্সওয়েল ক্রিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আফগান বোলারদের শাসন করেন।
মাঝে মাঝে ১-২টা সিঙ্গেল রান নিলেও চার-ছক্কাতেই নিজের কব্জির জোড়ের পারদর্শিতা দেখান। যদি নিক জোনস এমন করে পরিচর্যা না করতেন হয়তো আমরা দেখতে পেতাম না ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংসটি। তাই কোনো বল ও ব্যাটিং না করেও নিক জোনস ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম নায়ক হয়ে রইলেন ম্যাক্সওয়েলদের কাছে।
এমএমআর/জিকেএস