যে সব সমীকরণ মিলে গেলে বাংলাদেশ খেলবে সেমিফাইনালে
এখন বলা যায় সেমিতে খেলার লক্ষ্য নিয়েই এবারের বিশ্বকাপ খেলতে নামছে সাকিবের দল। বাংলাদেশ শেষ চারে থাকতে পারবে তো? সাকিবের দলের কি সত্যিই সেমিতে খেলার সামর্থ্য আছে?
তা নিয়ে সবাই যে একমত, তা নয়। তবে বেশির ভাগের মত, ভারতের মাটিতে খেলা। আবহাওয়া, উইকেট সবই প্রায় অনুকুল। তাই বাংলাদেশের আগের যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল করার সম্ভাবনা বেশি। এবার আগের চেয়ে বেশি ম্যাচ জেতা তাই অসম্ভব নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আগে কখনো সেমিফাইনাল খেলেনি। ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে টাইগারদের আছে সর্বোচ্চ তিনটি করে ম্যাচ জয়ের রেকর্ড এবং সেটা একবার নয়। তিন তিনবার (২০১১, ২০১৫ ও ২০১৯)।
মানে শেষ তিন আসরে বাংলাদেশ সমান তিনটি করে ম্যাচ জিতেছে। এর মধ্যে ২০১১-তে অবশ্য দেশের মাটিতে সব ম্যাচ খেলে ওই তিন জয়ই থেকেছে সঙ্গী টাইগারদের।
প্রথম ও শেষ কথা হলো, এবার সেমিফাইনাল খেলতে হলে অবশ্যই ওই ৩ জয়ে হবে না। কারণ, এখন আর আগের মত গ্রুপ করে খেলা হচ্ছে না। খেলতে হবে সবার সাথে। ১০ দলের আসরে রাউন্ড রবিন লিগে ৯ ম্যাচ শেষে ১, ২, ৩ ও ৪ নম্বরে থাকা দল চারটি সেমিতে পা রাখবে। এর মানে, শেষ চারে পা রাখতে হলে ৫টি দলের ওপরে থেকে অন্তত চার নম্বরে জায়গা করে নিতেই হবে। ৫ দলের ওপরে থাকার অর্থ, অন্তত ৫ ম্যাচে জয়। সোজা কথা, সেমিফাইনাল খেলতে হলে দরকার ৬টি জয়।
তাহলে ওপরের দিকের ৪ দলের মধ্যে থাকা যাবে। এর বাইরে ৫ জয় এবং বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক কারণে পরিত্যক্ত কোন ম্যাচ থেকে ১ পয়েন্ট পেলেও সম্ভাবনা জিইয়ে থাকবে। আর যদি প্রতিদ্বন্দ্বীতা খুব বেশি হয়, নিজেদের মধ্যে হার-জিত অনেক বেশি হয়, তখন ৪ দলের সাথে পরিত্যক্ত ম্যাচে পাওয়া ১ /২ পয়েন্টেও ভাগ্য খুলে যেতে পারে।
এরমানে সমীকরণ হলো ৩টি। প্রথম সমীকরণ- সরাসরি ৬ ম্যাচ জেতা। তাতে ৬ দলের ওপরে (সেরা চারে) থাকা নিশ্চিত। দ্বিতীয় সমীকরণ- ৫ জয়। আর তাতেও সেমিফাইনাল খেলার সম্ভাবনা জিইয়ে থাকবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ওই ৫ থেকে ৬ ম্যাচ জেতার সামর্থ্য কি আছে বাংলাদেশের? যদি থাকেই, তাহলে কোন ৫ থেকে ৬ দলকে হারানো সম্ভব? সাকিবের দল ৯ প্রতিদ্বন্দ্বীর কোন ৬ বা ৫ দলকে হারানোর টার্গেট করেছে?
টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন জানিয়ে দিয়েছেন, কোন বিশেষ দলকে হারানোর কথা না ভেবে ম্যাচ বাই ম্যাচ চিন্তা করছে টাইগাররা। তারপরও ভক্তরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, কোন কোন দলকে হারানোর সামর্থ্য বেশি বাংলাদেশের?
বেশিরভাগ টাইগার সমর্থকের ধারণা- আফগানিস্তান, নেদারল্যান্ডস এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিতবে বাংলাদেশ। ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। ওই তিন দলকে হারানোর চিন্তা বাদ দেয়ার পক্ষেই বেশির ভাগ টাইগার সমর্থক। বরং বাংলাদেশের সমর্থকদের বড় অংশ নেদারল্যান্ডস, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর কথাই ভাবতে চান বেশি।
ইতিহাস-পরিসংখ্যানকে মানদণ্ড ধরলে এই ৬ দলের বিপক্ষেই সাফল্য আছে সাকিব, মুশফিক, লিটনদের। ২০১৫ সালে মাশরাফির বাংলাদেশের কাছে ৩ ম্যাচের সিরিজে ‘বাংলা ওয়াশ’ হয়েছে পাকিস্তানীরা। একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকাও ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছে বাংলাদেশের কাছে। সেটাই শেষ নয়।
এরপর ২০২২ সালের মার্চে শেষ ওয়ানডে সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে গিয়ে প্রোটিয়াদের সিরিজ (২-১)হারিয়ে দিয়েছে টাইগাররা। আর কিউইরাতো পরপর দুইবার বাংলাদেশের মাটিতে নাকাল হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘদিন পর এবার জিতেছে ব্ল্যাক ক্যাপ্সরা।
এর মানে ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, বিচ্ছিন্ন কোন জয় নয়, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ বিজয়ের রেকর্ড আছে টাইগারদের। এছাড়া প্রোটিয়ারা গত ২০১৯ বিশ্বকাপেও পারেনি বাংলাদেশের কাছে। প্রথম ম্যাচে সাকিবের উদ্ভাসিত সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে টাইগাররা।
বিশ্বকাপের ট্র্যাক রেকর্ডকে মানদন্ড ধরলে ইংল্যান্ডের সাথেও বাংলাদেশের আছে একজোড়া জয় (২০১১ সালে ২ উইকেট আর ২০১৫ সালে ১৫ রানে)। ভাবছেন এত দলের সাথে সাফল্যর কথা বলা হলো- ভারতের বিপক্ষেও যে দু’দুটি সিরিজ বিজয়ের দারুণ কৃতিত্ব আছে টাইগারদের- তাতো বলা হলো না। বলা হতো। উপমা হিসেবে সেটা আসতোই। ইতিহাস সাক্ষী, ২০১৫ সালে ২-১ আর গত বছর ডিসেম্বরে দেশের মাটিতে ভারতকে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছে বাংলাদেশ। আর এই সেদিন এশিয়া কাপের সুপার ফোরেও ভারতের বিপক্ষে শেষ হাসি হেসেছে টাইগাররা।
এর বাইরে আফগানিস্তান, নেদারল্যান্ডস ও শ্রীলঙ্কার সাথেও সাফল্যর হার বেশি। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পরিষ্কার জানান দিচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি সব দলের সাথেই সাম্প্রতিক সময়ে জয়ের রেকর্ড আছে টাইগারদের।
তাই অসিদের হারানোর চিন্তা আসেনি কারো মাথায়ই। যেহেতু খেলা হবে ভারতের মাটিতে। টিম ইন্ডিয়া অনেক সমৃদ্ধ। শক্তিশালী। প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাই অসিদের পাশাপাশি রোহিত শর্মার দলকে হারানোর কথাও বেশির ভাগ বাংলাদেশ সমর্থক ও বিশেষজ্ঞ মাথায় আনছেন না।
আজকাল ইংলিশরাও অনেক টাফ ও আগ্রাসি ক্রিকেট খেলে। তাই ইংলিশদের হারানোও হবে কঠিন; কিন্তু নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানকে হারানো সম্ভব। ইংলিশরা প্রথম ম্যাচে কিউইদের কাছে হালে পানি পায়নি। তাই ইংল্যান্ডকে বাদ দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর কথা শুনে হয়ত কেউ কেউ ফোড়ন কাটতে পারেন।
আসলে ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় কিউইরা একটা পর্যায়ে গিয়ে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলে। আর দক্ষিন আফ্রিকা তো বরাবরই বড় মঞ্চে ব্যর্থতার ঘানি টেনে আসছে। উপমহাদেশের মাটিতে তাদের সাফল্যও কম।
প্রোটিয়াদের পাশাপাশি পাকিস্তানকে হারানোর কথাও ভাবতে পারে বাংলাদেশ। এক কথায় খুব ভাল ‘শেপে’ নেই এবার পাকিস্তান। ব্যাটিং ও বোলিং- দুই বিভাগেই আছে বড় দুর্বলতা। ঘাটতি। ফাস্টবোলার নাসিম শাহ’র অনুপস্থিতিতে পেস বোলিং ডিপার্টমেন্ট গেছে দুর্বল হয়ে। স্পিন আক্রমণটা বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল ও কমজোরি।
ব্যাটিংয়ের অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। বাবর আজম নির্ভর। রিজওয়ান আর ইফতেখার ছাড়া আর কারো ব্যাটেও রান নেই। কাজেই পাকিস্তানকে হারানোর স্বপ্ন দেখাই যায়। যদিও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বাবর আজম ব্যর্থ হলেও রিজওয়ান-সউদ শাকিল মিলে পাকিস্তানকে জয় এনে দিয়েছেন।
সমালোচকরা হয়ত বলবেন, আফগানিস্তানের আর শ্রীলঙ্কার সাথে শেষ সিরিজে হেরেছে বাংলাদেশ। তারপরও আফগান আর লঙ্কানদের হারানোর চিন্তা কি করে? এ জন্য যে, এশিয়া কাপে আফগানদের নাকানি চুবানি খাইয়েছে বাংলাদেশ। শান্ত আর মিরাজের জোড়া শতকে রান পাহাড়ের নিচে চাপা পড়েছিলো আফগানরা। আর গুয়াহাটিতে প্রস্তুতি ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকেও উড়িয়ে (৭ উইকেটে) দিয়েছে টাইগাররা।
কাজেই তরতাজা জয়ের সুখস্মৃতি নিয়েই আফগান ও লঙ্কানদের বিপক্ষে মাঠে নামবে সাকিবের দল।
সুতরাং, ৫ থেকে ৬ জয়ের স্বপ্ন আকাশ কুসুম কল্পনা নয়। সেমিতে খেলতে ওই জয়গুলোই হতে পারে যথেষ্ঠ। এখন সামর্থ্যেআস্থা রেখে মাঠে সেরাটা উপহার দিতে পারলেই হবে লক্ষ্য পূরণ। দেখা যাক সাকিবের দল তা পারে কি না?
এআরবি/ আইএইচএস/