নির্মাণের ২২ বছর পরও আলোর মুখ দেখেনি ফেনীর সুইমিংপুল
খাল-বিল, নদী-নালার দেশে ভালোমানের সাঁতারু বের করে আনার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল। যে সব সাঁতারুরা শুধুমাত্র এসএ গেমস নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এশিয়ান গেমস, এমনকি অলিম্পিক গেমসেও।
শুধু সাঁতারু বের করে আনাই নয়, বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনে খেলোয়াড়দের শরীরচর্চার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবেও খুব প্রয়োজন সাঁতার। সাধারণ মানুষের সাঁতার শেখাটাও জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়।
সবকিছুকে সামনে রেখে সারা দেশে অন্তত ২৩টি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের পর অধিকাংশ পুলই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। কোনো কোনো পুলে তো একদিনের জন্যও কেউ নামতে পারেনি। কোথাও পানি নেই, কোথাও পাম্প নষ্ট, কোথাও নোংরা পানি- নানা অব্যবস্থায় পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত সুইমিংপুলগুলো।
অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এসব সুইমিংপুল নিয়েই জাগোনিউজের ধারাবাহিক আয়োজন। চতুর্থ পর্বে আজ থাকছে ফেনী সুইমিংপুলের চালচিত্র...
* ২০০০ সালে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মাণ করা হয় ফেনী সুইমিংপুল।
* ২২ বছরেও চালু না হওয়ায় অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনাসহ যন্ত্রপাতি।
* টাইলস্গুলো উঠে যাচ্ছে, পলেস্তারা খসে পড়ছে, দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল।
* পুল এলাকা এখন দিন-রাত মাদকের আখড়া ও বখাটেদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
* ক্রীড়ামোদীদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
* জেলা ক্রীড়া সংস্থা বলছে, ২০২২ সালের মধ্যেই এটি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নির্মাণের ২২ বছর পরও ফেনীতে নির্মিত মরহুম মাহবুবুল হক পেয়ারা সুইমিংপুলটি চালু করা হয়নি। নির্মাণ ক্রুটির অজুহাতে এটি চালু না রাখায় অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পুলটিতে স্থাপিত মোটর ও যন্ত্রপাতি, দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল, ধসে পড়ছে পলেস্তারা।
পুল চাল না থাকায় জনমানবশূন্য তিন একরের এ জায়গাটিতে এখন দিন-রাত মাদকের আখড়া ও বখাটেদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থা বলছে, ২০২২ সালের মধ্যেই এটি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ফেনী শহরের দাউদপুর এলাকায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয় ফেনী জেলা সুইমিংপুল।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার তত্ত্বাবধানে ৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত ৮ লেনের এ সুইমিংপুলটি ২০১৪ সালে মরহুম মাহবুবুল হক পেয়ারা সুইমিংপুল নামকরণ করা হয়। জেলা পর্যায়ে সাঁতার শেখানো, বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং স্থানীয় ও আশপাশের জনসাধারণের জন্য সাঁতারের ব্যবস্থা করতেই সুইমিংপুলটি নির্মাণ করা হয়।
ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝামাঝি হওয়ায় ফেনীর এ সুইমিংপুলটি সাঁতার প্রতিযোগীতার জন্য জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যু হওয়ার কথা ছিলো; কিন্তু ক্রীড়া সংস্থার উদাসীনতা, আর্থিক সংকট, জনবল না পাওয়া ও সংস্কারের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে নির্মাণের ২২ বছর পরও এটি চালু করা যায়নি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুইমিংপুলের মূল ভবনের সামনে বৃহদায়তনের মাঠে ক্রিকেট প্র্যাকটিস গ্র্যাউন্ড। যেখানে কয়েকজন কিশোর অনুশীলন করছে। আশপাশে শুনশান নীরবতা। এখানে একজন দারোয়ান নিয়োজিত থাকলেও দীর্ঘ ২ ঘণ্টা পর্যন্ত তার দেখা মেলেনি।
সুইমিংপুলের পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন কিশোর ধুমপানের পাশাপাশি আড্ডায় মত্ত্ব। দীর্ঘদিন পরিচ্ছন্নতা না করায় পূর্বপাশ এবং পশ্চিম পাশ আগাছায় ভরে উঠেছে। মূল ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় এখানকার পুলের বেসিনের টাইলস্গুলো উঠে যাচ্ছে, পলেস্তারা খসে পড়ছে, দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল। অযত্ন আর অবহেলায় যন্ত্রপাতিগুলো মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পুল থাকার পরও ব্যবহার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় কিশোর সায়মন বলেন, ‘নগরায়নের কারণে দিনদিন ফেনী শহরে পুকুরের সংখ্যা কমছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এখানে সুইমিংপুলটি নির্মাণের পরও কেন এটি চালু হচ্ছে না তা কেউ জানে না। এটি চালু না হওয়ায় দিনরাত এখানে বখাটেদের আড্ডা জমে উঠেছে। জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটি চালু করলে আমরা সাঁতার শিখতে পারতাম। বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারতাম। এতে করে স্থানীয় যুবকদের মাঝে মাদকাসক্তের হার কমতো, কিশোরগ্যাং সমস্যা থাকতো না।’
কিশোর ক্রিকেটার নিহান বলেন, ‘ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রায় সময় ক্রিকেট প্র্যাকটিসের জন্য আমাদেরকে এ মাঠে আসতে হয়। প্র্যাকটিস শেষে শরীরে দুর্গন্ধ, ঘাম আর ক্লান্তিতে একাকার হয়ে যাই। ভেজা শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। এখানে সুইমিংপুলটি চালু থাকলে প্র্যাকটিস শেষে গোসল করে বাড়ি ফিরতে পারতাম।’
ফেনী জেলা ক্রিকেট এসোসিয়েশনের সভাপতি ইমন উল হক বলেন, ‘২২ বছরেও ফেনীর সুইমিংপুলটি চালু না হওয়া দুঃখজনক। এটি শুধু শিশু-কিশোরদের জন্য প্রয়োজন তা নয়; এটি চালু হলে সাঁতারু সৃষ্টি হবে। প্রতিযোগিতার আরো একটি ইভেন্ট যোগ হবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে বারবার আলোচনা করেও কোন ফল পাইনি।’
ফেনী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বাহার জাগোনিউজকে বলেন, ‘এটি ২০০০ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু ক্রুটির কারণে এটি চালু করা সম্ভব হয়নি। ২০১০ সালে আমি দায়িত্বে আসার পর চেষ্টা করেছি এটি চালু করার জন্য। এখানে বসানো মোটরে ক্রুটি রয়েছে। পুলেও ক্রুটি আছে। চেষ্টা করেছি ক্রুটিগুলো সংস্কার করে চালু করার জন্য। এর সংস্কারের জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন তা বহনের সক্ষমতা ক্রীড়া সংস্থার নেই। তারপরও ২০২২ সালের মধ্যেই এটি চালুর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’
এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেনীর সুইমিংপুলটি বড় একটি স্থাপনা; কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় যে, শুরুর পর থেকে এটি চালু করা হয়নি। এটি চালু করতে হলে নতুনভাবে অনেক কাজ করতে হবে। বিষয়টি আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। এটি চালু হলে স্থানীয়রা সুইমিং শিখতে পারবে। সাধারণ মানুষও সুইমিং করতে পারবে। ফেনীতে সাঁতার প্রতিযোগী সৃষ্টি হবে।’
নুর উল্লাহ কায়সার/আইএইচএস/