‘শো ম্যান’ গিল এবং চার-ছক্কার দৃষ্টিনন্দন শিল্প
শুভমান যখন ‘শো ম্যান’। ৬০ বলে ১২৯ রানের অতি মানবীয় ইনিংসটি খেলে যখন তিনি সাজঘরে ফিরছিলেন, পুরো মোতেরা স্টেডিয়ামের গ্যালারি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। এক লক্ষেরও বেশি দর্শকের উপস্থিতি। বিশাল পরিমাণের দর্শক যখন দাঁড়িয়ে কাউকে সম্মান জানায়, তার ভাগ্যটা কেমন- ভাবলেও তো বিস্ময় জাগার কথা।
বড় স্টেজের শো ম্যান। ওরাই, যাদের নিজেদের ওপর স্পটলাইট থাকে এবং নিজেদেরকে সব সময় প্রমাণ করে যান। চাপকে সব সময়ই আলিঙ্গন করে থাকে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেই চাপ মোকাবেলা করে বলে, ‘আমি প্রস্তুত।’
শুক্রবার রাতে আহমেদাবাদের মোতেরা স্টেডিয়াম তেমনই এক স্টেজ সাজিয়ে দিয়েছিলো শুভমান গিলের জন্য। শুভমান হয়ে গেলেন ‘শো ম্যান’। নিজের সেরাটা দিয়ে দখল করলেন সাজানো মঞ্চ। স্ট্যান্ডিং ওভেশন তো তার জন্যেই কেবল মানায়।
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচের টস শুরুর আগেই ঝড় উঠেছিলো। সেই ঝড়ের সঙ্গে সবাই দ্রুতবেগে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো কোনো ছাউনির নিচে। ঝড়-বৃষ্টির পর প্রথমে ব্যাট করতে নামতে গিয়ে স্টেডিয়ামের দীর্ঘ সিঁড়িটা পার মাঠে প্রবেশ করেন শুভমান গিল। এরপরের ঝড়টা তুলেছিলেন তিনি।
এমন একটি কাজ তিনি হয়তো করতে চেয়েছিলেন চেন্নাইর এম চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে। কিন্তু সেখানে তা করে দেখাতে পারেননি। কিন্তু এমনও হতে পারে, চেন্নাই ছিল তার জন্য ওয়ার্মআপ সেশন। যার মূল ‘শো’ হয়েছিলো মোতেরায়।
ব্যাট হাতে মুম্বাই বোলারদের মোকাবেলার সময় গিলের আত্মবিশ্বাস ছিল সবচেয়ে উঁচুতে। প্রতিটি শটে, প্রতিটি বাউন্ডারি কিংবা ওভার বাউন্ডারিতে তার সেই আত্মবিশ্বাস যেন ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছিলো। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স খেলোয়াড়রা নিশ্চয় অনেক পরিকল্পনা, অনেক চেষ্টা করেছে তাকে থামানোর। কিন্তু উল্টো তাদেরকেই তিনি একার হাতে ধ্বংস করেছেন। প্রতিটি বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন বাউন্ডারির বাইরে।
৬০ বলে ১২৯ রানের মহাকাব্য লিখে যখন গিল মাঠে ফিরছিলেন, তখন পুরো গ্যালারি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ দিয়ে তাকে সম্মান জানিয়েছিলো। আপনি কল্পনা করে দেখুন, টি-টোয়েন্টিতে তিনি নিজেকে যে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে, তার নতুন এক অধ্যায় রচনা করে গেলেন কি না!
শুভমান এমন এক ব্যাটার, যিনি দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করছিলেন। প্রায় প্রতিটি বলকেই চ্যালেঞ্জ করছিলেন। যা একজন ব্যাটারের জন্য অত্যন্ত রিস্কি একটা ব্যাপার। কিন্তু ভালো এবং বড় কিছু অর্জন করতে হলে এ ধরনের রিস্ক ছাড়া আর কোনো বিকল্পও থাকে না।
সেই রিস্ক নিয়ে সফল তিনি। গিলের ব্যাটিং হলো যেন সাধারণ ব্যাটিং মেকানিক্সের একটি ট্রেন, যেটার একটি একটি ফ্রেম আরেক ফ্রেমের সঙ্গে লেগে থাকে (ট্রেনের যেমন একটি বগির সঙ্গে যেমন আরেকটি বগি লেগে থাকে)। শক্ত ভিত্তি, অনড় মস্তিষ্ক, ন্যুনতম এবং অতিরঞ্জিত ব্যাকলিফট এবং দ্রুত পায়ের নড়াচড়া- দ্রুত কিন্তু মনে হবে যেন সেখানে কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
তবে, এখানে অবশ্যই শুভমানের শিক্ষাটা বড়। সবচেয়ে বড় কথা, এর সব কিছুই যথাযত কোচিংয়ের ফলাফল। তবে সবকিছুর বাইরে এবং যে কোনো কিছুর চেয়েও শান্তভাবে আপনার যেটা মনে হতে পারে, সেটা হলো শুভমান যখন যেখান দিয়ে ইচ্ছা, বলটাকে মাঠের বাইরে পাঠাতে পারেন।
এটা স্পষ্ট যে, এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র তার নিজের খেলা দিয়ে নয়, তিনি যেভাবে অনুশীলন করেছেন, যেভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তার সঠিক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।
কখন থেকে অসাধারণ কোচিং ম্যাটেরিয়ালসের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন গিল? রাহুল দ্রাবিড় যখন ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলটির কোচ ছিলেন, তখন তার মূল তত্বই ছিল, প্রতিটি খেলোয়াড়ের ম্যাচিউরিটি নির্ণয় করা। এরমধ্যে একটা হতে পারে, খেলোয়াড়রা কত দ্রুত রুটিনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, সেটা। এমনকি এটা যদি হয় খুবই সিম্পল কোনো কিছু, অথবা হতে পারে হাস্যকর। শুধু বড় কোনো খেলার আগে নেটে ব্যাটিংয়ের বিষয়টাকেই তিনি (দ্রাবিড়) গুরুত্ব দিতেন না। খেলোয়াড়রা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, এ ধরনের কোনো নির্দেশাবলীর মধ্যে তিনি বেধে রাখতেন না।
গত সপ্তাহেই, এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে ম্যাচের আগে গিল দেখিয়েছিলেন, নিজের রুটিন সম্পর্কে তার গভীর দৃষ্টিভঙ্গি কি! তিনি নেটে খুব লম্বা সময় ধরে ব্যাটিং অনুশীলন করেননি। কিন্তু যতক্ষণ তিনি নেটে ছিলেন, তাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাহুল দ্রাবিড় যে ম্যাচিউরিটির কথা বলেন, সেটা কেমন হতে পারে।
তিনি ব্যাট করেছেন বড়জোর ১৫ মিনিট। শট বল যখন বাজে কোন থেকে শরীর লক্ষ্যে ছুটে আসে, তখন ওই বলের বিরুদ্ধে নিজেকে কিভাবে সেটআপ করতে হবে, তার অনুশীলনই করেছেন এর মধ্যে। ততটুকুতেই গিলের লক্ষ্য বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। এতে করে মিডল থেকে অফে খুব দ্রুত কিভাবে সরে আসা যাবে এবং বলকে টার্গেটে পরিণত করা যাবে, সে ট্রেনিংটাই তিনি নিয়েছেন। বলটাকে তিনি লেগ সাইডে টেনে নিচ্ছেন এবং প্রায়ই যে কোনো পেস বোলারের বলকে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে খেলে দিচ্ছেন। দেখুন, ইনফ্রন্ট নয়, তার পেছন দিক থেকে খেলছেন বলটিকে।
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে গিলের খেলা ৬০ বলের মধ্যে ১০টি ছক্কা এবং ৭টি বাউন্ডারির মারের দিকে খেয়াল করে দেখুন! স্পষ্টই বুঝতে পারবেন, নেটে যে ছোট ছোট কাজগুলো তিনি করে আসেন, সেগুলোর কী অপূর্ব প্রদর্শনী করেছেন। ইয়র্কার লেন্থ কিংবা লেগ স্ট্যাম্পের ওপর থাকা বলগুলোকে অবলীলায় ছক্কা পরিণত করছেন।
আইপিএল হয়তো সেরা জায়গা, কিন্তু একমাত্র নয়। গিল তার এই ব্যাটিং কৌশল এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও দেখাতে শুরু করেছেন। এখন দেখার বিষয়, কতদূর যেতে পারেন তিনি।
আইএইচএস/